হলি আর্টিজান নিয়ে চলচ্চিত্র- জাতীয় ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া


হলি আর্টিজান নিয়ে চলচ্চিত্র- জাতীয় ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া

 

সমসাময়িক সময়ে ভারতীয় চিত্রনির্মাতা হানসাল মেহতার ঘোষিত নতুন চলচ্চিত্র ‘ফারায’ কঠোর সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। চলচ্চিত্রটি ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে অবস্থিত ‘হলি আর্টিজান বেকারি হামলার ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে– যেখানে একটি জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলায় ২২ নিরীহ মানুষ নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়।

চলচ্চিত্র নির্মাণের সংবাদটি ইতোমধ্যে হামলায় নিহতদের পরিবার-পরিজনের কাছে অত্যন্ত বেদনার কারণ হওয়ায় তারা চলচ্চিত্রটির নির্মাণে কঠোর আপত্তি প্রকাশ করেছে। নির্মিত চলচ্চিত্রটি হামলায় নিহতদের আত্মত্যাগের প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করবে, পাশাপাশি পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে একটি চরমপন্থি রাষ্ট্র হিসেবে এটি বিশ্বের দরবারে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন করবে।

“সেই ভয়াবহ রাতের ঘটনাটি কোনো অবস্থাতেই আমাদের দেশ, আমাদের জাতি ও আমাদের ধর্মকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে না, বরং এরকম একটি ঘটনার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি মানুষের বিশ্বাসে বিরূপ ধারণার জন্ম দিবে যা সর্বোপরি আমাদের দেশের প্রতি অবিচার এবং দেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবে”- একজন নিহতের পরিবারের দাবী। ছবিটির প্রকাশিত টিজার ও নাম থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, যেখানে চলচ্চিত্রটি সেই রাতের ঘটনায় নিহত ‘ফারায’ কে কেন্দ্র করে নির্মিত– যিনি ঘটনার সময়ে তাঁর দুজন বন্ধু অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈনের সাথে ক্যাফেতে উপস্থিত ছিলেন। তারা তিনজন একই সাথে ঘটনার নির্মমতার শিকার হয়ে সেই রাতে প্রাণ হারান। অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈন-এর পরিবার চলচ্চিত্রটি নির্মাণ কাজ অনতিবিলম্বে বন্ধ করার জন্য নির্মাতা হানসাল মেহতা ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক নির্মাতাদের আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।

তারা বিবৃতি দেন যে, “সেই রাতের ঘটনা আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য শোকের কারণ, যা আমরা প্রতিনিয়ত বহন করে চলেছি। এরকম একটি ঘটনা যা জন মানুষের আবেগ ও অনুভূতিতে কঠিন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়, অবিলম্বে এর চিত্রায়ন চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিৎ”।

উপরন্তু, চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পূর্বে নির্মাতা এবং সংশ্লিষ্ট প্রডাকশন হাউজ –হামলায় নিহত ব্যক্তিদের কারো পরিবারের কাছ থেকে কোনো প্রকার সম্মতি গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। বিশেষত, অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈন-এর পরিবারের কাছ থেকে কোনো প্রকার অনুমতি গ্রহণ করা হয়নি – যেখানে তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এটির নির্মাণ অসম্ভব।

অবিন্তা কবিরের শোক সন্তপ্ত মা রুবা আহমেদ জানান, “এরকম একটি ঘটনা যা জাতিকে তারা স্তব্ধ করে তুলেছিল। এটির চিত্রায়ন কখনো কোনো অবস্থাতেই সমীচীন নয়”। তিনি আরো জানান, চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট প্রডাকশন হাউজটি হামলায় নিহতদের পরিবারের কাছ থেকে কোনো প্রকার বৈধ অনুমোদন গ্রহণ না করার মতো অসংবেদনশীল আচরণ – তাকে চরমভাবে হতাশ করেছে।

“নিহত ফারায’-কে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে এটাই স্বাভাবিক যে আমার মেয়ে (অবিন্তা কবির), তুলিকার মেয়ে (তারিশি জৈন) এবং ঘটনায় অন্যান্য নিহত সকলেই দৃশ্যপটে চলে আসবে। এটা কী করে সম্ভব হয় – যেখানে আমাদের মধ্যে থেকে কারো কাছেই সম্মতি চাওয়া হয়নি? এটি বাস্তব ঘটনার ওপর নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে, সুতরাং শুধু একজনের চরিত্র তুলে ধরতে গিয়ে, এটি কি বাকি ২১ জন নিহতদের করুণ বাস্তবতাকে তুচ্ছ করা নয় যারা একই ঘটনার শিকার? এটা কেমন মানবতা? অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈন-এর পরিবারবর্গ নির্মাতা মেহতা এবং অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছে সেই রাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো প্রকার শিল্পকর্ম নির্মাণ না করার জন্যে তাদের আপত্তি পেশ করেছেন।

নির্মাতাদের তারা অনুরোধ জানান, যাতে পরবর্তী সময়ে তারা এরকম কিছুর পুনরাবৃত্তি না ঘটান – যা তাদের এবং অন্যান্য নিহতদের পরিবারকে সেই ভয়াল রাতের স্মৃতিচারণ করতে বাধ্য করে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে ১৫ মার্চ ২০১৯ সালের গোলাগুলির ঘটনাটির ওপর ভিত্তি করে পরিচালক এন্ড্রু নিকল তাঁর “দেআরআস” নামক চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যেখানে একজন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীর হাতে ৫১ জন মুসলমান নিহত হওয়ার ঘটনাটি উঠে আসে।

এর খবর প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যেখানে তারা চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি সহ প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন, এমন একটি আপত্তিকর বিষয় নিয়ে নির্মাতাদের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য।

 
পরিচালক নিকল প্রতিবাদের জেরে চলচ্চিত্রটি স্থগিত করতে বাধ্য হোন এবং বিবৃতি দেন যে, “তাঁর এই উদ্যোগের কারণে নিহতদের পরিবারকে অনাকাঙ্খিতভাবে কষ্ট দেয়ার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করছেন”। একই মনোভাব মেহতা এবং ‘ফারায’ চলচ্চিত্রের সংশ্লিষ্ট অন্যদের কাছেও কাম্য। এমন একটি চলচ্চিত্র যার মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান, যা ইসলাম ধর্মকে অপ ব্যাখা করে এবং সর্বোপরি ১ জুলাই হামলায় নিহতদের আত্মত্যাগের স্মৃতির প্রতি অসম্মানজনক– এটি বিশ্ব দরবারে মুক্তির আগে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের দ্বারা এর পরিপূর্ন যাচাইকরণ অত্যাবশকীয়।
 
 
মালিহা হাসান, অবন্তি কবির ফাউন্ডেশন