পেগাসাসে আতংক


পেগাসাসে আতংক

বাংলাদেশে ‘পেগাসাস’ নামের সাথে পরিচিত কম বেশি সকলেই। তবে গ্রীক কল্পকাহিনীর ‘পেগাসাস’ আমাদের কাছে প্রায় অজানাই থেকে গেছে। ইসরায়েলভিত্তিক গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘এনএসও গ্রুপ’ আমাদেরকে আরও একবার পেগাসাসের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ করে দিয়েছে।

গ্রীক কল্পকাহিনী অনুযায়ী সাগর দানবী মেডুসা এবং ঘোড়ার দেবতা পসাইডনের সন্তান পেগাসাস। ধবধবে সাদা লোমে আবৃত পেগাসাস আসলে একটি ঘোড়া। তবে সাধারণ ঘোড়া থেকে পেগাসাস অবশ্যই আলাদা। কারণ পেগাসাসের ছিল দুটি ডানা; যা দিয়ে সে উড়তে পারে দিগবিদ্বিগ। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে উড়ে যাবার ধারণা দিয়েই হয়তো ইসরায়েলি এনএসও গ্রুপ স্পাইওয়্যার পেগাসাস তৈরির পরিকল্পনা করেছিল।

এনএসও-র তৈরি সফটওয়্যার পেগাসাস যা বর্তমানে যেকোন ফোনে প্রায় উড়ে গিয়ে জুড়ে বসার মতো কাজ খুব সহজেই করতে পারে। উড়ে গিয়ে জুড়ে বসতে পেগাসাসের প্রয়োজন শুধুমাত্র একটি উড়ো টেক্সট বা ফোন কল। মোবাইল ব্যবহারকারী টেক্সটি ওপেন করলে কিংবা ফোন কলটি রিসিভ করলেই পেগাসাস সয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইলটিতে ইন্সটল হয়ে যায়।

২০১৬ সালে পেগাসাসের প্রথম দিকের একটি সংস্করণের কথা গবেষকরা জানতে পারে। সেসময় নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির ফোনে বা মেইলে পাঠানো টেক্সটে একটা লিংক জুড়ে দেয়া হতো। সে লিংকে ক্লিক করলেই সেই ফোনটি তখন পেগাসাসের দখলে চলে যেতো। তবে এখন পেগাসাস ফোনে ইন্সটল হতে আর ক্লিক করারও প্রয়োজন হয় না। ফোনে ইন্সটলকৃত যেকোন সফটওয়্যারের ত্রুটি ব্যবহার করেই এটি এখন যেকারো ফোনে প্রবেশ করতে পারে। পেগাসাসের এমন শক্তির জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপ।

২০১৯ সালে হোয়াটসঅ্যাপের ত্রুটির সুযোগ নিয়ে এনএসওর সফটওয়্যার ১৪০০ ফোনে ম্যালওয়ার পাঠিয়েছিল। সেজন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তির ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে শুধু একটি কল করা হত। আর ওই কলের মধ্য দিয়েই ব্যবহারকারী অজান্তেই পেগাসাসের কোড ফোনে ইনস্টল হয়ে যায়।

কারিগরিভাবে পেগাসাসের কাজ নিয়ে গবেষণা করা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্লিন ভিত্তিক সিকিউরিটি ল্যাবের গবেষক ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি জানান, ফোন আক্রান্ত হলে, তার পক্ষে সেটা বোঝা খুবই কঠিন। সাধারণত ফোন কেনার সময় থাকে এরকম কোনো সফটওয়্যার, যেমন আইমেসেজ, অথবা খুব জনপ্রিয় কোনো সফটওয়্যার যেমন হোয়াটসঅ্যাপ- এসব সফটওয়্যারের কোডিংয়ের ত্রুটি খুঁজে বের করে এনএসওর মত কোম্পানিগুলো। কারণ তাতে একসঙ্গে বহু ফোনে স্পাইওয়্যার ছড়ানোর সুযোগ মিলে যায়। এ ধরনের ক্ষেত্রে ফোনের মালিক স্পাইওয়্যারবাহী মেসেজে ক্লিক না করলেও তার ফোন ‘হ্যাকড’ হয়ে যায়।

আপাতত আবার গ্রীক পেগাসাসের কাছে ফিরে যাই। সুঠাম দেহী পেগাসাস ছিল খুবই শক্তিশালী। জীবনের পুরোটাই পেগাসাস কাজ করেছিলো মেডুসার হত্যাকারী আধা মানব আধা ঈশ্বর পারসিয়াস এবং অসংখ্য দৈত্য-দানব হত্যাকারী বিখ্যাত বীর বেলারোফোনের বাহন হিসেবে। হারকিউলিসের জন্মের পূর্বে পারসিয়াস ও বেলারোফোন ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত এবং পরিচিত যোদ্ধা। এসব বিখ্যাত যোদ্ধাদের বহন করেই নিজের সুনামের জানান দিয়েছিল পেগাসাস।

স্পাইওয়্যার পেগাসাসও এক ধরনের বাহন। সহজভাবে বললে তথ্য পাচারের বাহন। যখন কোন ফোনে পেগাসাস ইন্সটল হয়ে যায় তখন সম্পূর্ণ ফোনের নিয়ন্ত্রণই পেগাসাসের হাতে চলে যায়। ধরা যাক আপনার ফোনে পেগাসাস ইন্সটল হয়ে আছে। এখন এটি আপনার ফোনে আসা ম্যাসেজ, ফোনে তোলা ছবি এবং ভিডিও সবকিছুই কপি করে সে পাঠিয়ে দিবে আক্রমণকারী বা হ্যাকারের দেয়া নির্ধারিত জায়গায়। শুধু এতোটুকুই না, ফোন কলে হওয়া কথা বার্তা রেকর্ড করা, ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে গোপনে ভিডিও ধারণ করা এমনকি ফোনের মাইক্রোফোনকে ব্যবহার করে সামনাসামনি কোন ব্যক্তির সাথে আপনার কথোপকথনও রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিতে পারে এটি। একই সাথে আপনার অবস্থান, আপনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন, ক্যালেন্ডার, কন্টাকলিস্ট সবকিছুই রেকর্ড করে রাখে এই শক্তিশালি স্পাইওয়্যার সফটওয়্যার।

গ্রীক পেগাসাসকে সবাই সহজে বস করতে পারতো না। পারসিয়াস কাস্তে দিয়ে দানবী মেডুসার মাথা কেটে ফেললে মেডুসার গলা দিয়ে ঝরা রক্তের ধারা থেকেই পেগাসাসের জন্ম হয়। মেডুসাকে হত্যার পর তার দুই বোন পার্সিয়াসকে ধাওয়া করলে পেগাসাস পারসিয়াসকে নিরাপদে সড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে বীর বেলারোফোন একদিন ঘুমের মধ্যে দেখলেন বিদ্যার দেবী এথেনা তার সামনে একটি স্বর্ণের লাগাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘুম ভাঙ্গতেই দেবী এথেনাকে না পেলেও স্বর্ণের লাগাম ঠিকই পেলেন বেলারোফোন। এই লাগাম নিয়ে পেগাসাসকে পরিয়ে দিলে তবেই পেগাসাস বস মানলো বেলারোফেনের। পরবর্তীতে বেলারোফেন পেগাসাসকে নিয়ে ভয়ংকর প্রাণী কাইমেরাকে হত্যা করেন।

স্পাইওয়্যার পেগাসসকেও সবাই আসলে ব্যবহার করতে পারে না। ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের দাবী সন্ত্রাসবাদ নিয়ে অনুসন্ধান ও বৈশ্বিক অপরাধ প্রতিরোধের মাধ্যমে হাজারো মানুষকে রক্ষায় করতে বিভিন্ন দেশের সরকারী সংস্থাকে সহায়তা করতেই এটি বানিয়েছে তারা। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোই এই হ্যাকিং প্রযুক্তির প্রধান ক্রেতা বলেও দাবি করছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির মানবাধিকারবিষয়ক নীতি অনুযায়ী পেগাসাস ব্যবহার করে যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন করা না হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখবে তারা।

কিন্তু যতোটা বলা হয় ততোটা কী করা হয়?  ২০১৯ সালে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যে ১৪০০ ফোনে স্পাইওয়্যারটি পাঠানো হয়ে তার মধ্যে বেশ কয়েকজন ভারতীয় নাগরিকের ফোনও হ্যাক করা হয়েছিল। সেসব ভারতীয়দের মধ্যে কংগ্রেসের প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা, এনসিপি-র প্রফুল্ল পটেল, ভীমা কোরেগাঁও মামলার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সমাজকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিকরা অন্যতম। এভাবে তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বাধীনতা লঙ্ঘন করা হয়েছিল।

গ্রীক পেগাসসকে পেয়ে বেলারোফেন চেয়েছিল দেবতাদের বাসস্থান অলিম্পাসের দিকে যেতে। কিন্তু দেবতারা তার ওপর রুষ্ট হওয়ায় অলিম্পাসে যেতে পারেনি বেলারোফেন। তবে পেগাসাস ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল অলিম্পাসে। সেখানে গ্রীকদের প্রধান দেবতা জিউসের ফুট ফরমাস খেটেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলো পেগাসাস।

গ্রীক পেগাসাস এভাবে হারিয়ে গেলেও স্পাইওয়্যার পেগাসাস বিভিন্ন দেশের সরকারী সংস্থাগুলোর হাতে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে। গবেষক ক্লডিও গুয়ারনিয়েরির মতে, “যখনই আমরা কোনো ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা করি, প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই একটি প্রশ্ন আমাদের শুনতে হয়- কী করলে ভবিষ্যতে আবারও এরকম হ্যাকিং ঠেকানো যাবে। সত্যি কথা বলতে কি, এর কোনো উপায় নেই”। যদি সত্যিই উপায় না থাকে তাহলে এখন দেখার বিষয় কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো কতোটা অপরাধ নির্মুলে আর কতোটা ভিন্ন মত দমনে গ্রীক পেগাসাসের নামের সাথে মিলানো ইসরায়েলভিত্তিক স্পাইওয়্যার পেগাসাসকে ব্যবহার করে।