বাঁকা চোখে দেখা: সাংবাদিকতা, মিডিয়ামাফিয়া ও নিরপেক্ষর পক্ষ


বাঁকা চোখে দেখা: সাংবাদিকতা, মিডিয়ামাফিয়া ও নিরপেক্ষর পক্ষ

বাঁকা চোখে দেখা: সাংবাদিকতা, মিডিয়ামাফিয়া ও নিরপেক্ষর পক্ষ
মাকসুদুল হক

গেল কয়েকদিনে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের স্বাস্থ্য- মন্ত্রণালয়ে অবৈধ আটক, জেলে প্রেরণ ও দ্বিতীয় দফা শুনানির পর জামিন মঞ্জুরের ঘটনা বেশ কিছু অপ্রীতিকর সত্য আমাদের মুখোমুখি করেছে।

আমরা যা-কিছু দেখেছি, শুনেছি ও পড়েছি তা হয় রাষ্ট্র অথবা মিডিয়ার ভাষ্য। যেহেতু তৃতীয় কোনো পক্ষ নেই এ-দুটি পক্ষের যে-কোনো একটির কথা বাছাই করে বিশ্বাস করা ছারা কোনো উপায় কি আছে? এই অটল সাদাকালো চিত্র ছাড়া মস্তিষ্কের ছাইরঙা পদার্থ ব্যবহার করে রংধনুর বিভিন্ন রং অনুসন্ধান করা কি কোনো অপরাধ নাকি পাপ?

রাষ্ট্র ও মিডিয়া উভয়ই এক অপরের সম্পূরক। দিবানিশি ‘জনগণের স্বার্থ’ ছাড়া অন্য স্বার্থের ধার ধারেনা বললেও তাদের সব কথাই কি বিশ্বাসযোগ্য? এক অপরের পিঠ চুলকিয়ে ‘কি আরাম' বলে অথচ ‘খামচি’ লেগে গেলেই আক্কেলগুড়ুম - অন্ধের মতো এদিক সেদিক হাতাতে থাকে, পায় না কুল কিনারা! প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার এই তথাকথিত নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করা কি অন্যায়, ‘বেয়াদবি’, নাকি ‘অগণতান্ত্রিক’?

নিরপেক্ষের পক্ষ বাংলাদেশে অস্তিত্ব না থাকলেও বহির্বিশ্বের বহু দেশে আছে। তাদের বলা হয় ইন্ডিপেন্ডেন্ট এন্ড ফ্রি মিডিয়া, যারা জনগণ ছাড়া কারো পক্ষ নেয় না, বা কোনো স্বার্থের তোষামোদি করে মন, মেধা ও মস্তিষ্ক বিক্রি করে না।

বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ হতদরিদ্র জনগণের অতি নগণ্য একজন আমি, এবং দাবি করছি এই দারিদ্রই আমাদের শক্তি। সেই দাবির উপরে ভর করে কিছু তিক্ত প্রশ্ন করবার অধিকার নিশ্চই আরো দশজনের মতো আমারও আছে। সেই মুক্তচিন্তার অধিকারের বলে, নিরপেক্ষের পক্ষ থেকে আমার এই পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান, জনগণের সুবিধার্থে প্রেরণ করছিঃ

মূল বিষয় হচ্ছে দুর্নীতি - এবং সরকারি মন্ত্রী-মিনিস্টার, আমলা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কেরানী, পিওন, ড্রাইভার পর্যন্ত সবই ঘুষ খায়, অর্থ আত্মসাৎ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা আপাদমস্তক দুর্নীতিপরায়ণ - এসব কি ‘নতুন’ কোনো কেচ্ছা? পক্ষান্তরে মিডিয়া যে শতভাগ ‘দুর্নীতি মুক্ত’ সত্তা, তা কি বিশ্বাসযোগ্য? ঝেড়ে কাশি দিয়ে অনেকে না বলতে চাইলেও - আমি চুপ থাকতে নারাজ।
 
যা অনস্বীকার্য, এই ভয়াল মহামারীর মাঝেও রাষ্ট্রের বহু কর্মচারী নির্লজ্জ ভাবে দুর্নীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়াতে এ নিয়ে গেলো এক বছরেরও অধিক সময় এ-ধরনের একাধিক রিপোর্ট আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। জাতির এই ক্রান্তিলগনে এহেন ঘৃণিত কার্য কেবল অপরাধ নয়, এ ক্ষমা-অযোগ্য পাপ।

তবে দুর্নীতির জন্মবীজ কিভাবে বপন করা হয় ও তার ব্যবসা/ ধান্দার সাথে সম্পর্ক তা নিয়ে আলোকপাত করা যাকঃ

দুর্নীতির শক্ত ভিতে গোড়াপত্তন করার মুল উপকরণ, অযাচিত ক্ষমতা। সেই স্বৈরশাসকদের আমল থেকে ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ আমল পর্যন্ত অযাচিত ক্ষমতায় নেপথ্যে দেখা গেছে কে কজন মন্ত্রী মিনিস্টার, আমলা, সচিব বা তাদের পিএস ছাড়াও কজন ‘দলের উচ্চপর্যায়ের’ নেতা, পাতি নেতা এমনকি দলীয় মাস্তানের সাথে নিজের কতটা ‘খাতির’ সেটাই মুখ্য। এসকল ‘যোগ্যতার’ বলে কে কতটা ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, ক্ষমতাবান, বা ক্ষমতার করিডোরের কতটা কাছাকাছি, তা নির্ণয় করা এখন হয়ে গেছে আমাদের স্বভাবসুলভ দস্তুর।

সমস্যা হচ্ছে এই ‘ক্ষমতার’ বলে যেকোনো টাউট বাটপার বা ‘স্মার্ট চোর’ দেশের হতদরিদ্র জনগণের টাকা বছরের পর বছর লুণ্ঠন করে পাচ্ছে সমাজে স্ট্যাটাস, সেলুট, সালাম আর আদাব, পাচ্ছে অভিজাত শ্রেণীতে খুব সহজ অভিগমন।

‘অপরাধ যে করে আর অপরাধ যে সহে - আইনের চোখে দুজনই অপরাধী’ - এসব স্বচ্ছ গালভর্তি বুলি একসময় শুনতে পেতাম, কিন্তু আজ দুর্নীতির এই ‘স্বাভাভিকরণের’ খপ্পরে পরে আমরা যে সবাই দুর্নীতি না-করেও নিভৃতে ‘দুর্নীতিবাজ’ হয়ে যাচ্ছি, এ কথা কি কেও স্বীকার করছি?

০১/১১র পরবর্তী সময়টাতে যদি একটু মননিবেশ করি, দেখা যাবে তথাকথিত কিছু বিজ্ঞ লোক, ধনী, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী সহ পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিকদের ‘নথী ব্যবসার’ হুলস্থূল কান্ড। কজন ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক নেতা ফখরুদ্দিন/মইনুলশাহী গং-এর পা চেটে ফায়দা লুটেছেন, তাও আমরা বেমালুম ভুলেই গিয়েছি। এখন এসব লোকই জনগণের ‘নৈতিকতার অভিভাবক’ সেজে আমাদেরই উপর ছড়ি ঘুরাচ্ছেন? বাহ! কি দাম্ভিকতা।

সত্যি আমরা একটা অদ্ভুত জাতি! যতই নিজেদের ধুরন্ধর মনে করি, যতই ফেইসবুক টিপাটিপি করে বিপ্লবী, প্রগতিশীল বা ‘আধুনিক’ মনে করি - সত্যটা হচ্ছে আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি ও আমাদের এই গণতন্ত্রের অপর নাম ‘ঐচ্ছিক গবেটতন্ত্র’, এবং তার নির্ভেজাল নেতৃত্ব দিচ্ছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া বা গণমাধ্যম।

প্রবাদবাক্য ও বাস্তবতাঃ “চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পরো ধরা”- এই ‘কর্পোরেট মিডিয়ার’ জামানায় কে কার চেয়ে কত বড় চোর তা ‘প্রমান’ করা হয়ে উঠেছে আমাদের একমাত্র হালাল বিনোদন। এক চোর আরেক চোরের চুরি চূড়ান্ত না করা অব্দি এক বীভৎস ধুম্রজাল সৃষ্টি করে বোকা জনগণকে ধোঁকা বারবার দিয়েই যাচ্ছে। যখন দেখবেন সবকিছু ‘ব্যাক টু নরমাল’ আর কোনো ‘চোর চোর’ উচ্চবাচ্য নেই, আমরা শিউর হতে পারি হয় ‘কেইস ফিট’ বা ‘নেগোসিয়েশন’ চলছে। রোজিনার আটক থাকার সময় একইরকম নেগোসিয়েশন চলেছিলো ৫ ঘণ্টার অধিক সময় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে নেগোসিয়েশন কেন ‘ব্যাকফায়ার’ করলো তা বোঝার জন্য ধ্যানে দিয়ে এই লেখাটা পড়তে থাকুন।