অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ক্রাইম রিপোর্টিংয়ে নতুন নিয়ম


অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ক্রাইম রিপোর্টিংয়ে নতুন নিয়ম

 

জনগণকে ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ দিতে ক্রাইম রিপোর্টিং চর্চায় পরিবর্তন আনছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এপি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সংবাদ সংস্থা ছোট অপরাধে গ্রেপ্তারকৃতদের নাম আর প্রকাশ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যখন অপরাধের ঘটনাতে সন্দেহভাজনদের নাম উপস্থিত হয়, তখন তাদের জীবনে এটির বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে বলেই এতো বছর পর এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এপি।

বহু বছর ধরেই, ভুক্তভোগীরা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-"এপি" কে অনুরোধ করে, যাতে আর্কাইভ থেকে তাদের পরিচয় মুছে ফেলা হয়। এপি-র স্ট্যান্ডার্ড ভাইস প্রেসিডেন্ট জন ড্যানিসজেউস্কি বলেন, যেসব অনুরোধ আমাদের কাছে আসতো তার মধ্যে কয়েকটি "হৃদয় বিদারক" ছিল। জন ড্যানিসজেউস্কি বিশ্বব্যাপী নিউজ সার্ভিসের নতুন নীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। এপি মনে করে সাংবাদিকতায় ছোট অপরাধের জন্যে যারা গ্রেপ্তার হন তাদের নাম রেখে দেয়ার ফলে পরবর্তীতে সেই নাম বা প্রকাশনাগুলো বিনোদনমূলক কৌতুকের সৃষ্টি করে। তাদের এই নামগুলো অপ্রাসঙ্গিক। হয়তো তাদের অপরাধ ছোট তবে এই নামের প্রভাব অনেক বড় হতে পারে। এছাড়া, যাদের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে সেই ব্যক্তিদের জীবনে এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকান রিপোর্টাররা অপরাধের কাহিনীতে যতটা বিস্তারিত ঘটনা যুক্ত করতে পারেন সংবাদটি ততোটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ছোট গল্পগুলো শুধু একটি ঘটনার প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে হতে পারে। তবে একটি বড় গল্পে আশেপাশের বিস্তারিত ঘটনাগুলোকে নিয়ে আলোচনা হয়। এতে পরিচিতদের সাক্ষাৎকার এবং ব্যক্তির অতীতের গভীর অনুসন্ধান অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে গল্পটি বড় হোক বা ছোট, বেশিরভাগ আমেরিকান সংবাদমাধ্যমে অভিযুক্তদের সম্পূর্ণ পরিচয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ড্যানিসজেউস্কি বলেন, এপি’র কাছে অনুরোধ আসতে থাকে এবং আমরাও দেখতে পাই- অনেককে ছোটখাটো মাদক অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যেমন অল্প পরিমাণে গাঁজা সেবন, কিন্তু সেই অপরাধগুলো নিয়ে যেসব গল্প লেখা হয়েছিলো সেগুলো তাদের চাকরি পেতে, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে এবং এমনকি ডেটিং অ্যাপগুলোতে মানুষের সাথে দেখা করতেও চরম বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, সবচেয়ে বড় আমেরিকান সংবাদ সংস্থা, যা ১৮৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি সমবায় উদ্যোগ যার সদস্যদের বেশিরভাগ মূলধারার আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম এবং অন্যান্য দেশের কিছু সংবাদ মাধ্যমও অন্তর্ভুক্ত। এপি’র নতুন নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও সংস্কৃতির পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দেয়। এটি আমেরিকান ক্রাইম রিপোর্টিংয়ের যে আদি প্রথা ছিলো তা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। এর ফলে ইউরোপের কিছু দেশের সাংবাদিকদের রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে অন্যায়কারীদের প্রতি মানুষের কিছুটা সহানুভূতি তৈরি হয়।

ইউরোপের কয়েকটি দেশের সাথে আলোচনা করে দেশগুলোর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং মূল্যবোধের মিল থাকা সত্ত্বেও এপি সাংবাদিকতা চর্চায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্যগুলি উন্মোচন করেছে। জার্মান, ডাচ এবং সুইডিশ প্রেস কাউন্সিলের নৈতিকতায় সন্দেহভাজন এবং দোষী সাব্যস্ত উভয়ের পরিচয় রক্ষা করতে উৎসাহিত করে। সেসব দেশে সাংবাদিকরা গ্রেপ্তারকৃত বা এমনকি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ নাম প্রকাশ করেন না, শুধু বিশেষ জনসাধারণের উদ্বেগ হতে পারে এমন অপরাধে জড়িত ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করা হয়। এর পরিবর্তে, সংবাদ অ্যাকাউন্টগুলো কেবলমাত্র আদ্যক্ষর বা একটি নাম এবং শেষ নামটি প্রকাশ করে যাতে করে সেই ব্যক্তির আসল পরিচয় গোপন থাকে।

১৯৭৩ সাল থেকে, জার্মান আদালত সংবাদ রিপোর্টে বন্দীদের সনাক্ত করা থেকে বিরত থাকা বাধ্যতামূলক করে। কারণ অপরাধীদের কারাগার থেকে মুক্তি তাদের কাছাকাছি "পুনর্বাসন" এবং "ব্যক্তিত্বের অধিকার" বা খ্যাতির অনুমতি দেয়। এছাড়াও অন্যদের মতে “যদি অপরাধীদের তার সন্তান থাকে? তবে তারা কোন ভুল করেনি, "তবুও তারা অপরাধীর বংশধর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে অপূরণীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই কারণেই অপরাধীদের নাম কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার না করাই উত্তম।

এদিকে, একজন ডাচ সম্পাদক যখন জানতে পারেন, আমেরিকান রিপোর্টাররা গ্রেপ্তারকৃতদের সম্পর্কে কতটা গভীরভাবে ব্যক্তিগত বিবরণ প্রকাশ করে, সেটি শুনে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তিনি একে নিষ্ঠুর এবং অনৈতিক হিসেবে দেখছেন।

এপি যে ১০ টি দেশের উপর গবেষণা করেছে সেখানে সাংবাদিকরা একমত হয়েছেন যে, রাজনীতিবিদদের তাদের সরকারি দায়িত্বের সাথে জড়িত অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হলে তা জনসাধারণকে জানাতে হবে। তাদের মতে যখন একজন রাজনীতিবিদ বা সেলিব্রিটি হিট-এন্ড-রান দুর্ঘটনার মতো একটি বড় অপরাধ করে বলে অভিযোগ করা হয়, তখন প্রেসের উচিত নাম ব্যবহার করা। কারণ রাজনৈতিক অপরাধ জনকল্যাণকে প্রভাবিত করে।

এদিকে, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন বা জার্মানিতে মূলধারার নিউজগুলোতে ব্যক্তিগত অপরাধ, এমনকি বড় ধরণের অপরাধ করা ব্যক্তিদের খুব কমই চিহ্নিত করা হয়। তবে ট্যাবলয়েড এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করা সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই নামগুলো সর্বজনীন রেকর্ডে রয়েছে।

ডাচ সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রধান টমাস ব্রুনিং বলেন "আমরা বিশ্বাস করি যে প্রত্যেকে দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়ার যোগ্য," এপির নতুন নীতির কথা বলতে গিয়ে ড্যানিসজেউস্কি বলেন, "আমরা ভেবেছিলাম যদি আমরা কম ক্ষতি করতে পারি এবং মানুষকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে পারি, তাহলে তা তাদের ভালোর জন্যই হবে।"