ডাক দিবস ও ডাক বিভাগের পেছনের কথা


ডাক দিবস ও ডাক বিভাগের পেছনের কথা

ছবি : সংগৃহীত

 

আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় শেষ কবে মেইল অথবা সোস্যাল মিডিয়ায় চ্যাট করেছেন? এর উত্তর টা এমন হতে পারে এই লেখা পড়তে পড়তেই চ্যাট করছি, অথবা কয়েক সেকেন্ড আগে মেইল পাঠিয়েছি। আর এখন যদি প্রশ্ন করা হয় শেষ কবে হাতে লিখে চিঠি পাঠিয়েছিলেন? আপনি নিশ্চয় ভাবছেন, হাতের কড়ায় গুনতে হচ্ছে অথবা মনে করেও বের করতে পারছেন না! মনে প্রশ্ন আসতে পারে কেনো হঠাৎ করেই চিঠির কথা বলা হচ্ছে! বিশ্ব ডাক দিবস সম্পর্কে জানাতে গিয়েই এ প্রশ্নের অবতারণা।

৯ অক্টোবর, বিশ্ব ডাক দিবস। বিজেসি নিউজের পাঠকদের জন্য বিশ্ব ডাক দিবস ও ডাক বিভাগের আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে।

ইন্টারনেটের এই যুগে প্রয়োজন কমেছে ডাক যোগাযোগের। এখন আর দরকার হয় না চিঠি লেখার। তবু দিনটা যে রয়ে গিয়েছে। ১৮৭৪ সালে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নে এ দিনই তৈরি হয়েছিল ‘ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন’। আর সে দিনটিতেই সারা পৃথিবীর জুড়ে পালিত হয় ‘বিশ্ব ডাক দিবস’।

 

ছবি : সংগৃহীত

তবে ডাক বিভাগের ইতিহাস আরো কিছু দিন আগের, তৎকালীন জার্মান ডাক বিভাগের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জে হাইনরিখ ফন স্টিফেন ১৮৬৮ সালে একটি পোস্টাল ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মূলত তারই উদ্যোগে  সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে ১৮৭৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত একটি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে ২২টি দেশের ডাক বিভাগ অংশ নেয়। ঐ সম্মেলনের শেষ দিন, ৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় জেনারেল ইউনিয়ন অব পোস্ট। যেই দিনটি পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ডাক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। 

১৮৭৮ সালে বিশ্ব ডাক সংস্থা গঠনের পর যেকোনো রাষ্ট্র থেকে পাঠানো চিঠি অন্য রাষ্ট্র বিনা মাশুলে গ্রহণ করতে বধ্যপরিকর হয়। তবে এর আগে এই নিয়ম ছিলো ভিন্ন। তখন একটি চিঠি এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাঠানো হলে যতোগুলো দেশের ভেতর দিয়ে যেতে হতো, সেসব দেশের ডাকটিকিট খামে লাগাতে হতো। এতে যেমন খরচ অনেক বেড়ে যেতো, ঠিক তেমনই অনেক ঝামেলারও ছিল। এ নিয়ে অনেক আলোচনা করে দেশগুলো। তবে কোনো কিছুই ঠিক হচ্ছিলো না। অবশেষে ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ডাক সংস্থার ১৬তম অধিবেশন। আর ৯ অক্টোবরকে বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বর্তমানে, সরকারি চিঠি ও সমন ডাকে পাঠানো হয় বা কোনো নির্দেশনামা বা বিল ডাক বিভাগের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এই তো কয়দিন আগেও কারোর জন্য আনন্দ সংবাদ বা কারোর জন্য দু:খের খবর পৌঁছে দিতেন ডাকপিয়নরা। তবে এখন আর তেমনটা হয় না। এখন বেশিরভাগ পোস্ট অফিসগুলোতে ব্যাঙ্কিং কাজকর্ম হয়। পেনশন বা বেতন দেয়া হয় বহু সংস্থার।

 

ছবি : সংগৃহীত

ডাক বিভাগের সোনালী অতীত কিছুটা হারিয়ে গেলেও ডাক বিভাগের কাছে বিশ্ব ডাক দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। আর তাই এ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ৮টি বিশেষ খাম ও ৮টি সিলমোহর, ১৪টি বিশেষ সীলমোহর, ১০টি স্মারক ডাকটিকিট, দুটি সুভেনির শিট ও চারটি উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করেছে।

প্রথম ১৯৭৪ সালের ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক সংস্থার শতবার্ষিক উপলক্ষ্যে ২৫ পয়সা, ১ টাকা ২৫ পয়সা, ১ টাকা ৭৫ পয়সা ও ৫ টাকা মূল্যমানের চারটি স্মারক ডাকটিকিট ও ৮ টাকা ২৫ পয়সা মূল্যমানের একটি সুভেনির শিট প্রকাশ করে। এটি বাংলাদেশের প্রথম সুভেনির শিট।

 

ছবি : সংগৃহীত

২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর বিশ্ব ডাক সংস্থার ১৪৫তম বার্ষিকে ১০ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। এই ডাকটিকিটের রয়েছে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সেটি হলো ডাকটিকিটের ডিজাইন বিশ্ব ডাক সংস্থা থেকে পাঠানো হয় এবং একই নকশায় বিশ্ব ডাক সংস্থার সমস্ত সদস্য দেশ থেকে ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বিশ্ব ডাক দিবস উপলক্ষে ১০ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

 

এবার একটু দেখা যাক ডাকটিকিটের ইতিহাস। ১৯৭১ এ যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিলো, তখন মুজিবনগর সরকার রাষ্ট্রীয় কাজে চিঠিপত্র ব্যবহার করতো। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো পাকিস্তানের নামাঙ্কিত ডাকটিকিট। যুদ্ধকালীন সময়ে, মুজিবনগর সরকারের কাছে নতুন করে ডাকটিকিট ছাপানোর সময় ছিলো না। তাই ডাকটিকিটের উপর থেকে পাকিস্তানের নাম মুছে দিয়ে রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ ছাপ দিয়ে কাজ চালানো হতো।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ক’জন আন্তর্জাতিক বন্ধু বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে জন স্টোনহাউজ একজন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ এমপি এবং ব্রিটেনের পোস্টমাস্টার জেনারেল। সেই সুবাদে তিনি জানতেন কীভাবে একটি দেশের নিজস্ব ডাকটিকিট ছাপানো এবং প্রচার করতে হয়।

 

ছবি : সংগৃহীত

১৯৭১ এর ২৯ এপ্রিল স্টোনহাউজ, ভারতের খ্যাতিমান ডিজাইনার বিমান মল্লিকের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করে জানতে চান, তিনি বাংলাদেশের ডাকটিকিট ডিজাইন করার কাজটি নিতে চান কী না। বিমান মল্লিক সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। অনেক ব্যস্ততার পরও মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের জন্য আটটি ডাকটিকিট এবং একটি ফার্স্ট ডে কাভারের ডিজাইন করেন।

 

ছবি : সংগৃহীত

যেহেতু ডিজাইনের জন্য কোনো দিক নির্দেশনা ছিলো না- কতো মূল্যমানের ডাকটিকিট হবে সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল বিমান মল্লিককেই। তিনি সিদ্ধান্ত নেন এক পাউন্ড অর্থাৎ ২১ রুপি ৮০ পয়সার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ডাকটিকিটগুলোর দাম। ৮টির মূল্যমান তিনি নির্ধারণ করেন- ১০ পয়সা, ২০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ১ রুপি, ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ ও ১০ রুপি। সেই ডাকটিকিটগুলোতে বাংলাদেশের নাম লেখা হয়েছিল ‘বাংলা দেশ’ এবং মুদ্রা রুপি।

প্রথম ডাকটিকিট, অর্থাৎ ১০ পয়সার ডাকটিকিটে ছিল বাংলাদেশে মানচিত্র। বাংলাদেশের মানুষের ভূখণ্ড, তার দেশের পরিচয় বিশ্বকে জানানো ছিল এই ডাকটিকিটের প্রধান লক্ষ্য। তাই ডাকটিকিটে তিনি খুব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় মাঝ বরারর দিয়ে যাওয়া কর্কটক্রান্তি রেখার কথা উল্লেখ করেন।

দ্বিতীয়টি ২০ পয়সার ডাকটিকিট, যেখানে ২৫ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞকে স্মরণ করে ডিজাইন করা হয়েছিল। নিজে একজন শিক্ষক হওয়ার সুবাদে একটি শিক্ষায়তনে হামলাকে তিনি বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাই তো সবুজ জমিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখাটির উপর লাল রক্তের ছোপ দিয়েছেন। পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ম্যাসাকার অ্যাট ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ ডাকটিকিটটি তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল।

৫০ পয়সার তৃতীয় ডাকটিকিটে ৭৫ মিলিয়ন মানুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ৭ এবং ৫ কে একীভূত করে তাদের একত্রে সংগ্রামের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এক রুপির ডাকটিকিটে, বাঙালি জাতির পতাকাকে দেখানো হয়েছে। এছাড়া, সেখানে বাংলাদেশের পতাকাখচিত মানচিত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে। সেই পতাকা অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের পরে মানচিত্র সরিয়ে একটু পরিবর্তন করানো হয়। দুই রুপির ডাকটিকিটে ব্যালটবাক্সের ছবি রাখা হয়।

ছবি : সংগৃহীত

১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা তুলে ধরা হয়েছে। তিন রুপির ডাকটিকিটে দেখানো হয় ভাঙ্গা শিকল। যেখানে বাঙালির শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত করা হয়েছে। পাঁচ রুপির ডাকটিকিটে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন বন্দি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। এই ডাকটিকিটেই তার ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। বাকি সব কয়টিতেই ডিজাইন করা হয়েছে শুধু। ১০ রুপির ডাকটিকিটে বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে লেখা ছিলো- 'Support Bangla Desh'। এই ডাকটিকিটটি ছিল সাদামাটা, কিন্তু এর বার্তা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ। যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি ছিলো এই ডাকটিকিটের ছবির মূল বিষয় ।

বিংশ শতাব্দীতে ইমেইল ও ইন্টারনেটের যুগে জনগণ দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য সেবা আশা করে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ হয়তো কিছুটা পিছিয়ে। দিতে পারছে না আশানুরূপ সেবাও। অথচ কুরিয়ার সার্ভিসের চেয়ে অনেক কম মূল্যে ডাক বিভাগ সেবা দিয়ে আসছে।

অনেকের কাছেই হয়তো অজানা, ১৮৯৮ সালের পোস্টাল অ্যাক্ট অনুযায়ী চিঠিপত্র বহন করার ক্ষেত্রে পোস্ট অফিসেরই একমাত্র ক্ষমতা রয়েছে। আর শুধুমাত্র পার্সেল বহনের ক্ষেত্রে পোস্ট অফিস ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অথচ কুরিয়ার সার্ভিসগুলো পার্সেলের আড়ালে চিঠিপত্রও বহন করছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম মূল ভিত্তি দেশের বিভিন্ন সেবাকে ডিজিটাইলাইজড করা। আমাদের বিশ্বাস, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডিজিটাইলালেজসন হবে, করা হবে আরো আধুনিক, উন্নত হবে বিভিন্ন সেবা। আর এই সেবা পাবে বাংলাদেশের মানুষ।