সুবিধা'র অসুখ নিয়ে !


সুবিধা'র অসুখ নিয়ে !

দেশের চলমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে ‘ধর্মেও আছি জিরাফেও আছি- এমন 'সুবিধা'র অসুখ নিয়ে হবেনা, টের পাচ্ছেন!’ শিরোনামে লিখেছেন একাত্তর টেলিভিশনের চিফ প্ল্যানিং এন্ড কনটেন্ট এডিটর নূর সাফা জুলহাজ। বিজেসি নিউজের আগ্রহী পাঠকদের জন্য তা হুবুহু তুলে ধরা হল।

‘আমার চোখ দৃষ্টব্যের উল্টো দিকে ফেরানো,

সেখানে ফালতু আবরণ উঠে গিয়ে আসল বেরিয়ে পড়ে।

কেউ বক্তৃতা করলে আমি শুনতে পাইনা,

বরং বক্তার জিভের উপর তার আত্মাকে দেখতে পাই।

কেউ সেজদায় নত হলে

আমি দেখি একটি কলস ভরা লোভ উবুড় হয়েছে’।

এই হলো 'উল্টানো চোখ', লিখেছেন আল মাহমুদ, সোনালী কাবিনে! এই 'উল্টানো চোখ' কিংবা দৃষ্টি, যা বক্তার জিভের ওপর তার আত্মাকে দেখতে পায়, এটাই হলো আমার কাছে 'মিডিয়া'! আর গোলটাও বাধছে এখানেই। কারণ এই দৃষ্টি আবার নির্ভর করে ভঙ্গির উপর। যাকে বলি দৃষ্টিভঙ্গি। তাও আবার নির্ভর করে দাঁড়ানোর ওপর! কোথায় দাঁড়িয়ে, কিভাবে দাঁড়িয়ে দেখছি, বিচার করছি। মিডিয়া কি দেখছে, কিভাবে দেখছে, কতোটা দেখছে, কতোটা দেখতে পারছে, কতোটা দেখাতেও পারছে এই পুরো অবস্থানের একটি আর্থ-রাজনীতি আছে। আছে ফলাফলও।

আমার কাছে মিডিয়া হলো রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র, অনেকটা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়! এ এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। এ দুয়ের মধ্যে বিরোধও আছে, আছে ঐক্যও। এ বিরোধ মূলত বিকাশের জন্য, মানুষের বিকাশ। যা কিছু বিচ্যুতি, যা কিছু বাড়াবাড়ি, হোক তা বৈষম্যের, ধর্মের বা ক্ষমতার, তা দেখালে বিরোধ হবে। হয়েছেও তাই।

আর যদি না 'দেখা'র বা না দেখানোর 'ঐক্য' থাকে, ভুলগুলোকে 'দৃষ্টি'তে না আনার 'আরাম কেদারায়' বসে পড়া হয়, তবে প্রথমে মিডিয়া মরে, তারপর রাষ্ট্র!

আমরা মিডিয়া কতোটা মাদ্রাসার ভেতরে দৃষ্টি রেখেছি? কতোটা চোখ রেখেছি স্কুল- কলেজ গুলোয়, কতোটা ইংলিশ মিডিয়ামগুলোয়? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়? জনগনের টাকায় মানুষ হওয়ার কারখানাগুলো দিনশেষে কি উৎপাদন করছে? ছোটবেলা থেকে পরস্পর বিরোধী তিনটি গোত্র আমরা বানাচ্ছি যারা একটা সাধারণ একক রাষ্ট্রবোধে বিশ্বাস করেনা! যারা 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার' এ গণতান্ত্রিক বোধে নেই, যারা এক গোত্র আরেক গোত্রের জীবনকে মনে করে 'বেদাত' বা অপরাধ বা অপবিত্র! আরেক গোত্র অন্যদের মনে করে 'অকর্মা', অনাধুনিক বা নষ্ট!

যারা গতকাল সংগীত-সিনেমা, আজকে ভাস্কর্য নিয়ে ফতোয়া দিচ্ছে, আগামীকাল তারা ঘরের আসবাব নিয়েও ফতোয়া দেবে। মিডিয়া কতোটা নজরে এনেছে যে, এই আমরাই আমাদের এক বিশাল সংখ্যক সন্তানকে আমাদেরই বিনিয়োগে বানাচ্ছি আমাদের রাষ্ট্রবিরোধী! এ পরস্পর বিরোধী গোত্র কি করে হবে এক বাংলাদেশ?

৫০ বছরে কতোটা জোর আওয়াজ দিয়েছে এ প্রশ্নে মিডিয়া? ক্ষমতা তো শুধু প্রশাসনিকতা নয়, ক্ষমতা চিন্তাও বটে। যে চিন্তা আসে শিক্ষাকাঠামো থেকে। ৭০ দশকে ফুকো এমনটাই আলাপ দিয়েছেন, যখন আমরা ছিলাম মুক্তির যুদ্ধে।

ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি এমন 'সুবিধা'র অসুখ নিয়ে হবেনা, টের পাচ্ছেন! যেমন মিডিয়া তেমনি রাজনীতি, যেমন রাজনীতি তেমনি মিডিয়া। পরস্পরকে এগিয়ে দেয়ার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা আমরা রেখেছি কি? দু'য়ে মিলে মরছি নাতো!

'উল্টানো চোখ'টা বাঁচিয়ে রাখছিতো? #

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করা এই লেখায় নিজেদের মতামত তুলে ধরেছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরাও। কমেন্টে এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ.ই. মামুন লিখেছেন, ‘মিডিয়া নিস্পৃহ প্রচার মাধ্যম নয়। তারা রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং মালিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় যতটা সোচ্চার জাতীয় সংস্কৃতি বা স্বার্থের ক্ষেত্রে ততটা নয়’। টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ টুয়েন্টিফোরের সিনিয়র নিউজ এডিটর বোরহানুল হক সম্রাট লিখেছেন, ‘যে শিক্ষার প্রবৃদ্ধির হাত ধরে চিন্তার প্রবৃদ্ধি, সহনশীলতার প্রবৃদ্ধির যাত্রা পথ নির্ধারিত হতে পারতো সেখানকার বিপরীতমূখী প্রসার কে বা কারা মেনে নিয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। শিক্ষানীতি ২০১০ এর অন্যতম কারিগর ড. খলীকুজ্জামান স্যার এখন মাঝে-মধ্যে কবিতা লিখেন। সে কবিতার বিষয়বস্তু তার সাথে বসে থাকা সময়গুলোকেও মলীন করে দেয়। কত সম্ভাবনার বিপরীতে আক্ষেপ আর কত দীর্ঘশ্বাস। তবে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আপনার আক্ষেপ যথাযথ ও সুনির্দিষ্টভাবেই নির্মম সত্য’। যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মাহফুজ মিশু লিখেছেন, ‘চিন্তার খোরাক ভাই। আমাকে বলেন, আমাদের রাজনীতি- শিক্ষা - প্রশাসন সবই তো দেশবিচ্ছিন্ন। যাদের কথা বললাম, তাদের সন্তান এদেশে পড়ে না, চিকিৎসা নেয় না। দেশটাকে ওউন করে না। আর শিক্ষার কথা! একটা শিক্ষানীতি নিয়ে কি হলো, কি হয়েছিল সবই তো জানা। বিশ্ববিদ্যালয় কোন পথে নিয়ে গেলাম, তা ভাবলে মনে হয়, আত্মহননের এমন পথ আর কোন জাতি কি বেছে নিয়েছে? সব যখন এই পথে তখন সাংবাদিকতাও গড্ডালিকা প্রবাহেই গা ভাসিয়েছে। কদিন ধরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এসব দেখে শুনে, খানিকটা বুঝেও’।