ভিউ প্রতিযোগিতার ঢেউয়ে কলুষিত হচ্ছে গণমাধ্যম


ভিউ প্রতিযোগিতার ঢেউয়ে কলুষিত হচ্ছে গণমাধ্যম

 

গণমাধ্যম হবে সমাজের দর্পণ। গণমাধ্যম দেখে মানুষ শিখবে, জানবে। তার চর্চা করতে করতে একটা সুন্দর সমাজ, রাষ্ট্র সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হবে। অথচ কোন তারকা কয়টা বিয়ে করছেন, তার বউ বা স্বামী অন্যত্র বিয়ে করছেন, কার সাথে লিভটুগেটার করছেন, কে পরকীয়া করছেন, এসব হিসেব কড়ায় গণ্ডায় হিসেব রাখার কাজটাই করছে অধিকাংশ গণমাধ্যম। এই হিসেব রাখার দায়বদ্ধতা কি গণমাধ্যমের? এসব জেনে জাতি কী শিখছে, পরচর্চা, পরনিন্দার মতো বিষয়টাইতো শিখছে। ভূঁইফোঁড় পোর্টাল, আর ব্যক্তিগত চেতনার অবক্ষয় দিন দিন সব কিছু ছাপিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে ভিউ হিসেবে কাউন্ট করে ময়লা আবর্জনা তাদের গেলানো হচ্ছে। এটা সাংবাদিকতা নাকি সমাজকে নষ্ট করার পাঁয়তারা, সেটাতেই বড় প্রশ্ন রয়ে যায়।

যেনো মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় এখন সাংবাদিকতার বড় কাঁচামাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এসব বিষয় দেখে শুনে ভেতরে ভেতরে ঘৃণা বোধ হচ্ছে। অথচ আমরা পারতাম সমাজের আরো অনেক ভালো, মন্দ দিক তুলে ধরে মানুষের ভেতর মনুষত্ববোধটা ফেরাতে, মায়া মমতার জন্ম দিতে। মানুষের দু:খ কষ্ট তুলে ধরে সমাজের কিছুটা পরিবর্তন আনতে। সমাজের উন্নয়ন তুলে ধরে অন্য দেশের কাছে নিজেদের মর্যাদাটা বাড়াতে। সাংবাদিকেরা যদি নৈতিকতাবিরোধী গল্প লিখতে শুরু করি, সমাজে নৈতিকতার শিক্ষা তাহলে দেবে কে?

এখন যে ধরণের লেখা ছাপা হচ্ছে, যে ধরণের প্রতিবেদন প্রচারিত হচ্ছে, তার একটা বড় অংশই বলা চলে কোনো কাজের নয়। বরং অধিকাংশ গল্প যা রচিত হয়ে প্রচার হচ্ছে, মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে তার অধিকাংশ গল্পই, সমাজটা তলানীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতিপর্বের কর্মশালা, প্রতিটি লাইনে যেনো সেটাই দৃশ্যমান। তারমানে কি ধরে নিতে হবে সমাজের ভালো গল্প এখন নেই? অথবা দু:খ দুর্দশা প্রচার করার মতো বিষয়গুলোর কমতি পড়েছে? আমার ব্যক্তিগত মতামত সেটা নয়। আমাদের পরিশ্রম আর লক্ষ্য এখন পথচ্যুত হয়ে খাদের দিক এগোচ্ছে। খুব দ্রুতই হয়তো সমাজকে সঙ্গে নিয়ে সেই খাদে আমরা নিজেরাই পড়তে যাওয়ার রাস্তাকে প্রশস্ত করে চলেছি মাত্র। যারা আমরা সাংবাদিকতার কাজটা করছি হেলাফেলাভাবে, তারাও যে খাদের বাইরে থাকবে বিষয়টি কিন্তু মোটেও সেরকম নেই। এখনকার প্রজন্ম যা দেখছে, শুনছে তারই চর্চা করতে শিখবে। তার প্রভাবটাই ঘর থেকে শুরু করে সমাজ রাষ্ট্রকে পুরোপুরি নাজেহাল করে ছাড়বে।

আজ থেকে মাত্র এক দশক আগেও যদি পেছন তাকানো হয় তাহলেই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মিলবে। এখনকার আর তখনকার তরুণ প্রজন্মের যে দেখার দৃষ্টি আর সমাজের যে দেখার দৃষ্টি সেটা কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে। সমাজে এতো বিশৃঙ্খলা কেনো দেখা দিচ্ছে? একজন গণমাধ্যমকর্মী হোক আর গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারক হোক তাদের পরিবার পরিজন কি সমাজের বাইরের কেউ?

এখন কয়জন সাংবাদিক এমন কাজ করছেন যিনি তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেই কাজের জন্য আইডল হিসেবে আখ্যায়িত হবেন? দশক ধরে কাজ করলেও মনে হয় না মনে রাখার মতো কোনো কাজের জন্ম দিতে পারছেন। এমন সংখ্যা হিসেব করলে, নেই-এর তালিকাটাই কিন্তু বড় হবে।

এ দায় শুধু গণমাধ্যমকর্মীদের সেটা বলা ভুল হবে, এ দায় নীতিনির্ধারকদেরও রয়েছে। বেতন মিলছে আর প্রতিদিন এসে ভেতর থেকে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উগরে দেয়ার মতো কিছু কাজ বেতনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে চলেছেন অধিকাংশ গণমাধ্যমকর্মী। যে কাজে আপাতদৃষ্টিতে অর্থনৈতিক লাভ আছে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো সুফল নেই। আর এখন ছুটছেও মানুষ সেই অর্থের দিকে। কিন্তু সমাজের দিক দিয়ে দেখলে মহান পেশা সাংবাদিকতা ভিউ প্রতিযোগিতার ঢেউয়ে কলুষিত হচ্ছে।

 

প্রান্তী ছরোয়ার, গণমাধ্যমকর্মী