'ক্লিক-রিচ বাণিজ্য' বনাম শিরোনাম বিভ্রাট


'ক্লিক-রিচ বাণিজ্য' বনাম শিরোনাম বিভ্রাট

 

শিরোনাম এমন একটা বিষয় যেটা পাঠককে পুরো ঘটনাটা জানতে আগ্রহী করে তোলে। তাই অল্প শব্দ ব্যবহার করে মূলত ঘটনার নির্যাসটুকু জানান দিতেই এটি হওয়া উচিত যথেষ্ট স্পষ্ট এবং সাবলীল। কিন্তু ইদানিং এই শিরোনামই হয়ে দাঁড়িয়েছে গলার কাঁটা। বিশেষ করে কোনো নিউজ বা প্রতিবেদনের শিরোনাম। পাঠককে নিউজে ক্লিক করাতেই অনেকক্ষেত্রেই ব্যবহার হচ্ছে যাচ্ছেতাই শিরোনাম। এই যাচ্ছেতাই শিরোনামের ফলেই বড়সংখ্যক পাঠককে টেনে আনতে সক্ষম হচ্ছে গণমাধ্যমগুলো। কারণ যতো ক্লিক ততো আয় এই মনোভাব পোষণ করছে বেশিরভাগ নিউজ আপলোডার।

এমনকি এই মনোভাবে তাল মিলিয়ে যাচ্ছেন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরাও। তারাও যেনো যতো ক্লিক ততো আয়ের সুযোগটি লুফে নিচ্ছেন, যে যেভাবে পারছেন। বর্তমান সময়টা আসলে ডিজিটালাইজেশনের দিকে ঝুঁকেছে। সেটা নি:সন্দেহে বড় ভালো একটি বিষয়। আর তাই পণ্যের বিজ্ঞাপনের কর্তা ব্যক্তিরাও ডিজিটাল এই সেবার পরিসর বাড়িয়ে চলেছেন দিনকে দিন।  এই ক্লিক বাণিজ্যের গর্তে পড়ে হারাচ্ছে শুধু বিবেক আর সময়। রগরগে শিরোনাম মানুষকে একদিকে যেমন নিউজটিতে ক্লিক করতে বাধ্য করছে তেমনি গালমন্দটাও করতে এক প্রকার উৎসাহিত করা হচ্ছে যেনো। শিরোনাম বিভ্রাটে উপকারের চেয়ে ক্ষতির মাত্রাই বেশি।

একটা রগরগে বা উদ্ভট শিরোনাম দিয়ে এই যে পাঠককে টেনে আনার কৌশল গ্রহণ করেছি সেটা সুদূরপ্রসারী চিন্তা করলে লাভটা কী হচ্ছে সেটা আমার বোধগম্য নয়। বিজ্ঞাপন বাবদ বেশি রিচ করলে হয়তো অর্থ উপার্জন হচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞাপন দাতাদের এটা থেকে কতোটা লাভ বা প্রচার প্রসার হচ্ছে। এ বিষয়ে তারাও যে ভাববেন সেইদিন খুব বেশি দূরে নয়। অযথা একটা নিউজকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তিনশো শব্দ বানাতে পারলেই নিউজে পাঠকের স্থায়িত্ব যেমন বেশি করা যাচ্ছে তেমনি একটা চমকপ্রদ হেডলাইন দিলেই ক্লিকও বেশি।

কিন্তু এই অযাচিত নিউজের কারণে যে পাঠককে টেনে আনা হচ্ছে তাদের হচ্ছে সময় নষ্ট। যার ফলে সেই অপচয়কৃত সময়ের জন্য এক প্রকার বাধ্য হয়ে গালি দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সাংবাদিক বলেন, আর নিউজ পাবলিশার বলেন আর প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরাই বলেন সবাই সেটা হজমও করছেন অবলীলায়। যেনো অর্থের কাছে সম্মানকে বিক্রি করছেন প্রত্যেকে। কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটা হয়ে যাচ্ছে ময়লার ভাগাড়ের স্তূপ, সে খেয়াল কারোরই নেই বললেই চলে। কিন্তু পাঠককে ঠকানো, পাঠকের মধ্যে সম্মানবোধের এই যে ঘাটতি, এর জন্য দায়ী কি এই শিরোনাম বিভ্রাট নয়? দুই লাইনের একটা মানহীন রিপোর্টকে টেনে হিঁচড়ে বিশ লাইন করে মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট করা নয়?

একটা ভালো প্রতিবেদনের নিচে এসে কিন্তু বাজে মন্তব্য সেভাবে লেখা হয় না, যেভাবে এই মানুষঠকানো নিউজগুলোর জন্য লেখা হয়। একটা প্রসঙ্গ পেলেই হলো ভিজুয়াল গণমাধ্যম তবুও কিছুটা লাগাম টানে। কিন্তু পোর্টালগুলোতে একদম মানহীন ঘটনাকেও যেভাবে ফুলিয়ে ফাপিয়ে রগরগে করে একটার পর একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে তা সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে পাঠকের যেমন সময় নষ্ট তেমনি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অযথা কর্মী ব্যয়, মেধার অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। যে প্রতিবেদনে তথ্য, শিক্ষা, জ্ঞান আহরণের কোনো সুযোগই নেই সেই মানহীন প্রতিবেদন কেনো ছাপছি? সামান্য কিছু অর্থের বিনিময় সম্মান বিক্রি করে দিচ্ছি এই বোধটাই যেনো তলানিতে গিয়ে ঠেকছে দিনের পর দিন। নামীদামী অনেক প্রতিষ্ঠানের ওয়েব পোর্টাল থেকে শুরু করে ভুঁইফোড় পোর্টাল, কেউ এই শিরোনাম বিভ্রাটের বাইরে নয়।

এই ক্লিক রিচ আর ডিউরেশনের ফাঁদ যে কখন সুনামির মতো করে পুরো গণমাধ্যমকে ভাসিয়ে নেবে সেটাই এখন শুধু দেখার অপেক্ষা। এই দায় এড়াতে পারে না বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোও। রিচের বিনিময়ে পণ্যের প্রসার বাড়াতে গিয়ে সমাজ, গণমাধ্যম, মানুষের বিবেককে নষ্ট করার পাঁয়তারা চলছে। কারণ ক্লিক রিচ যতোই বাড়ুক তারা কি আদতে তাদের ভোক্তাদের সেখান থেকে খুঁজে পায়? সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে চালিয়ে নিতে মুনাফা অর্জন মৌলিক একটা উদ্দেশ্য বা চাহিদা। তাই বলে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে সব ক্ষতিকে চারপাশে সাজিয়ে রেখে কেবলই অর্থ উপার্জনের পথটি ধরেই চলতে হবে এমন পলিসি থেকে বের হয়ে আসা উচিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের। কারণ অর্থ উপার্জন যেমন আবশ্যিক তেমনি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গঠনের ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা, উদ্দেশ্য, সমাজ গঠনের দায়টাও থাকে। আর গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে এই দায়টা অন্য পেশার চেয়ে অনেকটা বেশি। দিন কেটে যাচ্ছে স্রোতের মতো অর্থ আসছে সেই সুযোগ লুফে না নিয়ে স্রোতের বিপরীতে গা ভাসাবে এমন চিন্তা খুব কম মানুষই করবেন। তবে স্রোতের প্রতিকূলে যদি জীবন থাকে আর স্রোতের অনুকূলে যদি অর্থ থাকে নিঃসন্দেহে মানুষ জীবনটাই কিন্তু বেছে নেবে। কিন্তু অর্থ ধরতে গিয়ে আমরা যেনো পুরো রাষ্ট্র থেকে গণমাধ্যমের অস্তিত্ব মুছে না দিই সেদিকটা ভাবার সময় এসে গেছে। মানুষকে যাচ্ছেতাই গেলাবো কিনা, সমাজটাকে ভালো কিছুর শিক্ষা দেবো কি না এই হ্যাঁ-না এর নৈতিকতাবোধটুকু চর্চাতেই রাখতে হবে।

অস্বাস্থ্যকর খাবার দীর্ঘদিন খেলে যেমন জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা হয়, তেমনি অস্বাস্থ্যকর প্রতিবেদন, শিরোনাম মানুষকে দিনের পর দিন জোর করে গেলানো হলে মানুষই তো আর থাকবে না। তখন হাজার পলিসি গ্রহণ করেও এই ক্লিক রিচের বাণিজ্য আর চাঙ্গা করা যাবে না। ধসে যাবে পুরো গণমাধ্যম।

 

প্রান্তী ছারোয়ার, গণমাধ্যমকর্মী