স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা


স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা

স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আমরা প্রায়ই রাষ্ট্রীয় বাঁধার কথা বলি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাঁধা তো অনেক পরের ঘটনা! বড় কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ এলেই আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতার আসল চিত্র বেরিয়ে পড়ে!
এই যে ঘটনা দেখেন, গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মেয়েটির বাবা কুমিল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান। পুলিশ ও পরিবার বলছে, মেয়েটি রোববার তাঁর বড় বোনকে ফোন করে বলেন, তিনি ঝামেলায় পড়েছেন।
এই ফোন পেয়েই মেয়েটির বড় বোন সোমবার কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন। সন্ধ্যার দিকে গুলশানের ওই ফ্ল্যাটে যান তিনি। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করলেও বোন দরজা খুলছিলেন না। এরও কিছুক্ষণ আগে থেকে বোনের ফোন বন্ধ পাচ্ছিলেন। পরে বাইরে থেকে ‘লক’ খুলে ঘরে ঢুকে বোনকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখেন। পরে তিনি বাড়িওয়ালাকে বিষয়টি জানান। তখন পুলিশে খবর দেওয়া হয়।
গুলশান থানা পুলিশ বলছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং মুনিয়ার ব্যবহৃত ডিজিটাল ডিভাইসগুলো জব্দ করেছে। এ ঘটনায় মেয়েটির বড় বোন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভিরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। বিস্তারিত উল্লেখ করে বাদীর দাবি, আসামি সায়েম সোবহানের কারণেই তাঁর বোন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।
কারও নাম আসা মানে এই নয় যে তিনি অপরাধী। পুলিশ তদন্ত করবে, বিচার হবে। সাংবাদিকরা লিখবে, অনুসন্ধান করবে। কিন্তু দেখেন এই ঘটনায় আসামির নাম শুনেই আটকে গেছে স্বাধীন সাংবাদিকতা! অথচ রাষ্ট্র-পুলিশ কেউ বলেনি এই অপরাধী নাম লেখা যাবে না। অবশ্য নাম লেখা তো পরের কথা, বসুন্ধরার সাত মিডিয়াসহ অধিকাংশ গণমাধ্যম এই নিউজটাই করেনি। সেখানকার সম্পাদক বা শত শত সাংবাদিকের প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা এ নিয়ে কারও টু শব্দ করার সাহস নেই।
অন্যদিকে নিরপেক্ষ আর সাহসী সাংবাদিকতার দাবিদরা বহু পত্রিকা দায়সারা ভাবে নিউজটা করলেও আসামির নামটা লেখার সাহস করেনি। সেখানকার সাংবাদিকদেরও এ নিয়ে কিছু বলার নেই। অথচ দেখেন এই ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান হতে পারতো। এর আগে সাব্বির হত্যা মামলার কী হয়েছিল সেটার ফলোআপ হতে পারতো। ক্ষমতাশালীদের এসব অপরাধের বিচার শেষ পর্যন্ত কেন হয় না, বিচাররে নামে সরকারি-বেসরকারি লোকজন কার কী ভূমিকা, কে কতো টাকা ঘুষ নেয়, সব কিন্তু হারিয়ে যায়। অথচ গণমাধ্যম সেগুলো দেখে না।
 
 
অনেকবার লিখেছি, বলেছি। আমার ১৮ বছরের কম-বেশি সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতায় জানি, রাষ্ট্র বা সরকার অনেক সময়েই স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এটা পৃথিবীর সব দেশে কম-বেশি হয়। কিন্তু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান সাথে থাকলে এই লড়াইয়ে ভয় পায় না সাংবাদিকরা। কিন্তু তারা ভয় পেতে বাধ্য হয় নিজের মালিক বা সম্পাদককে।
এই ভয়ের কারণ, নিজের গণমাধ্যমের স্বার্থ যখন আসে, যখন সম্পাদক-মালিকের স্বার্থ আসে, তাদের পছন্দ-অপছন্দ আসে, তখন কিন্তু থেমে যেতে হয় সাংবাদিককে। কারণ মালিক বা সম্পাদক না চাইলে তো নিউজ যাবে না। কাজ করাও সম্ভব নয়। আসলে সাংবাদিকদের কোন স্বাধীনতা নেই। সম্পাদক বা মালিকের স্বার্থই আসল স্বার্থ।
কতো ধরনের স্বার্থ শুনবেন? ব্যবসায়িক স্বার্থ, বিজ্ঞাপনের স্বার্থ, আত্মীয়তার স্বার্থ, সম্পাদকের ছেলের স্বার্থ, সম্পাদকের জামাইয়ের স্বার্থ, মালিকের স্বার্থ, মালিকের ছেলের স্বার্থ! আরও কতো কতো স্বার্থ যে আছে! আর এইসব স্বার্থের বলি হয় সত্যিকারের সাংবাদিকরা।
আমি এই সংকটটাকে দুইভাগে ভাগ করবো এখানে। এক ধরনের গণমাধ্যম আছে যেখানে বেতন-বোনাস পাওনা ঠিকমতো দেওয়া হয় না। মালিক-সম্পাদকরা এখানে পত্রিকা বা গণমাধ্যেম চালান নিজের স্বার্থে। ইচ্ছে হলে তারা বেতন দেবেন, নয়তো না। মফস্বলে তো বেতনের আরও বালাই নেই। উল্টো কার্ড দিয়ে বলা হয়, করে খাও। পারলে ঢাকায় দাও।
আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে বেতন-বোনাসের সমস্যা ওতোটা নেই কিন্তু সেখানে সম্পাদক-মালিক তাদের স্বার্থবিরোধী কোন নিউজ ছাপবে না। এখানে দেখবেন, মালিক, সম্পাদক-সম্পাদকের ছেলে বা স্বজনদের স্বার্থবিরোধী হলে আপনার নিউজ ঠিকমতো, ছাপবে না, বিট বদলে যাবে, মানসিক অশান্তি তো আছেই! আপনি টেরও পাবেন না সম্পাদক বা মালিক আপনাকে কতো ধরনের বিপদে ফেলে দেবে। আপনি তখন হয় সাংবাদিকতা ছাড়বেন নয়তো প্রতিষ্ঠান। যেমনটা আমি করেছিলাম অভিমানে। আর কোন কারণে ছাড়তে না পারলে আপনি থাকবেন মানসিক অশান্তিতে। এই অশান্তির শেষ নেই। বাংলাদেশের বেশিরভাগ সৎ সাংবাদিক এই অশান্তিতে ভোগেন।
কাজেই মোটাদাগে যদি বলি, আমাদের দেশে সাংবাদিকতায় দুটি বড় প্রতিবন্ধকতা। একটা রাষ্ট্রের যেটা সবসময়ই কম বেশি ছিল। আরেকটা প্রতিষ্ঠানের। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এই দেশের সাংবাদিকরা বিশেষ করে যারা সৎ ও সাহসীভাবে সত্যিকারের সাংবাদিকতা করার স্বপ্ন নিয়ে এই পেশায় এসেছিলেন বা এখনো আছেন তারা সত্যিকারের সাংবাদিকতার জন্য ঝুঁকি নিতে ভয় পান না। তাদের মূল ভয় নিজের প্রতিষ্ঠানের মালিক-সম্পাদকের স্বার্থ।
এই স্বার্থের কারণে এখানে বহু নিউজ হারিয়ে যায়। আবার কখনো দেখবেন, কখনো কখনো কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিউজ ছাপা হলো তো কিছুদিন পরেই আবার সেই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন আসবে। আজকে আপনি যার অন্যায়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখলেন কাল তার বিজ্ঞাপন ঝোলানোটা যে এক ধরনের দুর্নীতি সেটা এরা ভুলে যান বা ভুলে থাকেন। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক-সম্পাদকের এসব স্বার্থের কারণেই সত্যিকারের সাংবাদিকরা কষ্ট পান। অশান্তিতে থাকেন।
অন্যদিকে যারা অসৎ, যারা সম্পাদক বা মালিকের সাথে খাতির রাখেন তাদের কিন্তু কোন সমস্যা নেই। অসৎ এই লোকদের ফ্লাট হবে, গাড়ি হবে, বাড়ি হবে। আর মালিক সম্পাদক আর তাদের স্বজনরাও ভালো থাকবে! এভাবেই চলছে এই দেশের গণমাধ্যম!
এসব কারণেই বলবো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে মালিক বা সম্পাদকের স্বাধীনতা না হয়ে সত্যিকারের সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হওয়া উচিত। সাংবাদিকতার এইসব সংকট নিয়ে একাডেমিক আলোচনা হওয়া উচিত। আমাদের মনে রাখা উচিত, গণমাধ্যম যদি প্রতিষ্ঠান হিসেবে না গড়ে উঠে এই সংকট কখনো শেষ হবে না। শুধু সাংবাদিকতা নয়, এদেশের প্রতিটা পেশায় যন্ত্রণটা বোধহয় কম বেশি এমনই। আপনি সৎ হলে সমস্যা। দুর্নীতিবাজ অসৎ হলে সমস্যা নেই।
শেষ করছি শুরুর কথাটা আবার বলে। এই দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সরকার থেকে যতোটা না বাঁধা আসে, এটা নিয়ে যতো না আমরা কথা বলি, তার চেয়ে অনেক বড় বাঁধা আসে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে। সম্পাদক, মালিক বা ক্ষমতাশালীদের নানা স্বার্থে এখানে যে সেলফ সেনসরশিপ হয় সেটাই স্বাধীন সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় হুমকি।