নিউ মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টিভিগুলোর করণীয়


নিউ মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টিভিগুলোর করণীয়

 

বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৭টি টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারে আছে। আরো ১০ টি চ্যানেল সম্প্রচারে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সামনে আরো বেশকটি চ্যানেল আসবে বলে জানা গেছে। খুবই ভালো খবর। তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশের জন্য খুশির সংবাদ। কিন্তু সমস্যাটা হলো জনবল। আর দশটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতো টেলিভিশন নয়। টেলিভিশন একটা মেধাবী সৃষ্টিশীল ও টেকনিক্যাল মানুষনির্ভর শিল্প। এই শিল্পে কাজ করে সৃজনশীল দক্ষ অভিজ্ঞ আইটি বিশেষজ্ঞ সংবাদ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। এই মানুষ একদিনে গড়ে ওঠেনা। বছরের পর বছর সময় লাগে।

৩৭টি টেলিভিশনের জন্য কমপক্ষে ৩৯শ এই রকম মানুষ প্রয়োজন।

বাংলাদেশে সত্যিই আছে কি?

বিষয়টা আরো পরিস্কার করে বলি-

একটা টেলিভিশনে কাজ করেন বার্তা বিভাগ, অনুষ্ঠান বিভাগ, সম্পচার বিভাগ, আইটি বিভাগ, বিক্রয় ও বিপনন বিভাগ, অর্থ বিভাগ, প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগসহ আরো অনেক বিভাগের লোকজন।

বার্তা বিভাগে আছেন বার্তা সম্পাদক, বার্তাকক্ষ সম্পাদক, প্রতিবেদক, প্রযোজকসহ আরো অনেকে। সম্প্রচার বিভাগে কাজ করেন কামেরাম্যান, ভিডিও এডিটর, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারসহ আরো অনেক টেকনিক্যাল মানুষ। আইটি বিভাগে কাজ করেন আইটি সংক্রান্ত লোকজন, গ্রাফিক্স ডিজাইনার। কয়েকজন টেকনিক্যাল ও আইটি জ্ঞানসম্পন্ন ছাড়া বাকি সবাই ক্রিয়েটিভ মানুষ। আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে তারা কাজ করেন।

প্রশ্ন হলো সৃষ্টিশীল ও টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ যদি এক বছর বা দুই বছরে তৈরি না হয় তাহলে বাংলাদেশের এতোগুলো টিভি চ্যানেল চলছে কী করে?

উত্তরটা খুব সহজ, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মানের সাথে আপোষ করে।

যদি একটা মিক্সড চ্যানেলে অনুষ্ঠান ও বার্তা বিভাগে ২০ জন প্রযোজক, ২০ জন ক্যামেরামান, ২০ জন ভিডিও এডিটর, ১০ জন গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ১০ জন আইটি বিশেষজ্ঞ, ৫ জন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, ৫ জন অনলাইন ভিডিও এডিটর, ৫ জন মেকআপ আর্টিস্ট, কম্পাইলেশনে ৫ জন ও এমসিআর-এ ৫ জন দক্ষ মানুষ প্রয়োজন হয় তাহলে শুধু টেকনিক্যাল ও সৃষ্টিশীল কাজের জন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলে মোট জনবল দরকার কমপক্ষে ১০৫ জন। 

এই মানুষগুলোকে টেলিভিশনের কাজ অবশ্যই বুঝতে হয় এবং হাতে কলমে করতে হয়। তা না হলে টেলিভিশন তার সম্প্রচার কাজই চালাতে পারে না।

প্রতিটা চ্যানেলে ১০৫ জন টেকনিক্যাল ও সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে ৩৭ চ্যানেলে প্রয়োজন ৩হাজার ৮শ ৮৫ জন। প্রায় তিন হাজার ৯শ জন।

এই ৩ হাজার ৯শ মানুষ কি বর্তমানে বাংলাদেশে আছে?

হয়তো তার চেয়ে বেশি আছে। তা না হলে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো চলতে পারতো না।

মানের কথা চিন্তা করলে বা সম্প্রচারে থাকা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সংবাদ ও অনুষ্ঠানমালা দেখলে সহজেই বোঝা যায় দক্ষ জনবলের অভাব আছে।

বাংলাদেশে এমনও অনেক চ্যানেল আছে যে সবের বিনিয়োগ যথেষ্ট পরিমাণ। কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষ ও দক্ষ জনবলের অভাবে চ্যানেলগুলোর পর্দায় তাকানো যায় না। অবশ্য আজকাল দর্শকরা স্বাধীন হওয়াতে ঐসব চ্যানেল বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। গালমন্দ শুনতে হচ্ছে না। তারপরও দর্শকের চাহিদার কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।

আসা যাক ২৪ ঘন্টা নিউজ চ্যানেলের ব্যাপারে। জনবলের হিসাবটা প্রায় একই। এসব চানেলে নিউজ সেন্স বা সংবাদজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ বেশি দরকার হয়। সেজন্য প্রতিবেদক, বার্তা সম্পাদক, বার্তাকক্ষ সম্পাদক ও বার্তা প্রযোজকের সংখ্যা কিছু বাড়বে। অন্যান্য জনবল মিক্সড চ্যানেলের মতোই বা কম বেশি হতে পারে। গড়ে ৩৯শ’র নিচে নামবেনা। বিভাগ অনুযায়ি কম বেশি হবে। নিউজ চ্যানেলে অনুষ্ঠানের লোক না লাগলেও নিউজের জন্য লোকবল বেশি লাগে। এসব লোকবল টেলিভিশন জ্ঞানসম্পন্ন হলে ভালো হয়।  

পত্রিকার একজন সংবাদকর্মী আর টেলিভিশনের একজন সংবাদকর্মীর পার্থক্য আকাশ পাতাল। দুজনই সংবাদকর্মী। দুজনেরই সংবাদজ্ঞান আছে। কিন্তু কাজের ধারাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

অনেক সময় দেখা যায় পত্রিকায় যেটা দিনের প্রথম খবর টেলিভিশনে সেটা শেষ খবর হিসেবে যাচ্ছে। এই আলোচনায় না গিয়ে শুধু বলা যায় পত্রিকার মানুষ দিয়ে টেলিভিশন চালানো যায় তবে সময় দিতে হয়। মধ্যবর্তী সময়টায় কারা চালাবে টেলিভিশন? এমন একটা প্রশ্ন আসে। অবশ্যই টেলিভিশনের পর্দা ফাঁকা যাবেনা। সেক্ষেত্রেও ঘুরে ফিরে একই কথা আসে, দক্ষ ও সৃষ্টিশীল টেলিভিশন সংবাদ জ্ঞানসম্পন্ন জনবল। কেবলমাত্র জনবলের কারণে এক এক টেলিভিশনের মান এক একরকম।

১৯৯৯ সালে একুশে টেলিভিশন লিমিটেড (ইটিভি)-তে যে মানুষগুলো কাজ শুরু করেছিলেন তারা আজ বিভিন্ন টেলিভিশনের মাথায় বসে আছেন। কেউ কেউ টেলিভিশনের মালিকও হয়েছেন।

সেই মানুষগুলোর হাতধরে বা অন্য কারো হাত ধরে যারা টেলিভিশন শিল্পে কাজ করতে এসেছেন তারা সরাসরি সম্প্রচারে নেমে পরীক্ষা দিচ্ছেন। দর্শকদের বিচারে কেউ পরীক্ষায় পাস করছেন কেউবা ফেল।

পেশাদারিত্বের বিবেচনায় পরীক্ষাটা হওয়া উচিত সম্প্রচারে যাবার আগে।

উপরে যেসব বিভাগের কথা বলা হয়েছে সেসব বিভাগের মানুষ যদি সম্প্রচারের আগে পরীক্ষায় পাস করেন তাহলে দর্শকদের সামনে লজ্জা পাবেন না। দর্শক রিমোটের ঘনঘন ব্যবহার করবেন না।

বর্তমানে ৩৭টি টিভি চ্যানেল অন্যরকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চালেঞ্জ। ওটিটি বা ওভার দ্য টপ নামক প্ল্যাটফর্মের দাপটে টেলিভিশন চ্যানেল বিশেষকরে মিক্সড চানেলগুলো অস্থির। এই অস্থিরতা হতে রেহাই পেতে হলে দরকার দক্ষ অভিজ্ঞ সৃষ্টিশীল ডিজিটাল জ্ঞানসম্পন্ন জনবল। কারণ দর্শক চায় Quality অনুষ্ঠান।

Quantity যদি Quality’র জায়গা দখল করে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইউটিউব ফেসবুক কিংবা আইপি টিভিতে এমন সব Quality অনুষ্ঠান মাঝে মধ্যে দেখি যে নিজের অজান্তেই বলে ফেলি Nice, Great job.

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে টিকে থাকার জন্য Quality অনুষ্ঠান নির্মাণ করতেই হবে। সবরকম অনুষ্ঠান ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখা যায়। বাসে কিংবা ট্রেনে ভ্রমণ করতে করতে দর্শক এসব অনুষ্ঠান দেখে। ঘটাকরে টেলিভিশনের সামনে বসে দেখার সময় কারো নেই। নিউজের ব্যাপারে একই বিষয় প্রযোজ্য। মান ধরে রাখাটা বড় কথা। বর্তমান সময়টা আইপি টিভি, ইউটিউব ও ফেসবুকের দখলে। এসবের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে দরকার চমৎকার Concept and Content. বলা হয় Concept and Content is the King of this ultra-modern age.

অনলাইনভিত্তিক চ্যানেলগুলো এই চিন্তা মাথায় রেখে কাজ করে। তাই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। দর্শক টিভি চ্যানেলগুলো থেকে ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে অবস্থা আরো বেগতিক হবার আশংকা আছে।

শুধু উন্নতমানের যন্ত্রপাতি থাকলেই হবে না। যন্ত্রপাতিগুলোর উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত মানুষ প্রয়োজন। যন্ত্রের পিছনের মানুষগুলোর দক্ষতা আরো বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ।

সময়ের সাথে চলার জন্য সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। সময়ের চ্যালেঞ্জের জবাব সময়কে জয় করেই দিতে হবে।

 

মোহামমদ শাহাবুদ্দিন, গণমাধ্যমকর্মী, লেখক