আমি মারা গেলে আমার কবরে একটা টিনের চোঙ্গা রেখে দিস


আমি মারা গেলে আমার কবরে একটা টিনের চোঙ্গা রেখে দিস

 

' আমি মারা গেলে আমার কবরে একটা টিনের চোঙ্গা রেখে দিস। লোকে জানবে এই একটা লোক একটা টিনের চোঙ্গা হাতে নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলো এবং সারাজীবন সেই টিনের চোঙ্গায় 'বাঙালি বাঙালি' বলে চিৎকার করতে করতেই মারা গেলো।' এমনই একবার বঙ্গবন্ধু যুবলীগ কর্মীদের বলেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু আমরা বঙ্গালিরা তাঁকে স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকারটুকুও দেইনি। আমরা তাঁকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করেছি!

অথচ আমাদের অধিকারের জন্য তিনি লড়েছেন আজন্ম। ৫৫ বছরের জীবনে রাজনীতিতেই গেছে তাঁর ৩৬ বছর। আর সে জীবনের ১২ বছরেরও বেশি সময় ছিলেন কারাগারে! এর একটিও ব্যক্তিগত কারণে নয়, প্রতিটিই বাঙালির স্বাধিকার নিয়ে লড়তে গিয়ে যা একাত্তরে এসে পরিণত হয়েছিলো জনযুদ্ধে। তাঁর অবিসংবাদিত নেতৃত্বে যে দেশ স্বাধীন হলো, সেখানে তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছরের কিছু বেশি দিন।

আমরা তাঁকে তাঁরই স্বাধীন করা দেশে হত্যা করেছি। হত্যা করে সে হত্যার বিচার চাওয়া বা করা আইন করে বন্ধ করেছি। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্র-বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদকে মুছে দিয়েছি। জিন্নাহ টুপি-তসবীহ চালু করছি। মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশের 'আইডিয়া' সেদিন এভাবে বেহাত হয়েছিলো!

সেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি। আজো কি তাঁর আদর্শকে বাঁচাতে পারছি? বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৪৯ ভাগের বয়স ২৮ এর নীচে। এদের কাছে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা কি পৌঁছানো গেলো? টানা তিন মেয়াদে এক যুগের বেশি ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। তারা কি পারছেন বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-আদর্শ তরুণদের মধ্যে ট্রান্সফার করতে? এটা কি তাদের প্রায়োরিটিতে আছে? সোশাল মিডিয়া যদি তরুণদের ইন্টারঅ্যাকশান স্পেস হয় তবে সেখানে রিফ্লেকশান কি দেখি?

শুধু কতোগুলো প্রকাশনা আর সরকারি কর্মসূচি দিয়ে কি বাঁচানো যাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ? চিন্তার নতুন বিন্যাসের সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচি কই? ঘরে ঘরে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা কই? আমরাতো শফি-মামুনুলের চিন্তার আধিপত্যের ভয় দেখছি! হেফাজত সংস্কৃতি আর অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাংলাদেশ কি এক সাথে চলতে পারে? বৈষম্য আর মানবিক মর্যাদার দেশ কি একসাথে হতে পারে? রবীন্দ্রনাথকে যেমন বাণিজ্যালয় করে তুলেছি বঙ্গবন্ধুকেও তা করে তুলছিনাতো? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সামাজিকীকরণ হচ্ছে কি?

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আলাপে আমরা খুশি হই। কিন্তু এসব প্রশ্ন তুললে কিংবা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রবৃদ্ধি কতোটা হচ্ছে- এমন জিজ্ঞাসায় আমরা অনেককে বিরক্ত হতে দেখি।

যারা বিরক্ত হন তাদের হাত ধরে বঙ্গবন্ধু আদৌ তরুণদের কাছে পৌঁছাবেন? তাই প্রশ্ন, সেদিন যেমন বাঁচাতে পারিনি, আজো কি পারছি? হত্যার বিচার করেছি আমরা, কিন্তু বাংলাদেশের আইডিয়া বিরোধী রাজনীতির বিচার কি আমরা করছি? সেটা করতে চাইলেতো আমাদের রাজনীতিটা অন্যরকম হতো। চিন্তার লড়াই হতো ফোকাস!

হুমায়ুন আজাদ বলতেন, বাঙালি বুকের ভেতর সবচেয়ে ভারী যে লাশ বহন করছে তা বঙ্গবন্ধুর! এ লাশ আসলে বুকে রেখেছি কিনা হাত রেখে দেখুনতো? টের পান? টের পান ১৫ আগস্টের ভোর যা রাতের চেয়েও অন্ধকার? দেখতে পান সেদিনের জলপাই রঙ বা এখন আরো নানা রঙে আসা অন্ধকার?