বিশ্ব আলোকচিত্র দিবসের আদ্যোপান্ত


বিশ্ব আলোকচিত্র দিবসের আদ্যোপান্ত

 

"A picture is worth a thousand words” প্রবাদটি বহুল প্রচলিত। বলা হয়ে থাকে একটি ছবি কয়েক হাজার কথা বলে, গল্প বলে। হাজার শব্দের চেয়েও মূল্যবান একটি ছবি। বর্তমানে ভিডিও, এনিম্যাশন, থ্রি-ডি’র যুগে হয়তো আমাদের উপলব্ধি করতে কষ্ট হয়, তবে একটি ছবিই পারে আলোড়ন সৃষ্টি করতে। ১৯ আগস্ট, বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস।

১৮২৬ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী জোসেফ নিসেফর নিয়েপ্সের তোলা ছবিটিকে ধরা হয় বিশ্বের সর্বপ্রথম ছবি। আবার অনেকেই বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ছবি। ধারণা করা হয়, ১৮২৫ সালে সর্বপ্রথম ছবি তোলেন তিনি, কিন্তু সেই ছবিগুলোর কোনো অস্তিত্ব আর এখন নেই।

নিয়েপ্স তার প্রথম ছবিটি তোলেন হেলিওগ্রাফিক পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিও আবিস্কার করেন তিনি। অনেক দিন ছবি তোলার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেন নিয়েপ্স। এরপর পদ্ধতিটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন তিনি। টিনের সঙ্কর ধাতুর একটি পাতের উপর বিটুমেন ও পানির মিশ্রণের প্রলেপ ব্যবহার করে সেটিকে একটি যন্ত্রের মধ্যে স্থাপন করেন, যে যন্ত্রটিই ক্যামেরার আদিপুরুষ। ক্যামেরাটি ছিলো তার বাড়ির জানালা থেকে বাইরের দৃশ্যের দিকে তাক করা। প্রায় আট ঘন্টা আলো পড়ার পর জায়গাগুলোতে গাছপালা এবং বাড়িঘরের প্রতিচ্ছবি পড়েছিল। ধাতব পাতের সে জায়গাগুলোর বিটুমেনের প্রলেপ ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায়। আর যে জায়গাগুলো শক্ত হয়নি, সে জায়গায় বিটুমেনের অবশিষ্ট অংশগুলো ল্যাভেন্ডার তেল এবং অ্যালকোহল দিয়ে তুলে ফেলে পরিষ্কার করে ফেলেন। ফলে তৈরি হয় ধাতব পাতের উপর তোলা স্থায়ী ছবিটি।

 

জোসেফ নিসেফর নিয়েপ্সের তোলা প্রথম ছবি (সংগৃহীত)

এ তো গেলো প্রথম ছবির ইতিহাস। তবে বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস পালন করা হয় ১৮৩৯ সাল থেকে। জানুয়ারির ৯ তারিখে ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সাইন্সেস আলোকচিত্রের এক উপায় আবিস্কারের ঘোষণা দেন। এর নাম দেয়া হয় ড্যাগুইররিয়ো টাইপ। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে তারা এই প্রক্রিয়াকে ১৯ আগস্ট, ১৮৩৯ সালে সর্বসাধারণের সম্মুখে আনে। আর সেই দিনটিকেই বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস হিসেবে উদযাপন করছে বিশ্ব।

এদিকে, নিয়েপ্স যে হেলিওগ্রাফিক পদ্ধতি আবিস্কার করেন, সেটির সবচেয়ে বড় সমস্যা ছবিগুলো ঘোলা ওঠে এবং সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের মতো লাভজনক ছিল না। ১৮৩০ সালে নিয়েপ্সের সাথে লুই ড্যাগারের পরিচয় হয়। তারা দুজনে মিলে ছবি তোলার পদ্ধতির ব্যাপারে গবেষণা আরো বাড়িয়ে দেন।

নিয়েপ্সের মৃত্যুর পর ড্যাগার সিলভার ছবি তোলার কার্যকর পদ্ধতি আবিস্কার করেন এবং যা ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতি নামে পরিচিতি পায়। ১৮৩৮ সালে ড্যাগার্ড প্যারিসের বুলেভার্দ দ্যু টেম্পলের একটি ছবি তোলেন, যেখানে ধরা পড়ে দুজন মানুষের ছবি। এটিই বিশ্বের প্রথম মানুষের ছবি। এই ছবিটি তুলতে প্রায় সাত মিনিট সময় লেগেছিলো ড্যাগার্ডের।

 

বিশ্বের প্রথম মানুষের ছবি (সংগৃহীত)

বর্তমানে আমাদের কাছে বহুল প্রচলিত শব্দ সেলফি। অর্থ নিজের অথবা নিজেদের ছবি নিজেরাই তুলতে পারা। ২০১৩ সাল থেকে এটির প্রচলন শুরু হয়েছে খুব বেশী। তবে নিজের ছবি নিজেই তুলতে পারা সেটি বিশ্বের সর্বপ্রথম তুলেছিলেন মার্কিন ফটোগ্রাফার রবার্ট কর্নেলিয়াস। ১৮৩৯ সালে তিনি এ ছবি তোলেন। যেহেতু সেসময় একটি ছবি তুলতে অনেক সময় লাগতো তাই কর্নেলিয়াস যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় নিজের বাড়ির আঙিনায় কাউকে অনুরোধ না করে নিজেই ক্যামেরার সামনে ১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপরেই তিনি তার নিজের ছবিটি পান।

 

বিশ্বের সর্বপ্রথম সেলফি (সংগৃহীত)

বর্তমান সময়ে ফটোগ্রাফি অন্যতম একটি জনপ্রিয় পেশা। ফটো জার্নালিস্ট পেশাটি সাংবাদিকতায় নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছে। তবে আমরা অনেকেই জানিনা প্রথম কবে সংবাদপত্রে ছবি ব্যবহার করা হয়। বর্তমান সময়ে ছবি ছাড়া সংবাদ চিন্তাই করা যায় না। কিন্তু একটা সময় এমন ছিল না, সেসময় সংবাদ মানেই শুধু কাগজে কালির ব্যবহার। ১৮৪৭ সালে প্রথম সংবাদে ছবি ব্যবহার হয়। ফ্রান্সে একজন অপরাধী গ্রেপ্তারের পর ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতিতে একটি ছবি তোলা হয়। সেই ছবিটিই বিশ্বের প্রথম সংবাদপত্রে ব্যবহৃত ছবি।

 

বিশ্বের প্রথম সংবাদপত্রে ব্যবহৃত ছবি (সংগৃহীত)

সাদাকালো যুগ থেকে একটা সময় রঙিন ছবি তোলা শুরু হয়। ১৮৬১ সালে বিশ্বের প্রথম রঙিন ছবিটি তোলা হয়। স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল সেই ছবিটি তোলেন। যিনি তাড়িত চৌম্বক তত্ত্বের জন্যই বেশি বিখ্যাত। ম্যাক্সওয়েল লাল, নীল এবং হলুদ ফিল্টার ব্যবহার করে তিনটি ছবি তুলেন। পরে সবগুলোকে একসাথে করে একটি ছবিতে রূপান্তরিত করেন তিনি।

এছাড়াও ২০১০ সাল থেকে ‘ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি ডে’ আয়োজন করা হয়। বিশ্বের সকল ফটোগ্রাফারদের এক করতেই ২০০৯ সালে অস্ট্রেলীয় আলোকচিত্রী কোরসকে আরা এই দিনটি পালন করা শুরু করেন। ১৯ আগষ্ট, ২০১০ সালে প্রথম অনলাইন গ্যালারির মাধ্যমে এই দিনটি শুরু হয়। এতে অংশ নেন বিশ্বের ১০০টি দেশের ২৭০ জন আলোকচিত্রী।