মানসম্মত টকশোর জন্য যা যা দরকার


মানসম্মত টকশোর জন্য যা যা দরকার

 

২৩ অক্টোবর, টিভি টক শো সঞ্চালক দিবস। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় টিভি টক শো ' দ্য টুনাইট শো'- এর বিখ্যাত সঞ্চালক জনি কার্সনের জন্ম হয় এই দিনে ৷ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছর পালিত হয় এই দিবস। আজ আমরা দেখবো কীভাবে একটি টক শো নির্মাণ করলে সেটি সানন্দে গ্রহণ করবে দর্শক।

বাংলাদেশে ৩৭টি টেলিভিশন সম্প্রচারে আছে। টেলিভিশনগুলোতে নানারকম অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচারের ভিত্তিতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। মিক্সড চ্যানেল এবং নিউজ চ্যানেল।

মিক্সড চ্যানেলে অনুষ্ঠান ও সংবাদ দুটোই দেখানো হয়। নিউজ চ্যানেলে সারাক্ষণ নিউজ বা সংবাদ চলতেই থাকে। তবে এই চ্যানেলেও অনুষ্ঠান দেখানো হয়। সেসব অনুষ্ঠান সমসাময়িক ঘটনাবলি সংক্রান্ত।

মিক্সড ও নিউজ দুই চ্যানেলেই টকশো হয়। টকশোগুলো হয় সমসাময়িক কোন ঘটনা নিয়ে। তা হতে পারে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক কোনো ইস্যু। যুদ্ধ-বিগ্রহ আন্তর্জাতিক সমসাময়িক ঘটনাবলি। সরকারি বা বেসরকারি খাতে কোনো দুর্নীতি অনিয়ম তহবিল তসরূপ।

নিউজ চ্যানেলগুলোতে প্রতিদিনই থাকে টকশো। কোনটাতে আবার সপ্তাহে দুতিন দিন হয়। টকশো হয়না এমন টেলিভিশন হাতে গোনা। প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে টকশো হয়। বেশিরভাগই লাইভ। লাইভ টকশোগুলো রেকর্ড করে পুনঃপ্রচার করা হয়। মানসম্মত টকশো হলে দর্শক নিজ থেকে দেখে। প্রয়োজনে সার্চ করে দেখে।

বিবিসির হার্ডটক, সিএনএন-এর লেরি কিং লাইভ কিংবা ভারতের এনডিটিভির ওয়াক দ্য টক-এর নাম টিভি দর্শকরা কমবেশি জানেন। এই টকশোগুলো মানসম্মত। তাই সবাই খুঁজে বের করে দেখে।

বাংলাদেশের অনেক টকশোও মানুষ দেখে।  টকশোতে আসা অতিথিরা এক একজন এক এক রাজনৈতিক মতাদর্শের বলে রাজনৈতিক টকশোগুলোই বেশি দর্শকপ্রিয়তা পায়। 

টকশোগুলোতে আমরা দেখি ও শুনি আলোচনা, মতামত, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক, চ্যাটার তর্কবিতর্ক। নিজের কথার সত্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার পক্ষে প্রমাণাদিও উপস্থাপন করা হয়। এগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত টকশোর বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশের টকশোগুলোতে তেমনটা দেখা যায়না। শুধু আলোচনা তর্ক-বিতর্ক হয়। প্রমাণাদি খুব একটা উপস্থাপন করা হয়না। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ করেন।

সময় টিভি, বাংলাভিশন, ইটিভি, আরটিভি, এনটিভি, এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজ, চ্যানেল-২৪, চ্যানেল আই, ডিবিসি, বৈশাখী টিভি, মাছরাঙা টিভি, যমুনা টেলিভিশন, নিউজ-২৪, নাগরিক টেলিভিশন, ৭১ টিভি, এসএটিভি, এশিয়ান টেলিভিশন, দীপ্ত টিভি, দেশ টিভি, জিটিভি, বাংলা টিভি, মাই টিভি, মোহনা টেলিভিশনসহ আরো কিছু টেলিভিশনে আমরা নিয়মিত টকশো দেখি। 

ভালো মানের টকশো নির্মাণের জন্য উপস্থাপক, প্রযোজক, আলোচক মানসম্মত হতে হয়। আলোচক যদি দুর্বল হয় তাহলে টকশো ঠিক জমেনা।

টকশো মানে যুক্তিতর্ক সমস্যা চিহ্নিতকরণ সমাধানের পথ বাতলে দেয়া, ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে গাইডলাইন দেয়া, কোন একটা ঘটনা বা একজন ব্যক্তির আদ্যোপান্ত আলোচনা।

টকশো নানারকম হয়। বিষয়ভিত্তিক, সমসাময়িক বিষয়াবলিভিত্তিক, ব্যক্তিত্ব ও সেলিব্রেটি টকশো।

বিষয়ভিত্তিক টকশোগুলোর কোনো নির্ধারিত সময় থাকেনা। দিন সপ্তাহ বা মাসের যেকোনো সময় করা যায়।

সমসাময়িক বিষয়াবলিভিত্তিক টকশো সবসময় সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে হয়। প্রতিদিন ঘটে যাওয়া হাজারো ঘটনার মাঝথেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি বাছাই করে তার উপর চলে আলোচনা-সমালোচনা।

বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি সব টেলিভিশনেই ব্যক্তিত্ব টকশো হয়। এই টকশোতে একজন ব্যক্তির সাথে কথা বলা হয়। তার জীবনের নানা কথা ঐ ব্যক্তির মুখ থেকেই শোনা হয়।

তিনি স্টার বা তারকা নন কিন্তু সমাজের একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। সমাজ বিনির্মাণে তার আছে বিশেষ অবদান। সমাজ-সংস্কারক সমাজসেবক এই মানুষটি সম্পর্কে সবাই জানতে চায়। তাই টকশোর মাধ্যমে তার জীবনে খুঁটিনাটি তুলে ধরা হয়।

টকশোর মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় সেলিব্রেটি টকশো। এই টকশোতে সাধারণত একজন সেলিব্রেটির জীবনের নানা কথা, তার সেলিব্রেটি হয়ে ওঠার গল্প, সংগ্রাম, সাধনা সবই উঠে আসে। এই টকশোতে একজন সেলিব্রেটিকে উম্মোচন করা হয় দর্শক-শ্রোতার সামনে।

এই টকশোতে চলচ্চিত্র টেলিভিশন, বেতার, মঞ্চনাটক, গানসহ আরো অন্যান্য ক্ষেত্রে হয়ে ওঠা সেলিব্রেটিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কথা বলার সময় একজন উপস্থাপককে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ ধারণা থাকতে হয়। তার উপর গবেষণা করে বের করে আনতে হয় জীবনের নানা গল্প। উত্থান, পতন, সফলতা, ব্যর্থতা।

যেকোনো টকশোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি হলেন উপস্থাপক। একজন উপস্থাপকের কারণে টকশো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আবার উপস্থাপনার ব্যর্থতার কারণে টকশোটির ভরাডুবি হয়।

টকশোর অতিথি নির্বাচনও একটা বড় ব্যাপার। অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বুদ্ধি, বিবেক, বিচার বিশ্লেষণক্ষমতা খাটাতে হয়।

যে টকশোতে ডাক্তার আনা দরকার তাতে একজন ডাক্তারই আনতে হবে। ইঞ্জিনিয়ারের জায়গায় ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিকের জায়গায় রাজনীতিক, কবি-সাহিত্যিকের জায়গায় কবি-সাহিত্যিক আনতে হবে। সাংবাদিক, শিল্পি সবাইকে যার যার জায়গায় আনতে হবে। একজনের জায়গায় আরেক জনকে আনলেই গণ্ডগোল।

টকশোতে গবেষণার ব্যাপারটা খুব জরুরি। গবেষক দল উপস্থাপক ও অতিথি সবাইকেই যার যার ক্ষেত্র থেকে গবেষণা করতে হয়। গবেষণার মাধ্যমে বের করে আনতে হয় প্রয়োজনীয় সব তথ্য।

গবেষক দল গবেষণা করে সারকথাগুলো উপস্থাপককে দেয়। তিনি নিজের গবেষণার সাথে মিলিয়ে ঘটনা, ব্যক্তি বা সেলিব্রেটি সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানেন। প্রশ্ন তৈরি করেন। সম্ভাব্য উত্তর কী হতে পারে তা-ও চিন্তা করেন। এগুলো হলো একটা স্ট্যান্ডার্ড টকশোর কথা।

ব্যক্তিত্ব কিংবা সেলিব্রেটি টকশোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শুটিংয়ের কমপক্ষে এক/দুইদিন আগে প্রশ্ন পাঠাতে হয়। তিনি ঐ প্রশ্নগুলো স্টাডি করে উত্তর তৈরি করেন। কীভাবে উত্তরগুলো উপস্থাপন করবেন তা অনুশীলন করেন।

একজন উপস্থাপক সঠিকভাবে গবেষণা করে প্রশ্ন তৈরি করছে কী না তা বোঝা যায় তার আলোচনা শুনে। চেহারার ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া দেখে।

একটা টকশোর পিছনে থাকে অনেক মানুষ। অনেক শ্রম-ঘাম-সাধনা-সংগ্রাম। মেধা-মনন। টকশো ভালো হোক আর মন্দ হোক পিছনের এই মানুষগুলোকে শ্রম দিতে হয়। মেধা খাটাতে হয়।

একজন প্রযোজকের নেতৃত্বে থাকে একটা বিশাল দল। প্রযোজনা সহকারি, সহকারি প্রযোজক, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, লাইট ডিজাইনার, স্টুডিও সহকারি, ম্যাকআপ আর্টিস্টসহ আরো অনেকেই কাজ করেন নেপথ্যে। তাদের কাজের স্বীকৃতি না থাকলেও কাজটা করতে হয়। এই কাজের ভালো, মন্দ, সফলতা, ব্যর্থতাসহ সবরকম দায় নিতে হয় একজন প্রযোজককে।

বাংলাদেশের টকশোগুলোর উন্নয়ন ও দর্শকপ্রিয়তার জন্য দরকার ভালো মানের প্রযোজক, যাকে আমরা প্রকৃত অর্থেই বলতে পারি ‘ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ’।

ভালো ক্যাপ্টেনের অভাবে বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোর অনুষ্ঠান, নিউজ টকশো এসবের মানে কিছুটা ঘাটতি দেখা যায়।

আমাদের টকশোগুলোর প্রযোজকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমম্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। একজন প্রযোজক তার সৃষ্টিশীল প্রতিভা খাটিয়ে যখন একটা টকশো প্রযোজনা করে তখন তা মানসম্মত হতে বাধ্য। উপস্থাপক প্রযোজকের সহায়তা নিয়ে উপস্থাপনার মান বৃদ্ধি করতে পারবেন।

সহজ শব্দ, সহজ বাক্য ও সহজ বাক্যবন্ধ ব্যবহার করে প্রশ্ন লিখে আলোচককে শুধু প্রশ্নটা করতে হবে। উপস্থাপকের লম্বা প্রশ্নে দর্শক বিরক্ত হয়। কোনো কোনও উপস্থাপক প্রশ্ন-উত্তরের পর প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন না করে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেন। তার এই প্রশ্ন শুনে দর্শকরা হাসেন। উপস্থাপক কথা কম বলে আলোচককে বেশি কথা বলার সুযোগ দিলে দর্শক তা শোনে।

টকশোতে প্রবেশের আগে উপস্থাপক ও আলোচকের মাঝে অবশ্যই আলোচনা হওয়া উচিত। তা না হলে লাইভ টকশোতে দর্শক হতাশ হবে। দর্শক অনেক কিছুই জানতে চায়। এই জানানোর দায়িত্ব টকশোর সাথে জড়িত উপস্থাপক, আলোচক, প্রযোজক, টেকনিক্যাল টিমসহ সবার।

আমরা বিদেশি চ্যানেলে নানারকম টকশো দেখি। ঐসব আন্তর্জাতিক চ্যানেলের টকশোতে ব্যাপক গবেষণা, চিন্তা-চেতনা, শ্রম-ঘাম-মেধা খরচের ছাপ পাওয়া যায়। তাদের নির্মাণশৈলি, উপস্থাপন কৌশল, আলোচকের আলোচনা সবই আমাদেরকে মুগ্ধ করে। 

টকশোর ব্যাপ্তি ও দেখানোর সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ। একটা স্ট্যান্ডার্ড টকশোর ব্যাপ্তি হতে পারে সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট। পার্সনালিটি টকশো ২৫ মিনিট। সেলিব্রেটি টকশো ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। সময়টা মাথায় রেখে পরিমিতিবোধ খাটিয়ে টকশো নির্মাণ ও সম্প্রচার করলে তা অবশ্যই সফলতার মুখ দেখবে।

মানুষ অবসর সময় টকশো দেখতে চায়। তাই টকশোগুলো হওয়া উচিত রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে। বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোর জন্য এই সময়টা সুপার পিক আওয়ার। অধিকাংশ টেলিভিশনে টকশো দেখা যায় রাত ১১টার পর। কাজের মানুষ তখন ঘুমিয়ে যান।

টকশোগুলো যে বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে করা হয় সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আনাটাই উত্তম। একজন বিশেষজ্ঞ অতিথি সব বিষয়ে যেন বিশেষজ্ঞের মতামত না দেন। অর্থাৎ যিনি রাজনীতি বিশ্লেষক তাকে রাজনৈতিক বিষয়ক কথা বলার জন্যই ডাকতে হবে। যিনি সমর বিশেষজ্ঞ তাকে সমর বিষয়ক টকশোতে আনতে হবে। যিনি আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ তিনি আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়েই কেবল কথা বলবেন। এগুলো হলো নিয়মের কথা। আন্তর্জাতিক মিডিয়া এই নিয়ম মানে।

বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলো যদি সব নিয়ম মেনে স্মার্ট উপস্থাপক, আলোচক ও প্রযোজনা দলের সমম্বয়ে একটি স্মার্ট টকশো নির্মাণ করে তাহলে দর্শক অবশ্যই তা সানন্দে গ্রহণ করবে।

 

মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, গণমাধ্যমকর্মী, লেখক