বাংলাদেশের ডাকটিকিট ইতিহাস


বাংলাদেশের ডাকটিকিট ইতিহাস

আমার বাবা যেহেতু সরকারী চাকুরী করেন, সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের পরিত্যাক্ত চিঠি থেকে ডাকটিকিট সংগ্রহ করতাম। এদিকে মামারা বিদেশে থাকায় প্রায় প্রতিমাসেই তাদের চিঠিও আসতো। সেই চিঠি থেকেও সংগ্রহ করতাম ডাকটিকিট। সে সব এখন স্মৃতি। আজকাল যখন ই-মেইল, মোবাইল এসএমএস, কিংবা বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আত্মীয় কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করি তখন ছোটবেলার আদর-ভালোবাসামাখা সে সব চিঠি আর ডাকটিকিট সংগ্রহের কথা খুব মনে পড়ে।

তবে রাষ্ট্রীয় জীবনে ডাকটিকিট এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মূলত: একটি রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে ডাকটিকিট। চিঠির খামে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের নীরব দূত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে ডাকটিকিট। স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকটিকিটের সূচনা কীভাবে হয়েছিলো, দেখতেই বা কেমন ছিলো সে সব ডাকটিকিট- এ নিয়েই আজকের লেখা।

১৯৭১ এ যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, তখন মুজিবনগর সরকার রাষ্ট্রীয় কাজে চিঠিপত্র ব্যবহার করতো। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো পাকিস্তানের নামাঙ্কিত ডাকটিকিট। যুদ্ধকালীন সময়ে, মুজিবনগর সরকারের কাছে নতুন করে ডাকটিকিট ছাপানোর সময় ছিলো না। তাই ডাকটিকিটের উপর থেকে পাকিস্তানের নাম মুছে দিয়ে রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ ছাপ দিয়ে কাজ চালানো হতো।

জন স্টোনহাউজ 

জন স্টোনহাউজ ও স্বাধীন বাংলাদেশের ডাকটিকিট: মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ক’জন আন্তর্জাতিক বন্ধু বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে জন স্টোনহাউজ একজন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ এমপি এবং ব্রিটেনের পোস্টমাস্টার জেনারেল। সেই সুবাদে তিনি জানতেন কীভাবে একটি দেশের নিজস্ব ডাকটিকিট ছাপানো এবং প্রচার করতে হয়। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছে- তার বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ডাকটিকিট যে অন্যতম মাধ্যম হতে পারে- স্টোনহাউজ সেটি বুঝে গিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মে মাসে জন স্টোনহাউজ কলকাতায় আসেন এবং বিষয়টি নিয়ে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন। স্বাধীনতার পরে স্টোনহাউজের লেখা আত্মজীবনী ‘Death of an Idealist’ এ তিনি উল্লেখ করেন, মুজিবনগর সরকারের কাছে এই প্রস্তাবটি দেওয়ার পর তারা প্রস্তাবকে স্বাগত জানান এবং তাকে পুরো কাজের দায়িত্বভার দিয়ে দেন। ‘Death of an Idealist’বইয়ে তিনি লিখেছেন,

I decided to step up the campaign in Britain and to try to establish such a powerful lobby for Bangla Desh that even Governments would have to listen. I suggested to Tajuddin and Mansoor Ali the Minister of Finance who was also present that Bangla Desh should issue postage stamps which could be used for mail from the liberated areas and which would also be excellent propaganda to establish the fact of the existence of Bangla Desh.

বাঙালি ডাকটিকিট ডিজাইনার বিমানচাঁদ মল্লিক

১৯৬৯ সালে ব্রিটেনের পোস্টমাস্টার জেনারেল থাকার সময়ে জন স্টোনহাউজ মহাত্মা গান্ধীর জন্মশতবার্ষিকী উৎযাপন উপলক্ষ্যে একটি ডাকটিকিট বের করেন। সেটি ছিল প্রথমবার কোনো বিদেশি নেতাকে স্মরণ করে ব্রিটেন থেকে বের হওয়া প্রথম ডাকটিকিট। সেই আয়োজনে অনেক খ্যাতিমান ডিজাইনারের পাশাপাশি এসেছিলেন এক বাঙালি ডিজাইনার, যাঁর নাম বিমানচাঁদ মল্লিক। ঘটনাক্রমে তিনিও প্রথম বিদেশি নাগরিক যিনি ব্রিটেনের কোনো ডাকটিকিট ডিজাইন করার খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৭১ সালে ব্রিটেনে থাকাকালীন সময়ে বিমানচাঁদ মল্লিক বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখছিলেন। গণহত্যার বিরুদ্ধে কিছু একটা করার ইচ্ছেও ছিলো তার। জন স্টোনহাউজ তাকে সেই সুযোগ করে দেন। ১৯৭১ এর ২৯ এপ্রিল স্টোনহাউজ বিমান মল্লিকের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করে জানতে চান, তিনি ডাকটিকিট ডিজাইন করার কাজটি নিতে চান কী না। বিমান মল্লিক সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। অনেক ব্যস্ততার পরও মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের জন্য আটটি ডাকটিকিট এবং একটি ফার্স্ট ডে কাভারের ডিজাইন করেন।

যেহেতু ডিজাইনের জন্য কোনো দিক নির্দেশনা ছিলো না- কত মূল্যমানের ডাকটিকিট হবে সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল বিমান মল্লিককেই। তিনি সিদ্ধান্ত নেন এক পাউন্ড অর্থাৎ ২১ রুপি ৮০ পয়সার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ডাকটিকিটগুলোর দাম। ৮টির মূল্যমান তিনি নির্ধারণ করেন- ১০ পয়সা, ২০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ১ রুপি, ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ ও ১০ রুপি। সেই ডাকটিকিটগুলোতে বাংলাদেশের নাম লেখা হয়েছিল ‘বাংলা দেশ’ এবং মুদ্রা রুপি।

এই বিষয় নিয়ে পরবর্তীকালে বিমান মল্লিক বলছিলেন, যেহেতু কোনো নির্দেশনা ছিল না তাই কাজটি করতে গিয়ে তিনি জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাংলা ভাষার অভিধান’-বইটির সাহায্য নিয়েছিলেন। যেখানে ‘বাঙ্গালা দেশ’ শব্দ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ডাকটিকিটে ‘বাংলা দেশ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ডিজাইন শেষ করে তা তিনি স্টোনহাউজের কাছে পাঠান, সেখান থেকে তা যায় মুজিবনগর সরকারের কাছে। মুজিবনগর সরকারের অনুমোদন পেলে ডাকটিকিটগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

পরের কাজটি করেন জন স্টোনহাউজ। পোস্টমাস্টার জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালনের সুবাদে তিনি ‘E.E Oatway’ নামের একটি কোম্পানিকে এই ডাকটিকেট ছাপানো এবং এখান থেকে আদায় করা অর্থের বিষয়টি মুজিবনগর সরকারের দায়িত্বে দিয়ে দেন। তার উদ্যোগেই ২৬ জুলাই ১৯৭১ সালে উন্মোচন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব ডিজাইনের ডাকটিকিট। ডাকটিকিট উন্মোচন উপলক্ষে ব্রিটেনের হাউজ অফ কমন্সের হারকোট কক্ষে ছোটোখাটো একটি প্রকাশনা উৎসবের আয়োজনও করা হয়। উৎসবে স্টোনহাউজ, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছাড়াও, ব্রিটিশ এমপি পিটার শোর ছাড়াও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত হন।

কী ছিলো ডাকটিকিটের বিষয়বস্তু

প্রথম ডাকটিকিট, অর্থাৎ ১০ পয়সার ডাকটিকিটে ছিল বাংলাদেশে মানচিত্র। বাংলাদেশের মানুষের ভূখণ্ড, তার দেশের পরিচয় বিশ্বকে জানানো ছিল এই ডাকটিকিটের প্রধান লক্ষ্য। তাই ডাকটিকিটে তিনি খুব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় মাঝ বরারর দিয়ে যাওয়া কর্কটক্রান্তি রেখার কথা উল্লেখ করেন। দ্বিতীয়টি ২০ পয়সার ডাকটিকিট, যেখানে ২৫ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞকে স্মরণ করে ডিজাইন করা হয়েছিল। নিজে একজন শিক্ষক হওয়ার সুবাদে একটি শিক্ষায়তনে হামলাকে তিনি বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাই তো সবুজ জমিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখাটির উপর লাল রক্তের ছোপ দিয়েছেন। পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ম্যাসাকার অ্যাট ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ ডাকটিকিটটি তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল। ৫০ পয়সার তৃতীয় ডাকটিকিটে ৭৫ মিলিয়ন মানুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ৭ এবং ৫ কে একীভূত করে তাদের একত্রে সংগ্রামের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এক রুপির ডাকটিকিটে, বাঙালি জাতির পতাকাকে দেখানো হয়েছে। এছাড়া সেখানে বাংলাদেশের পতাকাখচিত মানচিত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে। সেই পতাকা অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের পরে মানচিত্র সরিয়ে একটু পরিবর্তন করানো হয়। দুই রুপির ডাকটিকিটে ব্যালটবাক্সের ছবি রাখা হয়।

১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা তুলে ধরা হয়েছে। তিন রুপির ডাকটিকিটে দেখানো হয় ভাঙ্গা শিকল। যেখানে বাঙালির শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত করা হয়েছে। পাঁচ রুপির ডাকটিকিটে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন বন্দি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। এই ডাকটিকিটেই তার ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। বাকি সব কয়টিতেই ডিজাইন করা হয়েছে শুধু। ১০ রুপির ডাকটিকিটিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে লেখা ছিলো- 'Support Bangla Desh'। এই ডাকটিকিটটি ছিল সাদামাটা, কিন্তু এর বার্তাটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ। যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি ছিলোএই ডাকটিকিটের ছবির মূল বিষয় ।

পাকিস্তানের আপত্তি 

১৯৭১ সালেই জন স্টোনহাউজের চেষ্টায় বিভিন্ন দেশে এই ডাকটিকিটগুলো পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পত্র পত্রিকায় প্রচারিত হতে থাকে বাংলাদেশের নাম। প্রথম দিনেই ব্রিটেনে ২৩ হাজার ডলারের ডাকটিকিট সংগ্রহ করা হয়। এ সময় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আন্তর্জাতিক পোস্টাল ইউনিয়ন’ এর কাছে জানানো হয় যে, এই ডাকটিকিটের সাথে কোনো দেশের সংযুক্তি নেই, এটি ভিত্তিহীন। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের যে অল্প কিছু মুক্তাঞ্চল ছিল সেই এলাকাগুলোর পোস্ট অফিসগুলোকে প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার বহু বছর পর, ২০১২ সালে বিমান মল্লিককে তার মহান কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকার ‘Friends ofLiberation War Honour’ এ ভূষিত করা হয়। রাষ্ট্রীয় সম্মাননা নিতে প্রথমবার বাংলাদেশে এসে আবেগআপ্লুত হন বিমান মল্লিক।

আর স্টোনহাউজের জীবনজুড়েই ছিল নাটকীয়তা, শেষ জীবনে কিছু কাজের জন্য ব্রিটেনেই সমালোচিত হন তিনি। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা ছিল সত্যিই অসাধারণ। স্বাধীনতার পরে বিমান মল্লিক বাংলাদেশের জন্য একটি কারেন্সি নোট অর্থাৎ ‘টাকা’র ডিজাইনও করেছিলেন। ‘এক টাকা’ এবং ‘দশ টাকা’ মূল্যমানের দুইটি নোটের ডিজাইন করেছিলেন তিনি। তবে বাংলাদেশ থেকে আর কোনো সাড়া না পাওয়ায় সেই ডিজাইন কাজে লাগেনি আর।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা