নীতিহীন হলুদ সাংবাদিকতা যেন না হয়


নীতিহীন হলুদ সাংবাদিকতা যেন না হয়

দেশে সাংবাদিকদের বৃহৎ সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর। এই উপলক্ষে চার দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন। সে আনুষ্ঠানিকতা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  সম্প্রতি রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত প্রথম পর্বের এই কার্যক্রমে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নীতিহীন সাংবাদিকতাটা যেন না হয়। মানুষকে বিভ্রান্ত করে যে হলুদ সাংবাদিকতাটা, সেটা যেন না থাকে। সাংবাদিক সমাজের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের বলব আপনারা দায়িত্বশীলতা নিয়ে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে কাজ করবেন। কারণ, এই রিপোর্টগুলো অনেক সহযোগিতা করে।’ তিনি বলেন, বিভিন্ন পত্রিকায় অনেক সময় অনেক ঘটনা আসে সেসব রিপোর্ট পড়ে সাথে সাথে আমরা অনেক অসহায় মানুষের পাশে যেমন দাঁড়াই, আবার অন্যায় ঘটনা ঘটলে তার প্রতিকারও করতে পারি। অনেক দোষীকে শাস্তি দিতে পারি এবং দিয়ে থাকি। তিনি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় আপনারা অনেক ঝুঁকি নিয়ে রিপোর্ট করেন সেজন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

নীতিহীন সাংবাদিকতা পরিহারের জন্য বঙ্গবন্ধুর এক ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাংবাদিকতায় আমরা নিরপেক্ষতা চাই, বাস্তবমুখিতা চাই এবং দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে এটা হয় সেরকমই আমরা চাই। নীতিহীন সাংবাদিকতা কোনো দেশের কল্যাণ আনতে পারে না বরং ক্ষতি করে।’ তিনি অতীতের উদাহরণ টেনে বলেন, একটি সময় আমাদের দেশে ছিল যতই দুর্নীতি হোক যতই অন্যায় হোক সেগুলোকে ধামাচাপা দেয়া হতো। আর সমস্যাগুলো ওই যে কথায় বলে যে কার্পেটের তলে লুকিয়ে রাখা। আমাদের সরকারে কিন্তু আমরা তা করছি না।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেখানে যা রিপোর্ট হচ্ছে বা আমরা খবর পাচ্ছি, কোথাও কোনো দুর্নীতি বা অন্যায় হলে, আমরা কিন্তু এটা চিন্তা করি না- এর পেছনে আমাদের দল জড়িত, এখানে সরকারের বদনাম কিংবা দলের বদনাম হবে। আমরা চিন্তা করি, এখানে অন্যায় হয়েছে তার বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।’ ‘তবে, এটা নিতে গেলে হয় এমন-অনেক সময় দোষটা আমাদের ওপর এসে পড়ে। অনেকে বলে আওয়ামী লীগ সরকারই বুঝি দুর্নীতি করছে, ঘটনা তা নয়। কারণ, দুর্নীতির বীজ বপন করে গেছে ’৭৫-এর পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সরকারগুলো’, বলেন তিনি।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেখানে দুর্নীতি পাচ্ছে, সে দলের যত বড় (নেতা), কর্মী হোক যেই হোক, আমরা কিন্তু সাথে সাথে ব্যবস্থা নিচ্ছি। হ্যাঁ, তাতে অবশ্য আমাদের বিরোধীদের বলার বা লেখার সুযোগ হচ্ছে যে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি করছে।’ ‘কিন্তু এই কথাটা কেউ চিন্তা করছে না, আওয়ামী লীগ দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী নিজেকে সাংবাদিক পরিবারেরই একজন সদস্য উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজেও তার জীবনে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সাপ্তাহিক মিল্লাত এবং ইত্তেহাদ পত্রিকায় এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা করেন এবং নতুন দিন নামে আওয়ামী লীগের জন্য নিজেও একটি পত্রিকা বের করেন। বঙ্গবন্ধু সাপ্তাহিক বাংলার বাণীও বের করেন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘সাংবাদিকতার সাথে তার (বঙ্গবন্ধু) সবসময় একটা সম্পর্ক ছিল।

‘জাতির পিতার খুনিদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলাদেশের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনায় তার সরকারের যে লক্ষ্য ছিল তা বর্তমানে অনেকাংশেই সফল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ বললে (বহির্বিশ্বে) মানুষ যেন একটু সম্মানের চোখে দেখে এবং মর্যাদা দেয়। বর্তমানে এইটুকু দাবি আমরা করতে পারি এবং অল্পসময়ের মধ্যে আমরা সেই অবস্থাটা অর্জন করতে পেরেছি।’

প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালে জাতির পিতার সংবাদপত্র শিল্পেরও পুনরুজ্জীবনের তথ্য উল্লেখ করে বলেন, ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরু হওয়ার পর তারা অনেকগুলো পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেয় এবং প্রত্যেকটিতে হামলা চালায়। শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এমন একটা অবস্থা হয় যে এসব পত্রিকা চালানো সংবাদপত্র মালিকদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই উদ্যোগ নিয়ে সাংবাদিকদেরকে সরকারি চাকরি দিয়েছিলেন। সরকারি বেতন সবাই পেতেন। প্রপাগান্ডার রাজনীতিতে সেটাকে অন্যভাবে দেখা হয়েছিল উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘সেটাকে অন্যভাবে দেখা হয় যে, উনি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছেন। ঘটনা কিন্তু তা নয়, তখন কারো (সংবাদপত্র মালিক) সাংবাদিকদের বেতন দেয়ার মতো, বা সংবাদপত্র চালানোর আর্থিক সেই ক্ষমতা ছিল না। সেই দায়িত্বটা জাতির পিতাই নিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য এটা আমার নিজের দেখা যারা সরকারি চাকরি পেয়েছিল তারাই বেশি সমালোচনা করত।’ বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার ৯ মাসের মধ্যে যে সংবিধান প্রণয়ন করেন, এর ৩৯ অনুচ্ছেদে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উল্লেখ রয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেখানে তিনি স্পষ্ট লিখেছেন চিন্তা, বিবেক এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই চিন্তা, বিবেক এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাটা ভোগ করতে গেলে অপরের প্রতি যে দায়িত্ববোধ, দেশের প্রতি যে দায়িত্ববোধ, রাষ্ট্রের প্রতি যে দায়িত্বরোধ সেই দায়িত্বরোধটাও থাকতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় সংবাদ শিল্পের উন্নয়নে তার সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপগুলোর উল্লেখ করে বলেন, জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা এবং গণমাধ্যম কর্মীদের চাকরির সুরক্ষায় বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা তার সরকার প্রণয়ন করেছে, যা আগে কখনো ছিল না। তা ছাড়া স্বাধীন সম্প্রচার কমিশনও সরকার গঠন করে দিয়েছে এবং এই সম্প্রচার কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সম্প্রচার আইন প্রণয়নেরও কাজ চলছে। যাতে বাস্তবমুখী কাজ হয় এবং অহেতুক মানুষকে বিভ্রান্ত করে সেই হলুদ সাংবাদিকতাটা যেন না থাকে। আর অনলাইনেও মানুষের কল্যাণমুখী একটি দৃষ্টি যেন থাকে এবং সে ধরনের সাংবাদিকতাই যেন হয়, বলেন তিনি। অতীতে সাংবাদিক নির্যাতনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগে একটি মামলা হলেই চট করে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হোত। আমরা কিন্তু সে ক্ষেত্রেও পেনাল কোড সংশোধন করেছি। যাতে সাংবাদিকদের হয়রানির সম্মুখীন হতে না হয়।’

গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম। গণভবন প্রান্তে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্রান্তে থেকে রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি, উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান শাহজাহান সরদার। সভাপতির বক্তৃতায় শাহজাহান সরদার বলেন, রিপোর্টার্স ইউনিটির বিউটি হচ্ছে নিজেদের ইউনিটি। এ সংগঠনে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। ভবিষ্যতেও সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন- এ প্রত্যাশা করি। এখানে নানা মতাদর্শের মানুষ আছেন, কিন্তু এ সংগঠনের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ।

ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিল। আজও সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। তিলে তিলে আজ এ সংগঠনের পরিধি জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটা হয়েছে এ সংগঠনের কর্মের মধ্য দিয়ে। আগামীতেও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এ ধারা অব্যাহত রাখবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, পেশাগত জঞ্জাল নিরসনের লক্ষ্যে আজ থেকে ২৫ বছর আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। অনেক চড়াই-উতরাই ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই সংগঠনটি আজ এখানে এসেছে। তাই পেশাগত জঞ্জাল নিরসনের কাজে কোনো আপস করা যাবে না। এসময় রজতজয়ন্তী উপলক্ষে সংগঠনের সদস্যদের আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান তিনি।

উদযাপন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও ডিআরইউর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে যেন রাজনৈতিক বিভাজন না থাকে। ডিআরইউর নির্বাচন স্বাধীনভাবে হোক। কোনো দলীয় ফোরাম অনুযায়ী যেন প্যানেল না হয় সেজন্য সবার প্রতি বিশেষ অনুরোধ করছি।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, ডিআরইউর সিনিয়র সদস্য আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, রফিকুল ইসলাম রতন, ডিআরইউর সাবেক সভাপতি শফিকুল করিম, শাহেদ চৌধুরী, জামাল উদ্দিন, ইলিয়াস হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন লিটন, সাজ্জাদ আলম খান তপু, রাজু আহমেদ, সৈয়দ শুকুর আলী শুভ, কবির আহমেদ খান। রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও ডিআরইউর সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সহ-সভাপতি নজরুল কবীর এবং সদস্য সচিব ও ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন ডিআরইউর সাংগঠনিক সম্পাদক হাবীবুর রহমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যনির্বাহী সদস্য মঈনুল আহসান ও আহমেদ মুশফিকা নাজনীন।

ডিআরইউ রজতজয়ন্তীর দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ২৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার। এদিন রজতজয়ন্তীর শোভাযাত্রার পাশাপাশি আইডিইবি ভবনে ‘বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সংকট ও সম্ভাবনা: বর্তমান প্রেক্ষিত’ শীর্ষক একটি স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া একই দিন ‘নারী সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ’ ও ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের আইন’ শীর্ষক দুটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।

তৃতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ৩০ অক্টোবর শুক্রবার আইডিইবি ভবনে। এদিন ‘রিপোর্টার্স চ্যালেঞ্জ: রিয়েল নিউজ ভার্সেস ফেক নিউজ’ শীর্ষক একটি সেমিনার ও ‘বঙ্গবন্ধু-ডিআরইউ বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ‘ভিউ এক্সচেঞ্জ: রিপোর্টার্স অ্যাক্রস দ্য গ্লোব’ শীর্ষক অনলাইনে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। শেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ৩১ অক্টোবর শনিবার। এদিন মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামে ডিআরইউর সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বনাম বর্তমান কমিটির সঙ্গে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া এদিনের দ্বিতীয় পর্বে সমাপনী ও সাংস্কৃতিক পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।