আফগানিস্তানে তালেবানের সুলুক সন্ধান


আফগানিস্তানে তালেবানের সুলুক সন্ধান

ছবি : সংগৃহীত

 

ভয়, আতঙ্ক আর গোলাবারুদের শব্দ! আফগানিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় সশস্ত্র তালেবান সদস্যদের তৎপরতা। জীবন বাঁচাতে সাধারণ নাগরিকদের কেউ ছুটছেন অন্য দেশের উদ্দেশে, কেউবা স্বাগত জানাচ্ছেন নিজেদের ভবিতব্য তালেবান সরকারকে।

প্রায় ২০ বছর ধরে মার্কিন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশটি থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরুর পর থেকেই পালটে যেতে থাকে পুরো দৃশ্যপট। মার্কিন সেনাদের ঘাঁটি দখলের মাধ্যমে একের পর এক শহর দখল করে তালেবান সশস্ত্র বাহিনী। প্রেসিডেন্ট আবদুল গনি দেশত্যাগের পরপরই বদলে যায় সব হিসেব।

রাজধানী কাবুলে  বিজয় পতাকা ওড়ানোর মধ্য দিয়ে তলেবান বাহিনী জানান দেয় নিজেদের রাজত্বের। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গোটা বিশ্ব রাজনীতিই আজ দ্বিমুখী অবস্থানে । কেমন হতে যাচ্ছে তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ এমন প্রশ্নে তোলপাড় গোটা বিশ্ব। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং তালেবান সরকার গঠন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বিশ্ব নেতাদের মাঝে। ভবিষ্যৎ আফগানিস্তান কি তার অতীতের পথেই চলতে যাচ্ছে কী না এমন প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে।

 

কাবুল দখলের পর তালেবানদের উল্লাস। ছবি : সংগৃহীত

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল আফগানিস্তান।  প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে মানুষের বসবাস শুরু হয় এই অঞ্চলে।  গ্রেকো-বারট্রিয়ান, হেফথালিটি,  কাবুল শাহী, , ঘুরি, খিলজি, মুঘল, হুতাক ও দুররানিসহ অনেক সাম্রাজ্যই প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো আফগানিস্তানে। খ্রিস্টীয় ৩য় থেকে ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত এখানকার প্রধান ধর্ম ছিলো বৌদ্ধধর্ম।  তবে খ্রিস্টীয় ১০ম শতাব্দী্র দিকে দেশটিতে গজনভি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। গজনীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন মাহমুদ গজনভি। তার শাসনকালে আফগানিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়।

মাহমুদ গজনভির মৃত্যুর পর একে একে ঘুরি, তৈমুর এবং মুঘলরা আফগানিস্তানের রাজত্ব করে। তবে আহমেদ শাহ দুররানিকে বলা হয় আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা।

১৭৪৭ সালে দুররানি সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। ১৭৭২ সালে আহমেদ শাহ দুররানির মৃত্যু হলে তার পুত্র তৈমুর শাহ দুররানি ক্ষমতায় আসেন। তিনি আফগানিস্তানের রাজধানী কান্দাহার থেকে  কাবুলে স্থানান্তরিত করেন। এই সময় থেকে দেশটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে নিজেদের বিভিন্ন অঞ্চল হারাতে শুরু করে।

 

মাহমুদ গজনবীর দরবার। ছবি : সংগৃহীত

গ্রেভইয়ার্ড অব এমপায়ার্স নামে পরিচিত আফগানিস্তানের দখল নেয়ার চেষ্টা চালায় ব্রিটিশরাও। উনিশ শতকের দিকে "দ্য গ্রেট গেম" নামে পরিচিত  ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আফগানিস্তানের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। সেসময় মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার অগ্রগতি এবং পারস্যে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে ব্রিটিশদের উদ্বেগ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয় দুটি অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ। প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে পরাজিত হয় ব্রিটিশরা।  কিন্তু দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে হেরে যায় আফগানরা।

তবে আফগানিস্তানে পুরো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেনি ব্রিটিশরা। ১৯১৯ সালে তৃতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে আফগানরা। তৃতীয় অ্যাংলো-আফগান  যুদ্ধকে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধও বলা হয়। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে আফগানিস্তানে শুরু হয় দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। এই গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার নামে এবং আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে আফগানিস্তানে ঢোকে সোভিয়েত সেনাবাহিনী। সোভিয়েত সৈন্যদের সেখানে ৬ মাস থাকার কথা থাকলেও  শেষ পর্যন্ত তারা ছিল দীর্ঘ ১০ বছর। এই দশ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজত্ব চলে আফগানিস্তানে।

নিজেদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে আফগানরা। বলা হয়ে থাকে এই  লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই জন্ম হয়েছিল তালেবান এবং আল-কায়েদার মতো সশস্ত্র বাহিনীগুলোর। যে সকল আফগান মুজাহিদিন সোভিয়েত সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলো তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তুলে দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র বাহিনী। এরপর ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথে দেশটিতে আবারো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সেসময় সামনে আসে উগ্রপন্থি ইসলামি সংগঠন তালেবানের নাম। সবশেষ, ১৯৯৬ সালে প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রব্বানির সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসে তালেবানরা।

 

দুই দশক আগে ক্ষমতা দখলের পর তালেবানরা। ছবি : সংগৃহীত

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল উগ্রপন্থি তালেবানরা। তাদের নেতা ছিলেন আমির মোল্লা ওমর। সেসময় আফগানরা তাদের স্বাগত জানায়। বিদেশী রাষ্ট্রগুলোও মেনে নেয় তালেবান সরকারকে। কিন্তু সময়ের সাথে তালেবানরা আফগানিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার নামে শুরু করে উগ্রবাদ। বন্ধ করে দেয়া হয় নারীদের পড়াশোনা ও বাহিরে যাওয়া। বিভিন্ন খেলাধুলাসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। আনা হয় নানা কঠোর নিয়মকানুন। খর্ব হয় কমুনিস্ট চিন্তাচেতনার আফগানিদের স্বাধীনতা।

অন্যদিকে, ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সংগঠিত হয় ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সন্ত্রাস হামলা। এরইসাথে পাল্টে যায় গোটা বিশ্বের রাজনীতি। ৯/১১ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দেন তালেবান নেতা আমির মোল্লা ওমর। সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিত্র বাহিনী যে মুজাহিদিন গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে শক্তিশালী করে তুলেছিলো সেই তালেবানরাই আশ্রয় দেয় আল-কায়েদা জঙ্গিগোষ্ঠীকে।

এর পরপরই তালেবানদের ক্ষমতা থেকে হটাতে এবং আল-কায়েদা জঙ্গিগোষ্ঠীকে চিরতরে শেষ করতে আফগানিস্তানে একের পর এক হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র বাহিনী। অবশেষে ২০০১ সালের ৭ ডিসেম্বর নিজেদের শক্তিশালী ঘাঁটি কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ হারায় তালেবানরা। ধীরে ধীরে সমগ্র দেশেই নিয়ন্ত্রণ নেয় মার্কিনি সেনা ও ন্যাটো মিত্রবাহিনী।

 

ঐতিহাসিক টুইন টাওয়ার হামলা। ছবি : সংগৃহীত

আফগানিস্তানে তালেবানের পর প্রেসিডেন্ট হামিদ কারযাই এবং আশরাফ গনির নেতৃত্বে দুটি সরকার গঠিত হয়েছিল। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও এই সরকারগুলোকে বলা হতো যুক্তরাষ্ট্রের পাপেট সরকার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজেদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে প্রচুর আর্থিক সহায়তা পেলেও দুর্নীতিকেই প্রাধান্য দেয় কারযাই ও আশরাফ গনির সরকার। ফলস্বরুপ কখনোই নিজেদের শক্ত অবস্থানে নিতে পারেনি আফগান সেনাবাহিনী। দুর্নীতি জায়গা করে নেয় আফগান সেনাবাহিনীতেও।

এর মাঝে ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুসলিম বিদ্বেষী-মার্কিন ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার বিষয়ে আলোচনায় বসতে ট্রাম্পকে খোলা চিঠি দেয় তালেবানরা। এরপর ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে শান্তিচুক্তির চেষ্টা চললেও কোন ফল আসেনি। অবশেষে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুপক্ষের মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি হয় যার শর্ত অনুসারে শতাধিক বন্দি তালেবান সদস্যকে মুক্তি দেয়া হয়।

এ বছরের সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হবে বলে এপ্রিলে ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আগস্টের শেষেই আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করা হবে বলে পরে জানায় বাইডেন প্রশাসন। ধীরে ধীরে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র।

পালটাতে থাকে দেশটির চিত্র, তালেবানের দখলে যেতে থাকে একের পর এক শহর। ক্ষমতা চলে যেতে থাকে তালেবানদের কাছে। চীনের মদদপুষ্ট তালেবানদের সামনে অসহায় দুর্বল আফগান সেনা। দেশবাসীকে এমন কঠিন পরিস্থিতে ফেলেই পালিয়ে যান দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদুল গনি। প্রেসিডেন্টের ভবন দখলে নেয় তালেবানরা। উগ্রপন্থি এই গোষ্ঠীর নেতারা শুরুতেই জানিয়ে দেন কোনো বৈদেশিক হস্তক্ষেপ কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকবে না আফগানিস্তানে। নিজেরাই সরকার গঠন করবে বলেও জানান তারা। এরইমাঝে, সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে আশ্রয়ে থাকা শীর্ষস্থানীয় তালেবান নেতারা দেশটিতে ফিরতে শুরু করেছেন।

 

১৯৭৫ সালে আফগানিস্তানের একটি  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছবি : সংগৃহীত

বর্তমানে দেশটিতে থাকা বিদেশী নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজ নিজ সরকার। দেশত্যগ করছে লাখো আফগান নাগরিক। তালেবানরা কাউকে দেশত্যাগে বাধা প্রদান করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও রোজই পাওয়া যাচ্ছে হতাহতের খবর।

তালেবানরা এবার নারী স্বাধীনতা সহ নিজেদের কট্টর নিয়মকানুনে কিছুটা শিথিলতা আনার কথা বললেও অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেশটির নতুন সরকার ব্যবস্থা কেমন হবে তা কিছুটা অনুমান করছে বিশ্ববাসী। দেশটির সার্বিক পরিস্থিতি দেখে তালেবান সরকারের অধীনে আফগানিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ। আফগানিস্তান আবারো আল-কায়েদার মতো জঙ্গীগোষ্ঠীর অভয়াশ্রম হতে যাচ্ছে কী না এমন শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।