সত্য আর মিথ্যার সংখ্যার মাপকাঠি বনাম সাংবাদিকতা
২০ নভেম্বর ২০২০, ১০:৪০ পিএম
![সত্য আর মিথ্যার সংখ্যার মাপকাঠি বনাম সাংবাদিকতা](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/dru-20201201165802.jpg)
সাংবাদিকের চোখে আসলে সমাজের সবইতো ফেক! সবইতো নানা মুখোশে ছদ্মাবরনে ঢাকা । সাংবাদিক সেইসব মুখোশে আঘাত করে বের করে আনেন প্রকৃত জবাব-আসল সত্য । লম্বা ফিরিস্তি দেয়া নেতার ভাষণ শুনে প্রশ্ন করেন –আসলে জনতার কি উপকার হবে তাহাদের কার্যক্রমে । ফলে ফেক বা অসত্য ভেংগে সাংবাদিককে যে অস্ত্রের মাধ্যমে লড়াই করতে হয় তার নাম –অবিশ্বাস! যা আবার উচ্চারিত হয় খুবই মৌলিক কিছু প্রশ্নে । ফলে ফেক বনাম রিয়েল সাংবাদিকতার এই আলোচনায় আমরা বরং আজ সেই নতুন বিপদটির কথাই বলি; যেটি আমাদের সকলকেই কথা বলার স্বাধীনতা দিয়ে সত্য কোনঠাসা করে ফেলেছে । বলছি-সোশ্যাল মিডিয়ার কথা! আর আমরাতো জানি ফেক এবং রিয়েল নিউজের পার্থক্য সত্যাসত্য নির্ধারনে ।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা; সকলের প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী –গেল জুন এ তার করোনা হবার যে খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হয়েছে তার নিচে ১৬০০ কমেন্ট! এটুকু পড়ে যা ভাবলেন তা কিন্তু নয়! ওইসব কমেন্টের অধিকাংশই নেগেটিভ-বিদ্বেষমূলক!
ব্লগার ও এ্যাকটিভিস্ট মারুফ রসুল এই কমেন্টগুলো নিয়ে গবেষনা করতে এসে খুঁজে পেলেন এই ১৬০০র মধ্যে ১০১০ জনেরই প্রোফাইল লক ! মূলত অল্প কিছু মানুষ অসংখ্য ভুয়া একাউন্ট খুলে একই বিদ্বেষমূলক কমেন্ট কপি পেস্ট করছেন । এই একই একাউন্টগুলো থেকেই ফেসবুকের আরও অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা কিংবা বাংগালী জাতিয়তাবোধ তৈরী করে এমন লেখার নিচে দিনভর ক্রমাগত বিদ্বেষমূলক কমেন্ট করছেন । অর্থাত একটা সুনির্দিষ্ট দল একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত তৈরীর চেস্টা করছে ; ১৫ কোটি মোবাইলের দেশে একটা বড় অংশের কাছে সস্তা আবেগ ভুল সংস্কৃতি নির্ভর বিদ্বেষমূলক অসত্য তথ্য পৌছে দেয়া হচ্ছে ; এবং বিষবাস্পের সেই বেলুন সোশ্যাল মিডিয়া দখল করে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে ।
একইরকম ভাবে নিদারুন ভুল তথ্য সামনে এনে একাত্তর টেলিভিশনকে সম্প্রতি “নাস্তিক” ট্যাগ দেয়া হয়েছে—আহবান জানানো হয়েছে বয়কটের ; আমাদের ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানগুলোর নিচে তারপর যে বয়কটের বন্যা বয়ে যায়—তাতে মনে হয়েছে দেশের সকল মানুষ তা সমর্থন করে বসেছেন ! কিন্তু সপ্তাহ পেরুতেই একাত্তর টেলিভিশনের টিআরপি উল্টো জনসমর্থন বাড়ার পরিষ্কার বার্তা দেয় । তবে সোশ্যালে আমাদের ৫৫ লাখ ফলোয়ার কমে দাড়ায় ৫২ লাখে ।
দুটো ঘটনা আমরা নিজেরা যতটা চুলচেরা বিশ্লেষন করে এর দায় একটি পক্ষের ওপর দিতে পারলাম; সাধারন পাঠক দর্শকের কিন্তু একদম সে সুযোগ নেই ! এ মাধ্যমে বহু ব্যাবহারকারী বিভ্রান্ত হচ্ছেন – সত্য মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে; মিথ্যা সত্যে পরিণত হচ্ছে । স্বাধীন মত প্রকাশের মাধ্যম দিনশেষে প্রতিকৃয়াশীল ও অসত্য তথ্য উপস্থাপন কারীদের দখলে চলে যাচ্ছে । এবং একারনেই আজকের আ্লোচ্যর সংগে এই ঘটনাগুলোর উল্লেখ ।
এবং এটি কেবল এমন সরল নয় যে, যে যার মত যা খুশী লিখে দেয়াতেই বা অসত্য খবর ছড়িয়ে দেয়াতেই সোশ্যাল মিডিয়া গুজবের কারখানায় পরিণত হচ্ছে; বরং এর মৌল কাঠামোই “নিউজ ফিড” এর নামে ফেক নিউজ উসকে দিচ্ছে । বড় ধরনের গলদ রয়েছে ফেসবুকের কাঠামোতে ।
খবর উপস্থাপনের মৌলিক শর্ত হচ্ছে একাধিক পক্ষ বা পক্ষ বিপক্ষ প্রতিপক্ষ এমন সকল পক্ষের মত তথ্য উপাত্ত একসংগে এমন ভাবে উপস্থাপন করা যেন প্রকৃত সত্য পাঠক বুঝে নিতে পারে । এটি একইসংগে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল ধারাও তৈরী করে ।
কিন্তু ফেসবুক আমাকে আপনাকে উপায় খুলে দেয় যার যার ব্যাক্তিমত একপাক্ষিক ভাবে তুলে ধরার! এবং সেই মত কিংবা তথ্য যখন প্রচলিত ধর্ম রাজনৈতিক বিশ্বাস সামাজিক আদর্শর সংগে মিলে যায়; সেটিকেই তখন “অধিকাংশ” মানুষ সমর্থন লাইক এর পাহাড়ে তুলে ফেলে । সেটি তখন যত প্রাচীন পন্থীই হোক না কেন জনসমর্থনের চাপে সত্য বা সঠিক বিবেচিত হয়ে পড়ে । বহু পড়াশোনা করে অগ্রসর কিন্তু সংখ্যায় কম মানুষ তখন আর কাউন্টার মত দিয়ে সেখানে টিকে থাকতে পারে না! আর এভাবেই মিথ্যা সত্য হয়ে যায় । সত্য মিথ্যা ।
রাজনৈতিক দুরভিসন্ধী যাদের তারাই সোশ্যাল মিডিয়ার এই দুর্বল দিক ব্যাবহার করে দেশে দেশে ভুল আদর্শ প্রচারের সুযোগ পেয়ে যায়। তা বিশ্বাস করার মানুষেরও কমতি থাকে না । পাশের দেশ মিয়ানমারে যেমন সামরিক জান্তা সমর্থিত সরকার এর ফেসবুক পাতায় এবং তাদের মিডিয়ায় টানা কয়েক বছর রোহিংগা বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল । আর এরপর সত্যিই যখন তারা মেরে ফেলল ১১ হাজারেরও বেশী রোহিংগা—মানব ইতিহাসের চুড়ান্ত অমানবিক ওই দিনগুলোতেও ঘটনার পক্ষে সাফাই গেয়েছে বহু সংখ্যক মানুষ । কারন একপাক্ষিক কিন্তু যার যার পছন্দ অনুযায়ী তথ্যেই তুষ্ট থাকতে চায় বর্তমানের মানুষ ; তা সে যত হিংস্র নিষ্ঠুর ঘটনাই হোক ।ফলে আজ যা নিরীহ ইউটিউব প্রোপাগান্ডা কাল তাই দেশে বড় অনাচার তৈরী করে ফেলতে পারে ! স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশেই যেমন শহীদের রক্তের ইতিহাস এবং তার চেতনা উল্টো পথে হাটতে শুরু করল খুবই কার্যকর কিন্তু জনপ্রিয় ধর্মের অপব্যাখ্যা প্রচার করে; গুজবের বাহন ব্যাবহার করেইতো বংগবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ পর্যন্ত জারী করে ফেলল । প্রতিষ্ঠিত গনমাধ্যম ইত্তেফাকও লিখেছিল –রক্ষী বাহিনীর পোষাকে নেমেছে ভারতীয় সেনা! ফলে গুজব আর অসত্য খবরের প্রভাব কেবল ভয়ংকর নয়; গোটা একটা দেশকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যেতে পারে!
খুব অরাজনৈতিক কিন্তু মানবিক ছবির ভুল ব্যাখ্যাও সমাজে অস্থিরতা তৈরী করতে পারে ।এই সেদিনও মুগদা হাসপাতালের ওই ছবিটা নিশ্চয়ই মনে আছে –যেখানে হাসপাতালের পাশে উল্টো হয়ে পড়েছিলেন এক করোনা রোগী । যেন তিনি হাসপাতালের সামনের রাস্তার ফুলবাগানে মরে পড়ে আছেন–কেউ তার খবর রাখেনি । সংগে সংগে ছবিটি বহু অনলাইন ব্যাবহার করে ভাইরাল করে ফেলেছে ; বহু গুজবকারী ছবিটি ব্যাবহার করে বিদ্বেষ ছড়াতে কালক্ষেপন করেন নি । কিন্তু পরে জানা গেল –অসুস্থ করোনা রোগীর সহায়তায় এক সাংবাদিকই এগিয়ে এসেছিলেন ; পরের ছবিতেই তাকে দেখা যাচ্ছে ছেলেটিকে সুস্থ করতে তাকে পানি খাওয়াচ্ছেন ।
সবচে বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম ভিডিও এখন পুরো অসত্য উপস্থাপন করে ফেলতে পারে । সাম্প্রতিক বহু উদাহরন টেনে বলা যায় যেখানে আধা ভিডিও দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে জনতা ; কিন্তু মোবাইলে যেহেতু পুরো ঘটনা রেকর্ড হয়নি ফলে রেকর্ডেড অংশের অপরাধ দেখেই যে কোন ব্যাক্তি এখন সমাজের ভুল চোখে অপরাধী হয়ে উঠতে পারেন ।
এই্ সকল কারনেই আগের যে কোন সময়ের তুলনায় সাংবাদিকতা এখন সবচে বড় চ্যালেন্জের মুখোমুখি! এবং সেই চ্যালেন্জের প্রকৃত নাম –সত্যানুসন্ধ্যান! পপুলারিস্ট বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে সাংবাদিককেই প্রকৃত সত্য তুলে আনতে হচ্ছে । এটিই এখনকার সাংবাদিকতার একটা বড় শক্তিও । সোশ্যালে যখন বিপুল আইবল মানুষের মনোযোগে আধা তথ্য অসত্য তথ্য ঘুরছে-ভাইরাল হয়েছে –সেই একই কনটেন্ট গনমাধ্যম যদি প্রকৃত তথ্যে পূর্ণ করতে পারে তখনই সাংবাদিকতার কাছেই ফিরবে মানুষ। এবং এজন্যই এখনও বিশ্বাস করি প্রকৃত সাংবাদিকতা আসলে টিকে যাবে –তা যে মাধ্যমেই হোক!
তবে অসত্য তথ্য যদি বেশী বাজে বিশেষ করে সেইসকল শ্রেনী যারা –গুজব বিশ্বাস করতে বসেই আছেন তাদের সত্যে ফেরানোর কি উপায়? বিশেষ করে আমাদের দেশটা আজীবন এমনই রবে যে তীব্র বিপরীত মুখি জনতা বিপরীতমুখি বিশ্বাস নিয়ে পরস্পর বসবাস করবে! আমি মনে করি একটা বিপুল নলেজ গ্যাপ এর কারনে এই বিপরীতমুখী জনতা বেড়ে উঠেছে । কেবল সত্যানুসন্ধানী সাংবাদিকতাই যদি আঘাত করতে পারে তাহলেই এক সময় ভুল ইতিহাস ভুল রাজনীতির ফসলে বেড়ে ওঠা ভুল শাখা প্রশাখা একসময় কমে যেতে বাধ্য ।
বাক স্বাধীনতার দেশগুলোতে এই জ্ঞান বৈষম্য কমিয়ে আ্নতে রাষ্ট্রের উদ্যোগে থি্ংক ট্যাংক সোসাইটি জরীপ কিংবা গবেষনা সংস্থা গড়ে তোলা হয় । মিডিয়া তার নিজগুণেই তখন সেই সকল গুজব প্রশ্নে “সঠিক” তথ্য দিয়ে খবর তৈরী করে। এভাবেই ধীরে গুজব প্রশমিত হয়!
কিন্তু আমাদের দেশে পাল্টা তথ্যের সংগে গুজবকারীর বিরুদ্ধে বিশেষ করে যিনি ব্যাক্তি আক্রমন করছেন বা দেশের মৌলবিশ্বাসে আঘাত করছেন তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যাবস্থা একটা পর্যায় পর্যন্ত নিতেই হচ্ছে । কারন এর সামগ্রিক কুফল বাংলাদেশের মত দেশ এড়াতে পারছে না ।
সেজন্য হলোকাস্ট ডিনায়াল এর মত “মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস বিকৃতি রোধ” আইন প্রণয়ন এখন সময়ের প্রয়োজন । আর দেশের বাইরে থেকে যারা ভূল ইতিহাস কিংবা গুজব ছড়ায় তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করার একটা আইন আমাদের বাধ্য হয়ে চাইতে হচ্ছে । পৃথিবীর বহুদেশ ভিনদেশে স্বদেশী অপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে একটা আইন প্রণয়ন করেন যাতে ভিনদেশের সংগে অপরাধী ফিরিয়ে আনার চুক্তি করা যায় । গুগুল ইউটিউব এর কাছ থেকে তথ্য আনা বা গুজব চ্যানেল রিপোর্ট করার পথ তৈরী হয় ; সেই আইনেরও অভাব রয়েছে দেশে । তবে এসব কিছুর ওপর প্রকৃত সাংবাদিকতার সীমানা যদি সকল শাখায় সমান শক্তিতে ছড়িয়ে দেয়া যায়; সত্য খুব দুরে থাকে না ।
(রিপোর্টার্স ইউনিটির রজতজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে উপস্থাপিত)
মতান্তর এর আরও লেখা
![মানসম্মত টকশোর জন্য যা যা দরকার](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/mohammad-shahabuddin-20211023193514.jpg)
মানসম্মত টকশোর জন্য যা যা দরকার
![নিউ মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টিভিগুলোর করণীয়](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/mohammad-shahabuddin-20210915195215.jpg)
নিউ মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টিভিগুলোর করণীয়
![হলি আর্টিজান নিয়ে চলচ্চিত্র- জাতীয় ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/maliha-hasan-20210910165755.jpg)
হলি আর্টিজান নিয়ে চলচ্চিত্র- জাতীয় ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া
![আমি মারা গেলে আমার কবরে একটা টিনের চোঙ্গা রেখে দিস](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/nur-20210825112308.jpg)
আমি মারা গেলে আমার কবরে একটা টিনের চোঙ্গা রেখে দিস
![পনেরো আগস্ট : ষড়যন্ত্রের পথ ধরে জন্ম নেয়া ট্র্যাজিডি](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/maruf-rasul-02-20210815141600.jpg)
পনেরো আগস্ট : ষড়যন্ত্রের পথ ধরে জন্ম নেয়া ট্র্যাজিডি
![নির্বাসনে নৈতিকতা](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/tushar-abdulla-20210808180230.jpg)
নির্বাসনে নৈতিকতা
![সায়মন: সাদা লম্বা খাঁটি বাংলাদেশি!](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/towhidul-islam-20210726203156.jpg)
সায়মন: সাদা লম্বা খাঁটি বাংলাদেশি!
![](https://www.bjcnews.com/media/advertisement/ad300x250.png)