স্বপ্নের মেট্রোরেল, পরিবহন খাতে এক যুগান্তকারী সংযোজন


স্বপ্নের মেট্রোরেল, পরিবহন খাতে এক যুগান্তকারী সংযোজন

ছবি : সংগৃহীত

 

রাজধানী ঢাকাবাসীর অন্যতম হতাশার নাম যানজট! হয়তো লেখাটি যখন পড়ছেন তখন আপনি যানজটেই বসে আছেন। ভাবছেন এভাবে কি চলে নাকি! অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। ভাবছেন ঢাকাতেই মনে হয় সবচেয় বেশি জানজট। তাহলে আপনি জেনে খুশি হবেন, বিশ্বব্যাপী তীব্র যানজটের প্রথম দশ দেশের তালিকাতে নেই আপনার আমার জাদুর শহর ঢাকা।

এই যানজট থেকে ঢাকাবাসীকে রক্ষা করতে যে কয়টি ব্যবস্থা সরকার নিতে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম ঢাকা মেট্রোরেল। বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থায় নতুন এক যুগের সুচনা ঢাকার এলিভেটেড মেট্রোরেল। কী কী থাকছে মেট্রোরেলে, এই নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের লেখা।

সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে আগামী বছরের ডিসেম্বরে বাণিজ্যিক চলাচল শুরু হতে পারে মেট্রোরেলের। এর আগ পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে চলাচল অব্যাহত থাকবে। এই পরীক্ষামূলক চলাচলকে বলা হচ্ছে 'পারফরমেন্স টেস্ট'। যা চলবে আগামী ছয় মাস। এর পরের তিন মাস হবে 'ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট'। তার পরের পাঁচ মাস চলবে যাত্রীবিহীন 'ট্রায়াল রান'।

 

ছবি : সংগৃহীত

দেশের পরিবহন খাতের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। প্রথম পর্যায়ে এই ট্রেন সেবা দেবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। পরে তা বিস্তৃত হবে মতিঝিল পর্যন্ত। মেট্রোরেল যে পথ পাড়ি দেবে তার মোট দূরত্ব ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার।

ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের নাম এমআরটি-৬৷ যার রুট হবে উত্তরা থেকে শুরু হয়ে মিরপুর, ফার্মগেট, মতিঝিল হয়ে কমলাপুর। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ২৯ কিলোমিটার পথ। এ অংশের নির্মাণকাজ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে এবং আগারগাঁও থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটারের কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালের মধ্যে। বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ডিএমটিসিএলের তথ্য মতে, মেট্রোরেল চালু হলে উত্তরা থেকে কমলাপুর যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩৮মিনিট৷ এই সময়ের মধ্যেই ১৭টি স্টেশনে থামবে মেট্রোরেল। প্রতিটিতে সময় নেবে ৩০-৪৫ সেকেন্ড।

 

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকার ক্যাবল মেট্রোরেল-৬ প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। ঢাকার মেট্রোরেলে থাকছে আরো পাঁচটি প্রকল্প। এমআরটি লাইন-১, যার অধীনে আবার দুটো রুট হবে৷ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর আর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল। যার একটিকে বলা হচ্ছে বিমানবন্দর রুট এবং অপরটিকে বলা হচ্ছে পূর্বাচল রুট।

পরিকল্পনা অনুসারে ২০২৬ সালে এটা চালু হবে৷ উত্তরা থেকে মতিঝিল ২০.১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরোদমে চালু হলে উত্তরা থেকে মতিঝিলে সময় লাগবে ৩৮ মিনিট। দুই দিকে ২৪টি ট্রেন ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।

 

ছবি : সংগৃহীত

২০৩০ সালের মধ্যে এমআরটি-৬ ছাড়াও ঢাকায় আরও চারটি মেট্রোরেলপথ নির্মাণ করা হবে। এমআরটি-৫ উত্তর এবং দক্ষিণ অংশে বিভক্ত। এসব পথে চালাতে জাপান থেকে ২৪ সেট ট্রেন কেনা হচ্ছে। যার দাম পড়তে পারে তিন হাজার ২০৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এতে শুল্ক, ভ্যাটসহ খরচ হবে চার হাজার ২৫৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। প্রতিটি ট্রেনের দাম পড়ছে ১৭৮ কোটি।

প্রকল্প কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকায় নির্মাণাধীন এমআরটি-৬ রুটে স্টেশন থাকবে ১৬টি। উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে ২০ দশমিক এক কিলোমিটার দূরের মতিঝিল স্টেশনে মেট্রোরেল যাবে ৩৮ মিনিটে। মেট্রোরেলের ট্রেন ও রেলপথ ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার গতির উপযোগী হলেও ঢাকায় মেট্রোরেল চলবে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে। শুরুর এবং শেষের এই দুই স্টেশনের মাঝে ১৪টি স্টেশনে এক মিনিট করে যাত্রাবিরতি করবে এ ট্রেন। তবে এসকল হিসাব এখনো চূড়ান্ত নয়।

এমআরটি-৬ লাইন তৈরিতে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকা ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। যাত্রীদের ভাড়ার টাকা থেকেই সংস্থাটির ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের কিস্তি দিতে হবে আগামী ৩০ বছর। যা পড়বে প্রতি মাসে ৪৬ কোটি ১৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।

 

ছবি : সংগৃহীত

এমআরটি-৬ ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। ২০৩০ সাল নাগাদ এ রুটে দৈনিক ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৩০০ যাত্রী চলতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। মেট্রোর ট্রেনের ছয়টি বগির মধ্যে একটি নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

ট্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহে দিয়াবাড়ী ও মতিঝিলে দুটি রিসিভিং সাবস্টেশন-আরএসএস থাকবে। জাতীয় গ্রিড থেকে কোনো কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ বা ব্যাহত হলে, ট্রেনের ব্যাটারিতে যে সঞ্চিত বিদ্যুত থাকবে এটি পরবর্তী স্টেশন পর্যন্ত চলবে।

 

ছবি : সংগৃহীত

মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো তিনতলা। দ্বিতীয়তলা দিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়া যাবে। তৃতীয়তলার প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছাড়বে। স্টেশনে থাকবে খাবারসহ নানা বাণিজ্যিক সুবিধা। পাঁচটি স্টেশনে হবে প্লাজা।

এমআরটি-৬ প্রকল্পটি ২০১২ সালে অনুমোদন পেয়েছিলো। তবে কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুনে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে ট্রেন চলবে। আর ২০২৪ সালের জুনে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে।

এছাড়া, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশে দিয়েছেন, এমআরটি-৬ মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করতে। বর্ধিতকরণের কাজ চলছে বলেও জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এদিকে, ঢাকায় মেট্রোরেলে প্রস্তাবিত ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সর্বোচ্চ হতে পারে প্রায় ৪৮ টাকা। আর দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যাত্রীপ্রতি ভাড়া গুণতে হতে পারে সর্বোচ্চ ২৮ টাকা। আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত হতে পারে আট টাকা। কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া হতে পারে ১২ টাকা।

 

ছবি : সংগৃহীত

আটটি প্যাকেজে এমআরটি-৬ এর কাজ চলছে। প্রথম প্যাকেজে শতভাগ শেষ হয়েছে দিয়াবাড়ি ডিপোর কাজ। দ্বিতীয় প্যাকেজে ডিপোর অবকাঠামো নির্মাণ কাজ হয়েছে ৯৫ শতাংশ। তৃতীয় ও চতুর্থ প্যাকেজে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। পঞ্চম প্যাকেজে আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার অগ্রগতি ৭১ দশমিক ১৪ শতাংশ। ষষ্ঠ প্যাকেজে কারওনবাজার থেকে মতিঝিল, চার দশমিক ৯২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট এবং চারটি স্টেশন তৈরি হচ্ছে। সপ্তম প্যাকেজে ট্রেন চালানো বিদ্যুৎ লাইন ও ডিপোতে মেকানিক্যাল রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে এবং এ কাজে অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ।

২০২২ সালের জুনে মেট্রোরেল চালুর ঘোষণা আসতে পারে। সড়কের ওপর নির্মিত এসব মেট্রোরেল লাইনের নীচ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে যান চলাচল করবে। এছাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে থাকবে বাণিজ্যিক স্পেসও।