প্যান্ডোরা পেপারস বিশ্লেষণ : কার লাভ কার ক্ষতি


প্যান্ডোরা পেপারস বিশ্লেষণ : কার লাভ কার ক্ষতি

ছবি : সংগৃহীত

 

পানামা পেপারসের মতো এবার বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির গোমর ফাঁস করল 'প্যান্ডোরা পেপারস'। বিশ্বজুড়ে ৯০টি দেশের ৩৩০ জন রাজনীতিকের নাম উঠে এসেছে এ তালিকায়। সাত বছরে প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারস ইত্যাদি নামে যেসব গোপন দলিলপত্র ফাঁস হয়েছে, এই প্যান্ডোরা পেপারস হচ্ছে তার সবশেষ ঘটনা।

 

প্যান্ডোরা পেপারস কী?

প্যান্ডোরা শব্দের আভিধানিক অর্থ শামুক শ্রেণির এক ধরণের প্রাণী, যার খোলস অনেকটাই ভঙ্গুর। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির গোমর ফাঁস করেছে। প্রতিবেদনটি থেকে প্যান্ডোরা বক্সের মতো একের পর চমক বের হচ্ছে। অর্থ কেলেঙ্কারিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রে বাবিসের মতো নেতাদের নামও উঠে এসেছে।

এতো চমকসমৃদ্ধ এ প্রতিবেদনের নাম তাই সাংবাদিকরা রেখেছেন 'প্যান্ডোরা পেপারস'। কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার ও অর্থনৈতিক লেনদেনের গোপনীয়তার ওপর বিশদভাবে তৈরি করা হয় প্রতিবেদনটি।

 

ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) 'প্যান্ডোরা পেপারস' তৈরি করে।

বিভিন্ন মাধ্যমে গোপনে সংগ্রহ করা এক কোটি ১৯ লাখ নথি পর্যালোচনা করে প্যান্ডোরা পেপারস তৈরি করা হয়েছে। ১১৭টি দেশের ছয় শতাধিক সাংবাদিক এ বিশাল কর্মযজ্ঞে যুক্ত ছিলেন। বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির চিত্র উঠে এসেছে তাদের প্রতিবেদনে।

অন্যদিকে, প্যান্ডোরা পেপারস তৈরি করা আইসিআইজে’রও নিজস্ব একটি রিপোর্টিং টিম ও বার্তাকক্ষ আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে একযোগে ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিকতা করার একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।

বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশের ২৮০ জন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট এই নেটওয়োর্কের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া সংগঠনটি বিশ্বের নামকরা শতাধিক সংবাদমাধ্যম, আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারের ভিত্তিতেও কাজ করে।

 

কীভাবে তারা কর ফাঁকি দিয়ে গোপনে অর্থ লুকিয়ে রাখছেন?

সাধারণত ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ এবং অঞ্চলে নিবন্ধিত কিছু কোম্পানিতে বেনামে টাকা পাচার করে লুকিয়ে রাখেন। এসব কাজে বিভিন্ন আইনজীবী তাদেরকে সহযোগীতা করেন। আইসিআইজি বলছে, বিশ্ব অর্থনীতির ১০ শতাংশ পাচার হয়ে কয়েক ডজন কর-বিহীন অঞ্চলে বা ট্যাক্স হেভেনে নিবন্ধিত হাজার হাজার কাগুজে কোম্পানির খাতায় জমা হচ্ছে। পরিণতিতে এসব দেশের সরকার বছরে কম বেশি ৮০,০০০ কোটি ডলার আয়কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

পানামা, নেদারল্যান্ডস, মাল্টা, মরিশাস, যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার বা ওয়াইয়োমিঙ অঙ্গরাজ্য, ব্রিটিশ শাসিত ক্যারিবীয় দ্বীপ ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ বা কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জ কর ফাঁকির নিরাপদ জায়গা হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এসব জায়গায় একটি ফোন কল বা একটি ইমেইলের মাধ্যমেই অনেক সময় কোম্পানি খুলে ফেলা যায়।

অনেক ট্যাক্স হেভেনে এমন আইন রয়েছে যার মাধ্যমে কোম্পানির মালিকের নাম প্রকাশ করা যায় না। এসব কোম্পানির নথিপত্রে মূল মালিকদের নাম ঠিকানা না থাকলেও মূলত তারাই এগুলোতে বিনিয়োগ করা অর্থ লেনদেন করেন এবং কোম্পানির নামে নানা দেশে জমি-জমা ঘরবাড়ি কেনেন, শেয়ার বাজারে টাকা খাটান।

 

ছবি : সংগৃহীত

এসব কোম্পানির বেশিরভাগেরই নেই কোনো সার্বক্ষণিক কর্মী। অনেক কোম্পানির অফিসও নেই। অনেকে টাকার বিনিময়ে ভুয়া পরিচালক নিয়োগ দেন যারা কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করেন। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এসব কোম্পানিকে সাহায্য করেন অনেক আইনজীবী।

অবৈধ সম্পদ গোপন রাখতে বা কর ফাঁকির জন্য যারা এসব কোম্পানি খোলেন তাদের কাছ থেকে ওই সব দেশ ও অঞ্চলের সরকার ফি পাওয়ায় তারা এসব চলতে দেন। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোও এসব না দেখার ভান করে থাকার ফলে এসব নামসর্বস্ব কোম্পানি গড়ে উঠতে পারে।

 

কারা এসব কোম্পানিতে অর্থ বিনিয়োগ করেন?

সাধারণত যারা ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে চান না অথবা কারো ধার পরিশোধ করতে চান না তারা এসব কোম্পানি বানিয়ে অর্থ বিনিয়োগ করে থাকেন। এছাড়া দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এসব প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ করেন।

ব্যক্তির বাইরে অনেক প্রতিষ্ঠানও কর ফাঁকি দেয়ার জন্য ট্যাক্স হেভেনে ভিন্ন নামে সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। ফলে মূল প্রতিষ্ঠানের মুনাফার পরিমাণ কম দেখানো যায় এবং করের পরিমাণও কমে যায়।

 

ছবি : সংগৃহীত

কর ফাঁকি দিলে কী হয়?

সহজভাবে বলতে গেলে কর ফাঁকি দিলে ধনী গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধির পাশাপাশি গরিবের ওপর চাপ তৈরি হয়। বাজেটে ঘাটতি পূরণের জন্য সাধারণত বিভিন্ন সাধারণ পণ্য ও দ্রব্যের ওপর কর আরোপ করা হয়। দেশের অধিকাংশ মানুষ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। আবার তারাই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও দ্রব্যের মুল ভোক্তা। ফলে অতিরিক্ত করের চাপটা তাদের ঘাড়েই এসে চাপে যার ফলে তারা তাদের জীবনযাত্রার মানউন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমে ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে টিআইবি-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কর ফাঁকি দেয় বড় বড় ব্যবসা ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান৷ কিন্তু তার চাপ পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর৷ যাদের ট্যাক্সের আওতায় আনা দরকার, তাদের আনা যাচ্ছে না৷ এইসব বিপুল আয়ের মানুষ কর ফাঁকি দিয়ে দেশের বাইরে অর্থ পাচার করছেন’৷

তিনি আরো বলেন, ‘নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর কেনো আয়করের বোঝা চাপানো হবে? সত্যিকার অর্থে আয়কর দেয়ার যোগ্য বিরাট একটা সংখ্যার মানুষের এখনো আয়করের আওতায় আনা যায়নি৷ কর প্রশাসন সেটা করলেই আর নিম্নআয়ের মানুষের কাছ থেকে কর নিতে হবে না’।

কয়েক বছর পর পর যেভাবে বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে আসছে এতে করে সামনে আরও বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। এ ধরণের অর্থপাচার বন্ধে সংশ্লিষ্টদের এখনই তৎপর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।