পনেরো আগস্ট : ষড়যন্ত্রের পথ ধরে জন্ম নেয়া ট্র্যাজিডি


পনেরো আগস্ট : ষড়যন্ত্রের পথ ধরে জন্ম নেয়া ট্র্যাজিডি

 

লেখাটির শিরোনাম কিছুটা সিদ্ধান্তমূলক মনে হলেও, এর বিষয়বস্তু প্রশ্নমূলক এবং উত্তর খোঁজার ধরনটি খানিক অনুসন্ধানধর্মী। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার সেই নৃশংসতম রাত্রির প্রেক্ষাপট তৈরির পিছনে কী কী ষড়যন্ত্র সক্রিয় ছিল, সেগুলো খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে এই লেখা প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেই নরপিশাচ হত্যাকারীদের নাম সকলেই জানি এবং দীর্ঘ সময় পর, নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে হলেও আইনের মাধ্যমে এই খুনীদের বিচারের কাজও সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু পনেরো আগস্ট এলেই ‘কয়েকজন বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা’ শব্দগুচ্ছের যে প্রয়োগ আমরা সরকারি-বেসরকারি নানা বক্তব্য-বিবৃতি, এমনকি গণমাধ্যমেও দেখতে পাই— এতে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়, অন্ধকারের শিকড়ে আলো ফেলতে আমাদের বড্ডো অনীহা। পনেরো আগস্টের সেই কুখ্যাত ষড়যন্ত্রের উৎস সন্ধানে আমাদের রাজনীতিবিদগণ গত কয়েক বছর ধরেই একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটির কথা বলে আসছেন। কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালেই সেই বক্তব্য হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

১৯৭৫-২০২১— এই ৪৬ বছরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নানা নথিপত্র পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কূটনৈতিক অপতৎপরতার দলিল, বিচার কার্যক্রমের সময় সাক্ষ্যদের বয়ান, এমনকি তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু গণমাধ্যমের নির্লজ্জ সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও এখন আর অবিদিত নয়। ফলে এই প্রশ্নটি স্বভাবতই সামনে চলে আসে— কেবলই ‘কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যের’ লাগামহীন বর্বতার কারণেই বাঙালি তার জাতির পিতাকে হারালো; নাকি তৎকালীন সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, বিচারালয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির নৃশংসতা ও গণমাধ্যমের হঠকারিতার সম্মিলিত অপপ্রয়াসের নাম ‘পনেরো আগস্ট, উনিশশো পঁচাত্তর’। আমি এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের চেষ্টাটিই করেছি এই নাতিদীর্ঘ লেখাটিতে।

মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ : দীর্ঘ ইতিহাসের ছোট্ট অবলোকন

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন প্রশাসন মুজিবনগর সরকারের ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালায়। আগ্রহ বাংলাদেশের দিক থেকেও ছিল। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন খন্দকার মোশতাক (১৯১৮-১৯৯৬)। খন্দকার মোশতাকের দূত হিসেবে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য কাজী জহিরুল কাইউমের মাধ্যমে এই যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চালানো অব্যাহত থাকে১। কিন্তু মুজিবনগর সরকার ঘটনাটি টের পেয়ে খন্দকার মোশতাককে নিষ্ক্রিয় করা হয়২। ১৪ সেপ্টেম্বর (১৯৭১) কাজী জহিরুল কাইউম মার্কিন দূতাবাসকে জানিয়ে দেন যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেখা করতে অপারগ। যোগাযোগের এই ব্যর্থতা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নথিতে উল্লেখ আছে এবং সেখান থেকে জানা যায়, যোগাযোগের আটটি সোর্স কার্যকর থাকলেও ‘effective’ কাউকে পাওয়া গেলো না৩। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন শেষ পর্যন্ত তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের কার্যকর লোকটিকে খুঁজে পায়। তার নাম খন্দকার মোশতাক। সেই উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের সময় সফল না হলেও, স্বাধীন বাংলাদেশে হয়েছিল।

স্বাধীন বাঙলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র

ষড়যন্ত্রের মূল ক্রীড়ানক কে হবে, তা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ই। স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু হয় তা বাস্তবায়নের পর্ব। সঙ্গে যুক্ত হয় জাতীয় রাজনীতি, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি আর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের দেশবিরোধী নীলনকশা। পরিস্থিতির দিকে আলোকপাতের জন্য প্রথমে রাজনৈতিক লেন্সেই চোখ রাখি। সে সময়ে সুনির্দিষ্টভাবে মওলানা ভাসানীর (১৮৮০-১৯৭৬) দুটো বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিটি অনুধাবন করা সম্ভব। প্রথমটি ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বদেশে ফেরার সময় আসামের ফকিরগঞ্জের একটি জনসভায় দেয়া— ‘মিসেস গান্ধীর মতো দয়ালু মহিলা হয় না। ভারতের জনগণের সহানুভূতির কথা ভুলবো না। স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্ম-নিরপেক্ষ, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে’৪। দ্বিতীয়টিও ১৯৭২ সালে, অক্টোবরের ০৭ তারিখে। সেখানে তিনি বলেন— ‘বাঙলাদেশের সংবিধান অবশ্যই কোরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে প্রণীত হবে’৫।

মাত্র ২৬৬ দিনে মওলানা ভাসানীর মতো অতো বড়ো নেতা যে কেবল আদর্শের প্রশ্নেই ইউ-টার্ন নিলেন, তা-ই নয়; বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত চৈনিকপন্থীদের ‘মহান নেতা’ও বনে গেলেন। মোহাম্মদ তোহা, আবদুল হক, আবদুল মতিন, দেবেন শিকদার, আলাউদ্দিন, শান্তি সেন প্রমুখ চীনপন্থী নেতাদেরও নেতা হয়ে উঠলেন মওলানা ভাসানী এবং ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমের ঘোষণা দিলেন। আবার ১৯৭২ সালের ০৮ জুলাই পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর আমন্ত্রণে তিনি পাকিস্তান সফরে যান। সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরে খবরের কাগজ মারফৎ জানা যায় যে, ভুট্টো ‘মুসলিম বাংলা’ (এই স্লোগানটি ভুট্টো প্রদত্ত, যা সে সময়ে পাকিস্তান রেডিও থেকে প্রচারিত হতো) প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা ভাসানীর সাহায্য কামনা করেছে৬। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে যেখানে প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক আদর্শভিত্তিক ঐক্য, সেখানে মওলানা ভাসানী পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করলেন— ‘আমি এদেশে প্রতিবিপ্লব ঘটাবো’৮।

স্বাধীনতার এক বছর যেতে-না-যেতেই মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও শেষ পর্যন্ত সংগঠনটির বিভক্তি জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ছাত্রলীগের এই বিভক্তি শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও ভাঙন তৈরি হয়। অবশেষে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ‘বিপ্লবে পরিপূর্ণতা প্রদান ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার স্লোগানে জাসদের আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়। ছাত্রলীগের সংকট আরও ঘনীভূত হয় যখন পাকিস্তানপন্থী ও আইয়ুব-ইয়াহিয়ার বিশ্বস্ত চর গমিরুদ্দিন প্রধানের ছেলে সফিউল আলম প্রধান ছাত্রলীগের সভাপতি হয়। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে সাতজন শিক্ষার্থীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো।

অন্যদিকে চিনপন্থী দলগুলো কখনও ‘স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ’ কখনও ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ আবার কখনও ‘মুসলিম বাংলা’র স্লোগান তুলে চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে থাকে দেশের নানা প্রান্তে৯। দেশের জাতীয় সম্পদ পাটের গুদামে একের পর এক আগুন লাগানো হয়। ১৯৭৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক নির্মিত ঘোড়াশাল সার কারখানার কন্ট্রোল রুমটি উগ্রবাদীরা বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। এতে ক্ষতি হয় প্রায় ১৫০ মিলিয়ন টাকা। দশমাস পর্যন্ত এই কারখানা উৎপাদনে অক্ষম থাকে। ফলে এক লক্ষ টন সারের ঘাটতি তৈরি হয়। এই ঘাটতির প্রভাব পড়ে খাদ্য উৎপাদনের ওপর১০।

গুজবের অপরাজনীতি গণমাধ্যম

আমার মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে এই গুজব ও তৎকালীন বেশ কিছু গণমাধ্যমের নীতিহীন সাংবাদিকতা। এনায়েতুল্লাহ খানের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে (The Holiday) তখন নানা ধরনের মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন শুরু করেছিল। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে দুই দেশের মধ্যে ২৫ বছরের জন্য পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সহায়তা ও সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি প্রকাশ্য চুক্তিকে হলিডে পত্রিকা ‘গোপন চুক্তি’ বলে চালিয়েছে। তাছাড়াও অর্থনীতি ও দেশের মুদ্রানীতি নিয়েও তাদের মিথ্যাচারের অন্ত ছিল না। সে রকমই একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তানের নোট অচল ঘোষণায় মাত্র ৫ দিন সময় দেয়া হলো। আর ভারতীয় নোট প্রত্যাহারের জন্য ১ মাস ১৫ দিন!’ এই সংবাদের পর হলিডে মারফৎ গুজব রটে গেলো, বঙ্গবন্ধু সরকার ভারত সরকারকে যে পরিমাণ নোট ছাপাতে দিয়েছিল ভারত সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে দেবার জন্য তার দ্বিগুণ নোট ছাপিয়েছে। বঙ্গবন্ধু সরকার ভারতীয় নোট প্রত্যাহারের জন্য এক মাস সময় দিল।

হলিডের এই মিথ্যাচারের জবাব তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দিয়েছিলেন— ‘পাকিস্তানের টাকার ব্যাপারটা হলো ডিমনিটাইজেশন আর ভারতের টাকার ব্যাপারটা হলো উইথড্রয়াল। প্রথমটা হলো নির্দিষ্ট তারিখের পর অচল ঘোষণা আর পরেরটা হলো ভারতীয় নোট প্রত্যাহার করে নেয়া। ভারত থেকে ৩৫০ কোটি টাকার নোট ছাপানো হয়েছে। সত্যিই ভারত এর বেশি ছেপেছে কি না, আমরা জানতে চাই। লম্বা সময় দিলাম, যেন সমস্ত নোট জমা হতে পারে। তাহলে প্রকৃত অবস্থাটি বুঝতে পারবো’১১।

১৯৭৩ সালের ৩১ মে ভারতের মুদ্রিত টাকা জমাদানের তারিখ অতিবাহিত হবার পর দেখা গেলো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মূলত ইস্যুকৃত মোট অঙ্কের চাইতে ৫৩ লক্ষ ৫৪ হাজার ৪৮০ টাকা কম জমা পড়েছে। দ্বিগুণ নোট ছাপা তো দূর অস্ত!

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই ১৯৭৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী ও সদস্যদের বিতর্ক থেকে। সংসদ সদস্য জনাব আব্দুল কুদ্দুস মাখন সেদিনের অধিবেশনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন— ‘পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ আসলাম এখন কোথায়?’। অনুসন্ধানে জানা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন পিপল্স পার্টি গঠন করে, তখন আসলাম নামের এক উর্দুভাষী সাংবাদিকের আবির্ভাব ঘটে। যুদ্ধকালে সে বাংলাদেশেই ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল তখন পার্লামেন্টে জানান— ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে আসলাম বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

বলাইবাহুল্য, এই পাকিস্তানি চর ছিল হলিডে পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। কেননা, পার্লামেন্টে এই বিতর্ক উত্থাপনের দুদিন পর (৩০ সেপ্টেম্বর) এনায়েতুল্লাহ খান ‘পার্লামেন্টে এসব ননসেন্স থামানোর জন্য’ প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন করে একটি লেখা প্রকাশ করে। সেখানে অবশ্য স্বীকার করে যে— আসলাম একজন পাকিস্তানি এবং হলিডে পত্রিকায় কর্মরত ছিল১২।

১৯৭২-৭৫ বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সাপ্তাহিক হলিডে যতখানি প্রকাশ্যে অপ-সাংবাদিকতা করেছে, দৈনিক ইত্তেফাক ততখানি করেনি বটে; কিন্তু ওই সময়ের ইত্তেফাক যে কোনোভাবেই আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইত্তেফাক নয়, সেটা মন দিয়ে ইত্তেফাকের সংখ্যাগুলো পড়লেই বোঝা যাবে। অন্তত একটি প্রমাণ তো উল্লেখ করাই যায়। ‘স্পষ্টভাষী’ ছদ্মনামে দৈনিক ইত্তেফাকে তখন কলাম লিখতো খন্দকার আব্দুল হামিদ। একই ব্যক্তির উপ-সম্পাদকীয় আমরা পাই তৎকালীন দৈনিক আজাদে ‘মর্দে মুমীন’ ছদ্মনামে। এ দুটি উপ-সম্পাদকীয়তেই কী পরিমাণ সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানো হয়েছে, তা আগ্রহী যে কেউ পত্রিকাগুলো পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন। খন্দকার আব্দুল হামিদ ছিল আইউব আমলে মৌলিক গণতন্ত্রী, মুসলিম লীগের ও মোনায়েম খানের সমর্থক। ইয়াহিয়া খানকেও সমর্থন দিয়েছিল। ফলে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও সে বেরিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এই ব্যক্তিটিই বাঙালি জাতিসত্তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য জিয়াউর রহমানের আমলে ‘বাঙালি’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী’ তত্ত্বটি উদ্গীরণ করে।

 

 

দৈনিক ইত্তেফাকের স্পষ্ট রূপটি আমরা পাই ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ উল্লেখ করে তারা সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পটভূমিকায় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ

স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন বাঙালি সি.এস.পি অফিসারের সংখ্যা ছিল ১৮০ জন এবং ই.পি.সি.এস অফিসারের সংখ্যা ছিল ৯৫০ জন। এ কথা তো এখন আর আমাদের অজানা নয় যে, বাঙালি ১৮০ জন সি.এস.পি অফিসারের মধ্যে মাত্র ১৩ জন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগদান করেছিলেন। অন্য অফিসারদের মধ্যে পি.এস.পি’র দুইজন অফিসার এবং ই.পি.সি.এস-এর হাতে গোনা কয়েকজন অফিসারসহ হিসেব করলে দেখা যায়, সর্বস্তরের মাত্র ৫০০ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

ড. মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রশাসন ও চাকুরির পুনর্বিন্যাস কমিটি প্রাক্তন সি.এস.পি সিস্টেমকে ‘আর্টিফিশিয়াল ইনিস্টিটিউশন’ নামে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী সরকারি অফিসারদের বড়ো বড়ো পদ প্রাপ্তির প্রথা ও নিয়ম বাতিল করে দেয়১৩। ফলে ১৯৭২ সাল থেকেই তারা নানাবিধ ষড়যন্ত্র শুরু করে।

এই কোণঠাসা হয়ে পড়া পাকিস্তানপন্থী আমলাদের মূল পরামর্শদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল শফিউল আযম। সি.এস.পি অফিসার হিসেবে তার বেশ নামডাকও ছিল। ১৯৪৯ সালে সি.এস.পি পরীক্ষায় সমস্ত পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের দালালিও করেছিল। চাকুরি না থাকায় সে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশবিরোধী সি.এস.পি অফিসারদের গোপনে সংগঠিত করতে থাকে১৪।

অজানা কারণে জেনারেল টিক্কা খান আর পাকিস্তান আমলের গভর্নর ডা. মালেকের স্টেনোগ্রাফার রোজারিও গণভবনে বহাল থাকলো। ফলে দেশের আভ্যন্তরীণ নানা খবর বিদেশে অতিরঞ্জিত হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো।

স্বাধীন দেশে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলিজেন্স বা এন.এস.আই-এর পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া এ.বি.এস সফদরকে এবং প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েট প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো আবদুর রহিমকে। দুজনেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ওয়াশিংটনের আমেরিকান পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিল এবং পাকিস্তান সামরিক জান্তার অধীনে চাকুরিতে যোগদান করেছিল। সফদর পাকিস্তান সামরিক জান্তার অতি বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে ১৯৭০ সালে কেন্দ্রীয় ইনটেলিজেন্সির পূর্ব-পাকিস্তানের দায়িত্ব পেয়েছিল১৫, যেমন আবদুর রহিম ছিল রাজাকার বাহিনী পরিচালনার দায়িত্বে১৬।

আর সামরিক প্রশাসনের নানা নথিপত্র এখন পাওয়া যাচ্ছে। আমি শুধু এটুকুই উল্লেখ করতে চাই যে, ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানদের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার। এর মধ্যে পাকিস্তানের প্রত্যাগত জওয়ানদের সংখ্যা ২৪ হাজার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ান ও মুক্তিযুদ্ধে নতুন করে রিক্রুটদের মিলিয়ে সর্বমোট সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারের সংখ্যা ছিল ১১০০। পাকিস্তান প্রত্যাগত জওয়ানদের সিংহভাগই ছিল ভারত বিদ্বেষী এবং মুক্তিযুদ্ধ-বৈরী মুসলিম বিশ্বের প্রতি অনুরক্ত১৭।

আমি একটি বৃহৎ নীল নকশার খুব সামান্য অংশ এখানে আলোচনা করতে পেরেছি। ১৫ আগস্টের নৃশংসতার পর বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেও কাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, কীভাবে রাতারাতি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের চেহারা বদলে গিয়েছিল— সেগুলোর অনুপুঙ্খ আলোচনায় বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তাছাড়া প্রশাসনের দাপ্তরিক নথিগুলোর পর্যালোচনাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে সরকারের সদিচ্ছা এবং উদ্যোগ প্রয়োজন। কোনো ব্যক্তির পক্ষে এককভাবে এই কাজগুলো করা সম্ভব নয়।

তাই প্রতি বছর আগস্টের শোকাবহ সময়ে ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা যে স্বাধীন তদন্ত কমিটির কথা বলে থাকেন, তাকে কাজে বাস্তবায়ন করা খুব জরুরি। তবেই ইতিহাসের অনাবিষ্কৃত দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

মারুফ রসূল, লেখক, ব্লগার

 

তথ্যসূত্র

১. Kissinger, Henry, "Contacts with the Bangladesh Exiles", White House Years, Little, Brown and Company, 1979, New York, pp. 869-73.

২. চৌধুরী, আফসান, বাংলাদেশ ১৯৭১, চতুর্থ খণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৭, ঢাকা, পৃ. ৪০৭

৩. The Carnegie Papers, Winston Lord, Kissinger's Director of Planning, National Security Council.

৪. P.T.I Report, 22 January 1972.

৫. Morning News, Dhaka, 08 October 1972.

৬. The Statesman, Calcutta, 15 July 1972.

৭. দৈনিক বাংলা, ঢাকা, ২৪ আগস্ট ১৯৭২।

৮. দৈনিক বাংলা, ঢাকা, ২৪ আগস্ট ১৯৭২।

৯. Lifschultz, Lawrence, Bangladesh: The Unfinished Revolution, Zed Press, 1979, London, p. 22.

১০. Blackburn, Robin (ed.), Explosion in Sub Continent: India, Pakistan, Bangladesh and Ceylon, Penguin Books, 1975, London, p. 316.

১১. মোহাইমেন, মোঃ আব্দুল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, প্রথম খণ্ড, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ১৯৮৪, ঢাকা, পৃ. ৯-১০।

১২. The Holiday, Dhaka, 30 September 1972.

১৩. Maniruzzaman, Talukder, Group Interests and Political Changes Studies of Pakistan and Bangladesh, Sucheepatra, 1982, p. 203.

১৪. সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু, ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, চারুলিপি, ১৯৮৬, ঢাকা, পৃ. ৯১।

১৫. করিম, জাওয়াদুল, “মুক্তিযোদ্ধাদের না বলা কথা”, সাপ্তাহিক ছুটি, ২২ মার্চ ১৯৮৫, পৃ. ০৭।

১৬. Bikramaditya, Confidential Dairy, Cosmos, 1981, Calcutta, p. 54.

১৭. Maniruzzaman, Talukder, ibid, pp. 236-37.