সংকটের মধ্যে বসবাস


সংকটের মধ্যে বসবাস

সুনীল আকাশে মাস্ক পড়া উদ্বিগ্ন পৃথিবী। দিশার নাগাল নেই। সাগর পাড়ের ডলফিন, বনের পাখিরা খুশি হলেও মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত। সবাই ঘরের কোনায় লুকিয়ে। যেনো মুখ বের করলেও থাবা মেরে বসবে। এই পরিস্থিতিতেও কিন্তু তিন পেশার মানুষ ঘরের বাইরে। চিকিৎসক, আইন শৃংখলা বাহিনী ও সাংবাদিক। এরা বিপদের শংকা মাথায় নিয়েই সেবা দিচ্ছেন।  জীবনের ভয়কে তুচ্ছ করে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। আইন শৃংখলা বাহিনীকে রাস্তায় থাকতে হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। আর সাংবাদিকদের মাঠে, ঘাটে, হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে খবর দেয়া বা সতর্কবার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য। কাগজের সাংবাদিকদের একটু আধটুকু নিরাপদে থাকার সুযোগ আছে কিন্তু সম্প্রচার সংবাদকর্মীদের সেটুকুও নেই।

হ্যাঁ সে কথাই বলছি। মানুষ বাঁচাতে রাষ্ট্রের এই তিন পেশার কর্মীদের বেশি দরকার। অন্য দুই পেশার জনবল প্রশাসনের অংশ। তারা প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে চলে। কিন্তু গণমাধ্যম সব সময় রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করে নিজস্ব প্রেরণা,তাড়না ও দায়বদ্ধতা থেকে। জ্নগণের জন্য তাদের এই দায়বদ্ধতা। তাই সরকার যন্ত্রকে তাদের স্বার্থেই এই শক্তিশালী মাধ্যমটিকে তাদের কাছাকাছি রাখা জরুরী। 
জাতির যেকোন দুর্যোগই এই গণমাধ্যম এগিয়ে এসেছে যুগে যুগে। নিজের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করেনি কখনও। বন্যা বলুন, সাইক্লোন বলুন, আগুন বলুন কিংবা রাজনৈতিক সংকটে হানাহানি বলুন। 

সত্তুর সাল কিংবা একানব্বই সালে উপকূলে ঘূর্নিঝড়ে সাংবাদিকরাই ছুটে গিয়ে খবর পৌঁছে দিয়েছিল সবার আগে। তখন প্রশাসন ছুটে যায় দুর্গতদের বাচাঁতে। রাজনৈতিক কথা বলি উনসত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলানোর চেষ্টা হলো। সামরিক আদালতের সমস্ত প্রসেডিংস সাংবাদিকরা পত্রিকায় ছাপতে শুরু করলো। জাতি জেগে উঠলো। গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেলো। মুক্তি মিললো বঙ্গবন্ধুর। একই ভাবে নব্বই সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জাতিকে এক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল সাংবাদিক সমাজ। আজকে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে মানবজাতি। এ সময় স্বাধীন এই গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে সরকারকে। বিপদ থেকে বাঁচার পথ এই একটাই। মানুষ এখন নিজের হাত দুটোকেই বিশ্বাস করতে আস্থায় নিতে পারছেনা এই দু:সময়ে সরকার যতোই কথা বলুক, ততোক্ষণ পর্যন্ত জনগন তা আস্থায় নেবেনা যতোক্ষন না মূলধারার গনমাধ্যম তা নিজের করে প্রচার না করবে। সাংবাদিকরা বলছেন তারা ঝুঁকি নিচ্ছেন আরও নেবেন। সরকারের উচিত হবে তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। 

করোনার কারণে অর্থনীতির ওপর প্রভাব অনেক। 
সংকট মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন সেক্টরে প্রণোদনা দিয়েছে। সাংবাদিকদের জন্য দেয়া হয়েছে যৎসামান্য, শুধু চাকরিচ্যুতদের ১০ হাজার করে টাকা। বেসরকারি টেলিভিশন মালিকরা প্রণোদনা চেয়েছেন। আমরা মনে করি এই প্রণোদনা হওয়া দরকার সংবাদকর্মীদের। সংবাদকর্মীরা তাদের কাজের তাগিদেই করোনার খোঁজ-খবর নিতে যান সে জন্য তাদের আর্থিক, সামাজিক ও পেশায় সুরক্ষা দরকার। গণমাধ্যমের বেশির ভাগ মালিক সময়মতো বেতনই দিতে চান না সুরক্ষা দেবেন কি করে? অন্য পেশার মানুষ ঝুঁকি ভাতা পেলে সংবাদকর্মীরা পাবেনা কেনো? 

এই সংকট কালে রাষ্ট্রের এ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা জরুরি। ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি সম্প্রচার কর্মীদের জন্য এই দাবি জানিয়ে আসছে শুরু থেকেই। দাবি করা হয়েছে, এই দু:সময়ে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে যেনো চাকরি থেকে বিদায় করা না হয়। কারণ সাংবাদিকরা তাদের অনেক কিছু দিয়েছেন মান, মর্যাদা, ব্যবসা। সেটি এই সময়ে উপলব্ধি করা যেতে পারে। গত বছর হাইকোর্ট একটি রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছিল সাংবাদিক ছাড়া গণমাধ্যমের মালিকরা গুরুত্বহীন। মহামান্য হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব আশা করি মালিক ও সরকার অনুধাবন করবে। 

ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি নতুন সংগঠন। তাই এর শক্তি ও সামর্থ এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি। তবুও এই সংগঠন হাত বাড়িয়েছে সম্প্রচার সহকর্মীদের বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য। আমরা দেখেছি সাংবাদিকের বিপদে কেউ এগিয়ে আসেনা। সবাই ভাবে সাংবাদিকরা ঐশী শক্তির অধিকারী, তাদের সহায়তার দরকার পড়েনা। তাদের সংসার নেই, সন্তান নেই, চাহিদা নেই। কিন্তু আমরা দেখি সংকটে কতোটা অসহায় আমরা। তাই বিজেসি মনে করে সংবাকর্মীদের সক্ষমতা নিজেদের অর্জন করতে হবে।নিজেদের সুরক্ষা নিজেদের দিতে হবে, যতোদিন না রাষ্ট্র এই দায়িত্ব নেয়। এই করোনায় বিজেসি যেসব কাজ করেছে তার কিছু এরকম। 
১ . প্রথমেই মার্চ মাসে বিজেসি টেলিভিশন সাংবাদিকদের জন্য প্রত্যেক হাউসে মাস্ক, নিজেদের তৈরি করা হ্যান্ড সেনিটাইজার, হ্যান্ড গ্লভস, পিপিই পৌঁছে দেয়।
২ . দ্বিতীয় দফায় চাল,আটা,ডাল,তেল,চিনি,আলু,
লবনসহ খাদ্য সামগ্রীর ব্যাগ উপহার হিসেবে দেয়া হয় যাদের প্রয়োজন সেইসব সদস্যের কাছে। অনেকে বিজেসির অফিসে এসেও এসব সামগ্রী নিয়ে গেছেন। 
৩ . বিজেসি সাংবাদিকদের জন্য করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মহাখালীতে একটি কমিউনিটি সেন্টার বরাদ্দ করে। সেই সেন্টারে একটি ল্যাব স্থাপন হয়। এই কার্যক্রমে ল্যাব, কীট, টেকনিশিয়ান ও ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করছে গাজী গ্রুপ। তত্ত্বাবধান করছে স্বাস্হ্য অধিদপ্তর। প্রতিদিন ৩০ জন সাংবাদিকের পরীক্ষা হয় সেখানে। 
৪ . করোনা রোগী প্রথম দিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কতো কঠিন ছিল ভুক্তভোগীরাই জানেন। তাই বিজেসি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সাথে চুক্তি করে। তারা টেলিভিশন সাংবাদিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভর্তির ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা দেয়।
৫ . এই ব্যবস্থায় টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন এ্যাটকো সহযোগিতার আশ্বাস দেয় কিন্তু সেটি প্রয়োজন হয়নি।
৬ . রোগীদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য এম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করেছে বিজেসি। পাথওয়ে এই সহযোগিতায় এগিয়ে আসে।
৭ . আমাদের এই উদ্যোগ দেখে আরও অনেকে এগিয়ে আসে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিজেসিকে ১০ হাজার মাস্ক, ৩ হাজার পিপিই ও সেনিটাইজার দিয়ে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে আছে ব্র্যাক, কারুপণ্য রংপুর, টেক্সটাউন, টাম্পাকো গ্রুপ, পানাম গ্রুপ। এইসব সামগ্রী আমরা সংবাদকর্মীদের মধ্যে বিতরণ করি। হাউস প্রতিনিধিরা সেগুলো নিয়ে তার হাউসের সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেন।
৮ . সংবাদকর্মীদের টেলি চিকিৎসা পাওয়ার জন্য ওলওয়েল এর সঙ্গেও চুক্তি করে বিজেসি। এতে করে টেলিফোনে চিকিৎসা সেবা নেয়া যাচ্ছে যেকোন সময়।
৯ . এই দুর্যোগে সংবাদকর্মীদের কি কি বিধি নিষেধ মানা উচিত, কেমন করে মাঠে কাজ করতে হবে তার জন্য এমআরডিআই এর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করে গাইড লাইন প্রস্তুত করে বিজেসি।
১০ . বিজেসি তথ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করে এই দুর্যোগে সাংবাদিকদের জন্য প্রণোদনা দেয়ার আহবান জানিয়েছে। তবে তথ্যমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে সাংবাদিকদের করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেন।
১১ . করোনা রোগীদের অনেকেরই প্লাজমা দরকার হয়ে পড়ে। বিজেসি শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট ও বাঁধনের সাথে মিলে প্লাজমা সেন্টার তৈরি করে। 
১২. বিজেসি টেলিভিশন মালিকদের কাছে সংবাদকর্মীদের বেতন নিয়মিত দেয়া ও চাকরিচ্যুত না করার আহবান রাখেন। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন হাউসে চাকরিচ্যুতের ঘটনা ঘটেছে। বিজেসি এর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। 

সম্প্রচার সংবাদকর্মীদের উন্নয়ন, সুরক্ষা, সংকট মোকাবেলা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে গড়ে ওঠা বিজেসি এখন উদ্যোগ নিয়েছে, চাকরি হারানোদের পুণর্বাসনের। আমরা এমন একটা প্লাটফর্ম করতে চাই যাতে কর্মহীনদের কাজের সুযোগ তৈরি হয়। সেটি নিউ মিডিয়ার স্বপ্ন। ইতিমধ্যে একটি ছোট গ্রুপ এই প্লাটফর্মে যুক্ত হয়েছে।  এই উদ্যোগে আমরা সফল হবোই। 

লেখাঃ রাশেদ আহমেদ, ট্রাস্টি, বিজেসি