হটাৎ আসা ঝড় !


হটাৎ আসা ঝড় !

ঠিক জানা ছিলো না কি হতে চলেছে। ইউরোপ আমেরিকার খবরে চারপাশে শুধু ভয় আর আতংক। দেশে তখনও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি। জারি হয়নি স্বাস্থ্যবিধিও। ৬ মার্চ ২০২০। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বিজেসির দ্বিতীয় সম্প্রচার সম্মেলন চলছে। সম্মেলন কেন্দ্রের সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। বলা যায় বিজেসি’র কভিড সচেতনতা কার্যক্রমের শুরু এখান থেকেই। তার একদিন পর ৮ মার্চ ঘোষণা এলো দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের। তার দশদিনের মাথায় প্রথম মৃত্যু। কিন্তু ততদিনে বিজেসি তার সংকল্প চুড়ান্ত করে ফেলেছে। পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক, তথ্য দিয়ে জনগনের পাশে দাঁড়াতে, তাকে সচেতন করে তুলতে সংবাদকর্মীকে তার কাজ করে যেতেই হবে। আর কাজে নেমে মহামারীর ঝুঁকিতে থাকা সংবাদকর্মির পাশে দাঁড়াবে বিজেসি।

সুরক্ষা

মার্চের মাঝামঝি। বাজারে তখন দুষ্প্রাপ্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার। চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে মাস্ক। আফজালুর রহমানকে বুয়েটে পাঠানো হলো হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানানোর প্রক্রিয়া শিখে আসতে। চকবাজার থেকে কাঁচামাল আর বোতল কিনে এনে প্ল্যানার্স টাওয়ারে বিজেসির কার্যালয়েই শুরু হয় স্যানিটাইজার বানানোর কার্যক্রম। এরমধ্যেই চেষ্টা চললো মাস্ক আর পিপিই সংগ্রহের। পাওয়াও গেলো। চটজলদি স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ, ওয়াশেবল মাস্ক পৌঁছানো হলো সদস্যদের কাছে। বার্তা প্রধানের মাধ্যমে প্রতিটি হাউজে গেলো পিপিই, হ্যান্ডওয়াশ, সেনিটাইজার, হ্যান্ডগ্লাভস। মে মাসে আরেকদফা বিতরণ করা হয় সুরক্ষা সামগ্রী। ২৬টি টেলিভিশন চ্যানেলে শুধুমাত্র মাস্ক বিতরণ করা হয় ৭ হাজার ৮শ’টি এবং পিপিই বিতরণ করা হয় ১ হাজার ৭ শ’টি।

ঝুঁকি

শুধু সরক্ষা সামগ্রী নয়, বিজেসি এই সময়ে ভাবলো কর্মীদের সংক্রমন ও চাকুরি ঝুঁকি নিয়েও। ২১ মার্চ জারি হলো টেলিভিশন কর্মিদের জন্য করোনাকালীন বিজেসির নির্দেশিকা। ৩১ মার্চ সরকার ও টেলিভিশন মালিকদের কাছে বিজেসির পক্ষ থেকে দাবি তোলা হলো করোনা পরিস্থিতিতে সবধরনের ছাঁটাই বন্ধের। সেইসাথে বেতন নিয়মিত করা, বকেয়া পরিশোধ’সহ পেশার নিরাপত্তা-সুরক্ষা নিশ্চিতের কথাও বলা হলো। এই দাবি নিয়ে ১১ এপ্রিল বিজেসির নেতৃবৃন্দরা দেখা করলেন তথ্য মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে তার বাসভবনে। ’করোনায় সম্প্রচার কর্মিদের সুরক্ষা’ শিরোনামে বিজেসির আয়োজনে ওয়েব সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় ৪ এপ্রিল। অনলাইনে যার ভিউ ছিলো প্রায় ২০ হাজার। শেয়ার হয় একশোরও বেশি। ওয়েব সেমিনারটিতে টেলিভিশনের বার্তা প্রধানরা ছাড়াও অংশনেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎস। কারিগারী সহায়তায় ছিলো এমআরডিআই।

টেলিমেডিসিন

করোনার শুরুতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। হাত গুটিয়ে নেন অনেক চিকিৎসক। স্বাস্থ্য পরামর্শ পাওয়া তখন অনেকটাই দুষ্কর হয়ে উঠে। সম্প্রচার কর্মীদের আসন্ন বিপদের কথা ভেবে খুব দ্রুতই টেলিমেডিসিন সেবা চালুর সিদ্ধান্ত নিলো বিজেসি। মার্চের শেষে (২৮ মার্চ) বিজেসির জন্য আশীর্বাদ হয়ে এলেন ডা. সালেহ আহমেদ তুষার এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান অলওয়েল ডটকম। লকডাউনের সেই ভয়াবহ সময়ে ডা. তুষার একাই যেনো রক্ষাকবচ হয়ে উঠলেন। আতংক কাটলো। সম্প্রচার কর্মি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা থাকলো সুরক্ষায়। শুধু সম্প্রচার কর্মি নয় গনমাধ্যমের অন্যান্য শাখার মানুষরাও সেবা পেলেন অলওয়েল ডটকম ও ডা. তুষারের। বিজেসির টেলিমেডিসিন কার্যক্রম এখনো চলছে।

বাজার কর্মসূচী

মার্চের শেষে লকডাউন শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় সবকিছু । সম্প্রচার কর্মিদের ছুটি নেই। তারা কাজে বাইরে যাচ্ছেন, কেউ কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন। পরিস্থিতি ক্রমশই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। সিদ্ধান্ত হলো যাদের প্রয়োজন, তাদের ঘরে ঘরে বাজার পৌঁছে দেয়া হবে। হুলুস্থুল করে কাজে নেমে পরলেন একদল কর্মি। বিজেসি কার্যালয়ে বসেই তৈরী হলো বাজার কর্মসূচীর প্যাকেট। তাতে  থাকলো ১০ কেজি করে চাল, ৫ কেজি আলু, ২ লিটার সয়াবিন তেল, ২ কেজি মসুর ডাল, ২ কেজি আটা, ১ কেজি লবন এবং ১ কেজি চিনি। এপ্রিল আর মে মাস জুড়ে প্রায় ৪’শ সদস্যের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হলে ‘বিজেসি শুভেচ্ছা নিত্যপণ্য বাজার সদাই’। অগ্রাধীকার দেয়া হলো করোনা আক্রান্ত ও হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা সদস্যদের। পাশপাশি গুরুত্ব পেলেন তারা, যাদের হাউজে নিয়মিত বেতন হচ্ছে না।

করোনা টেষ্ট সেন্টার

এপ্রিলে সস্প্রচার কর্মিরা একের পর এক আক্রান্ত হতে থাকলেন। ওদিকে আবার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সরকারি সেন্টারে কভিড টেস্ট করা নিয়েও বিড়ম্বনা দেখা দিলো। প্রতাশ্যার চাপ বাড়তে থাকলো বিজেসি উপর। প্রথমদিকে ব্যাক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আক্রান্তদের টেস্ট করতে পাঠানো হলো সরকারি হাসপাতালে। যখন বোঝা গেলো এতেও কুলোবেনা, তখন কভিড টেস্ট সেন্টার করার উদ্যোগ নিলো বিজেসি নিজেই। ১২ মে মহাখালি কমিউনিটি সেন্টারে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের জন্য চালু হলো বিজেসির টেষ্ট সেন্টার। ল্যাব, কিট, টেকনিশিয়ান দিয়ে সহায়তা করলো গাজী গ্রুপ। ভ্যানু দিলো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ব্যবস্থাপনায় থাকলো অলওয়েল ডটকম। কার্যক্রমটি এখনো চলছে।

হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা

টেলিমেডিসিন এবং করোনা টেস্ট সেন্টার চালুর পর প্রশ্ন আসলো জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবা এবং হাসাপাতালে ভর্তির নিশ্চয়তার। এই সংকটেরও দ্রুত সমাধান করলো বিজেসি। জরুরী প্রয়োজনে সার্বক্ষনিক সেবা দেয়ার জন্য ২৪ মে পাথওয়ে অ্যাম্বুলেন্স সেবার সঙ্গে বিজেসির সমঝোতা চুক্তি হয়। এর আওতায় পরবর্তী তিন মাস বিজেসির সদস্য, তাদের পরিবার ও টেলিভিশনে কর্মরতরা বিনামূল্যে হাসপাতালে যাওয়া আসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স সেবা পেয়েছেন। তার আগে ৫০ শয্যা সংরক্ষণ রেখে বিজেসি’র সঙ্গে যুক্ত হয় হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল। কভিডকালে এই হাসপাতালেই পাঠানো হয় বেশিরভাগ আক্রান্তদের। এছাড়াও রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালে উন্নত চিকিৎিসার জন্য পাঠাতে হয়েছে অনেক সম্প্রচার কর্মি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের।

প্লাজমা সাপোর্ট সেন্টার

করোনা আক্রান্ত ব্যাক্তির প্লাজমা পেলে জীবন রক্ষা পেতে পারে আক্রান্ত আরেকজনের- বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লাজমা চিকিৎসার সাফল্যের খবরকে পুঁজি করে দেশে একদল চিকিৎসকের সহায়তায় প্লাজমা সেন্টার করার উদ্যোগ নেয় বিজেসি। ২৭ জুন, উদ্বোধন করা হয় প্লাজমা সাপোর্ট সেন্টার। করোনা মহামারির দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মহতী ইচ্ছা নিয়ে প্লাজমা সাপোর্ট সেন্টারের এই উদ্যোগে অংশিদার হয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, শেখ হাসিনা প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ণ ইন্সটিটিউট, গাজীগ্রুপ কোভিড ১৯ টেস্ট সেন্টার, স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধন, সবাই মিলে সবার ঢাকা, ওলয়েল ডট কম এবং ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার, বিজেসি।

সচেতনতা কার্যক্রম

এসবের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব ব্যবহার হরে সচেতনতা কার্যক্রমের আওতায় বিজেসির প্রচার কার্যক্রম শুরু হয়। গণমাধ্যম কর্মিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মহামারিকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনের বিস্তারিত তুলে ধরাই ছিলো এই আয়োজনের মুল উদ্দেশ্য। ২০ জুন প্রথম ফেইসবুক লাইভের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় বিজেসি’র এই কার্যক্রমের।

করোনাকালের সামনের কাঁতারে যেসব পেশার মানুষ ছিলেন, সংবাদকর্মী তাদের মধ্যে অন্যতম। তথ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলার পাশপাশি, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার গলদগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে মহামারিতে বড় ভুমিকা পালন করে প্রতিটি সংবাদকর্মী। দিনশেষে তার মূল্যায়ন কতটা হয় সেটি একটি বড় প্রশ্ন যদিও, তবু বিজেসি মনে করে- কে পাশে থাকলো, কে থাকলো না সেটি নিয়ে না ভেবে, নিজেদের কথা নিজেদের বলতে হবে, নিজেদের সংকটের সমাধান, নিজেদের করতে হবে। জয়তু বিজেসি।

লেখাঃ মানস ঘোষ, ট্রাস্টি, বিজেসি