একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের দিনরাত


একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের দিনরাত

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক সংগ্রামের পর যেদিন বিজয়ের সূর্য হেসেছিল বাংলার আকাশে, সেদিন কেমন ছিল ঢাকা? নয় মাস অবরুদ্ধ থাকা মানুষগুলোর মুক্তির আনন্দের প্রকাশইবা ছিল কেমন? 

ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১; দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিন ঢাকায় দুপুরের পর বিজয়ের আনন্দে উল্লাসিত মানুষের স্রোত আসতে শুরু করে। সাধারণ মানুষ বিজয় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।

মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি ও এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বীরউত্তম তাঁর ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইয়ে লিখেছেন: ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আলোচনার জন্য দুপুর একটার দিকে হেলিকপ্টারযোগে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী এবং জাতিসংঘের ঢাকা প্রতিনিধি জন কেলি তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান। ব্রিগেডিয়ার বাকের জেনারেল জ্যাকব ও কর্নেল খারাকে (ভারতীয়) নিয়ে পূর্বাঞ্চল (পাকিস্তান) বাহিনীর সদর দপ্তরে পৌঁছান। এয়ার কমোডর পুরুষোত্তম বিমানবন্দরে থেকে যান জেনারেল আরোরাসহ আমাদের অভ্যর্থনার আয়োজন করতে।

জেনারেল নিয়াজীর অফিসে এসে জেনারেল জ্যাকব লক্ষ্য করেন যে, নিয়াজী আর জেনারেল নাগরা পাঞ্জাবী ভাষায় পরস্পরকে একটার পর একটা স্থুল ও আদি রসাত্মক কৌতুক উপহার দিচ্ছেন। সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ খান, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ ও এয়ার ভাইস মার্শাল ইনাম উল হক।

নিয়াজীর সঙ্গে আলোচনার আগে জ্যাকব জেনারেল জি সি নাগরাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈনিক ঢাকায় আনার নির্দেশ দেন এবং ঢাকার নিরাপত্তা, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি যেমন গার্ড অফ অনার, টেবিল-চেয়ার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পাঠিয়ে দেন।

এরপর দুই পক্ষের মধ্যে আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পিনপতন নীরবতার মধ্যে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান এবং খসড়া কপিটি জেনারেল নিয়াজীকে দেন। পাকিস্তানিরা ধারণা করেছিলেন যে আত্মসমর্পণ নয়, যুদ্ধবিরতি হবে। আত্মসমর্পণের সংবাদ পেয়ে তারা বেশ হতাশ হয়ে পড়ে। জেনারেল ফরমান আলী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বিরোধিতা করেন। তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পক্ষে মত দেন। জেনারেল নিয়াজী দলিলটি অন্যদের দেখার জন্য দেন। কেউ কেউ কিছু পরিবর্তনের কথা বলেন।

দলিলে পাকিস্তানিদের পক্ষে বেশকিছু শর্ত ছিল, যেমন পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করা হবে এবং সার্বিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হবে। এমনকি পাকিস্তানপন্থী সব বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তার বিষয়ও দলিলে উল্লেখ ছিল। যা আগে কখনও কোন আত্মসমর্পণের দলিলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পাকিস্তানিরা আরো কিছু সময় নেওয়ার পর আত্মসমর্পণের দলিলে সম্মতি দেয়। এরপর আত্মসমর্পণের পদ্ধতি নিয়ে আলাপ শুরু হয়।

জেনারেল জ্যাকব জানান, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে প্রথমে ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মিলিত দল জেনারেল আরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এরপর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর হবে এবং জেনারেল নিয়াজী তার অস্ত্র ও পদবির ব্যাজ খুলে জেনারেল আরোরার কাছে হস্তান্তর করবেন।

আত্মসমর্পণের পদ্ধতির কিছু কিছু ব্যবস্থায় জেনারেল নিয়াজী গররাজি ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান তার অফিসেই হোক। শর্তগুলোর বিষয়ে জেনারেল জ্যাকবের অনড় অবস্থানের কারণে শেষে জেনারেল নিয়াজী সবই মেনে নেন। তবে আত্মসমর্পণের পরও নিরাপত্তার জন্য তার অফিসার ও সৈনিকদের ব্যক্তিগত অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি চান। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সাধারণত বিজিত সেনাপতি বিজয়ী সেনাপতির সদর দপ্তরে গিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর দেন ও অস্ত্র সমর্পণ করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এর ব্যতিক্রম ঘটানো হয়। এখানে বিজয়ী সেনাপতি বিজিত সেনাপতির এলাকায় গিয়ে জনসমক্ষে অত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন।

হেলিকপ্টারে করে পড়ন্ত বিকেলে আমরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করি। অবতরণ করার সময় দেখি হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জ্যাকব এবং আরো কিছু পাকিস্তানি ও মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তা আমাদের অভ্যর্থনা জানান। এরপর জিপে করে আমরা রমনা রেসকোর্স ময়দানে রওনা হই। রেসকোর্সে আমি জেনারেল আরোরার সঙ্গে তার জিপে করে যাই। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, মানুষের মুখচ্ছবিতে প্রশান্তির ছায়া। রমনার চারপাশে মানুষের ব্যাপক ভিড়। এমন পরিস্থিতিতে ভিড় ঠেলে আমরা উপস্থিত হলাম রমনা ময়দানের সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে। অনুষ্ঠানটি ছিল অনাড়ম্বর এবং এটি অল্পসময়ে শেষ হয়। অনুষ্ঠানে মাত্র দুটি চেয়ার আর একটি টেবিল ছিল। একটি চেয়ারে জেনারেল নিয়াজী ও অন্যটিতে জেনারেল আরোরা বসলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি খুব সুশৃঙ্খলভাবে হয়নি। মানুষের ভিড়ে অতিথিদের দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন ছিল। আমি, ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরার এসএম নন্দ ও পূর্বাঞ্চল বিমানবাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর পাশেই ছিলেন পূর্বাঞ্চল সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এফ আর জ্যাকব। আমি জেনারেল আরোরার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অশোক রায় আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যদিও ভিড়ের চাপে আমরা আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছিলাম না।

আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আসার পর প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী এবং পরে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরোরা দলিলে স্বাক্ষর করলেন। স্বাক্ষরের জন্য নিয়াজীকে কলম এগিয়ে দেন আরোরা। প্রথমে কলমটি দিয়ে লেখা যাচ্ছিল না। আরোরা কলমটি নিয়ে ঝাড়াঝাড়ি করে পুনরায় নিয়াজীকে দেন। এ দফায় কলমটি আর অসুবিধা করেনি। স্বাক্ষর শেষ হলে উভয়ই উঠে দাঁড়ান। তারপর আত্মসমর্পণের রীতি অনুযায়ী জেনারেল নিয়াজী নিজের রিভালভারটি কাপা কাপা হাতে অত্যন্ত বিষণ্ণতার সঙ্গে জেনারেল আরোরার কাছে হস্তান্তর করেন।

এরপর মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের কর্ডন করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যান। এভাবে বাঙালি জাতির বিজয় সূচিত হয়।

সে দিনের স্মৃতি বর্ণনা করে উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে সিদ্দিক সালিক লিখছেন: মেজর জেনারেল নাগরা একটা বিষয়ে খুবই চিন্তিত যে, ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেক’শ রেডিও মারফত জেনারেল নিয়াজীকে তার সম্পূর্ণ বাহিনীসহ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপরও যদি আমার আবেদন মোতাবেক আপনি যদি পুরো বাহিনীসহ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণ না করেন, তাহলে আমার মিত্রবাহিনীকে জলে, স্থলে ও আকাশে পূর্ণোদ্যমে ঢাকার বুকে আঘাত হানার জন্য নির্দেশ দিতে আমি বাধ্য হব। তিনি এই আহ্বান উর্দু ও ইংরেজিতে প্রচারপত্র আকারে বিমানযোগে বাংলাদেশে বিলি করেন। মেজর জেনারেল নাগরা মিরপুর ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে বার বার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। ঘড়িতে তখন সকাল সাতটা। এর মধ্যে ব্রিগেডিয়ার ক্লার কাছে খবর এলো জেনারেল নিয়াজী বিভিন্ন সেক্টরে ও ঘাঁটিতে সকাল ছয়টা থেকে যুদ্ধ বন্ধ করার বার্তা পাঠাচ্ছেন। সেই বার্তা ইন্টারসেপ্ট করা হয়েছে।

এ খবরের পর মেজর জেনারেল নাগরা কাদেরীয়া বাহিনী প্রধান টাইগার কাদের সিদ্দিকী, হরদেব সিং ক্লার ও সন্তু সিং পরামর্শ করতে বসলেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন এই মুহূর্তেই জেনারেল নিয়াজীর কাছে মিত্রবাহিনীর তরফ থেকে চিঠি দিয়ে দূত পাঠাতে হবে। মেজর জেনারেল নাগরা ছোট্ট কাগজে জেনারেল নিয়াজীকে একটি বার্তা লিখে কমান্ডো ব্যাটালিয়নের দুইজন অফিসারকে দিয়ে জিপে একটি সাদা পতাকা লাগিয়ে জেনারেল নিয়াজীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বার্তাতে লেখা ছিল- ‘প্রিয় নিয়াজী আমার পুরো বাহিনীসহ আমি মিরপুর ব্রিজের ওপর। আপনি জানেন, ঘটনার পরিসমাপ্তি হয়েছে। পরামর্শ হচ্ছে এখন আপনি আপনার পুরো বাহিনীসহ আমার কাছে আত্মসমর্পণ করুন। সেক্ষেত্রে আমরা আপনারদের দেখাশুনার দায়িত্ব নেব। শীঘ্রই আপনাদের প্রতিনিধি পাঠান, নাগরা।

পরবর্তী সময়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সকাল আটটায় ঢাকা শহরের প্রান্তসীমায় ছোট মিরপুর সড়কের হেমায়েতপুর সেতুর কাছে মেজর জেনারেল নাগরা এক টুকরো কাগজ জিপের বনেটে রেখে শত্রু পক্ষের কমান্ডার আমির আব্দুল্লাহ নিয়াজীকে যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের জন্য লিখেছেন- প্রিয় আব্দুল্লাহ, আমরা এসে গেছি। তোমার সব ভেল্কি খতম হয়ে গিয়েছে। আমরা তোমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছি। বুদ্ধিমানের মতো আত্মসমর্পণ কর। না হলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। আমরা কথা দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। তোমাকে বিশেষভাবে লিখছি, আত্মসমর্পণ করলে তোমার জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। তোমারই মেজর জেনারেল নাগরা। ১৬/১২/১৯৭১, ৮টা ৩০ মিনিট।

কাদের সিদ্দিকী আরো বলেছিলেন, আত্মসমর্পণের প্রথম সামরিক পর্ব সারতে ঢাকার দিক থেকে একটি মার্সিডিজ বেনজ ও দুটি জিপে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর একজন মেজর জেনারেল, দুজন লে. কর্নেল, একজন মেজর, দুজন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন সিপাহি আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক পর্ব সারতে এল। পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর সিএএফ প্রধান মেজর জেনারেল জামশেদ আত্মসমর্পণের প্রথম পর্ব সারতে এসেছে। আমরা যথারীতি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালাম। মেজর জেনারেল নাগরার বামে ব্রিগেডিয়ার সানসিং, তার বামে ব্রিগেডিয়ার ক্লে ও সর্বশেষে আমি কাদের সিদ্দিকী।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সেনাপতি লে. জেনারেল নিয়াজীর অফিসে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সকাল দশটা দশ মিনিট। নিয়াজী তার অফিস ঘরে এল। অফিস ঘরে ঢুকে তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বিজয়ী সেনাপতিদের সামরিক অভিবাদন জানাল। আত্মসমর্পণ করার জন্য মেজর জেনারেল নাগরা প্রথমে নিয়াজীকে ধন্যবাদ জানালেন এবং তাকে বুদ্ধিমান সেনাপতি হিসেবে উল্লেখ করে প্রশংসা করলেন।’

রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের স্মৃতিচারণে বঙ্গবীর সিদ্দিকী আরো বলেছিলেন, নিয়াজী প্রথমে আপত্তি তুলল কিন্তু তার আপত্তি শোনা হলো না। কারণ, ওখান থেকেই বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। নিয়াজীর রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। পরাজিতকে বিজয়ীর শর্ত মানতেই হয়। নিয়াজীকেও মানতে হলো।’

তিনি আরো বলেন, ‘হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছে এই খবর যেন কী করে সারা ঢাকায় বিদ্যুতের মতো ছড়িয় গেল। তখন রেডিও টিভি সব বন্ধ ছিল। তবুও খবর জানতে ঢাকাবাসীর দেরি হলো না। ঢাকার আশিভাগ লোকই তখন শহরের বাইরে। অবরুদ্ধ নগরীর বিষণ্ন পরিবেশ বদলে গিয়ে মুক্তির উল্লাসে ভরে উঠল। অন্তরের সর্বস্ব বজ্রকণ্ঠে বারবার উল্লসিত হচ্ছিল জাতীয় অনুভূতি, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’

ওইসময়ের বর্ণনা দিয়ে ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেছেন: আজ শরীফের কুলখানি।.… জেনারেল নিয়াজী নব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পন করেছে আজ বিকেল তিনটার সময়। যুদ্ধ তাহলে শেষ? তাহলে আর কাদের জন্য সব রসদ জমিয়ে রাখবো?

আমি গেস্টরুমের তালা খুলে চাল, চিনি, ঘি, গরম মসলা বের করলাম কুলখানির জর্দা রাঁধবার জন্য। মা, লালু, অন্যান্য বাড়ির গৃহিনীরা সবাই মিলে জর্দা রাঁধতে বসলেন। রাতের রান্নার জন্য চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি এখান থেকেই দিলাম। আগামীকাল সকালের নাশতার জন্য ময়দা, ঘি, সুজি, চিনি, গরম মশলা এখান থেকেই বের করে রাখলাম।’

সেই দিন ও রাতটির কথা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের ১০ম খণ্ডে উঠে এসেছে এভাবে: ‘মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যদের রাজধানীতে প্রবেশের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। উল্লাসের জোয়ারে লক্ষ লক্ষ লোক নেমে আসে রাস্তায়। জনমানববিহীন নি:শব্দ নগরী মুহূর্তে ভরে উঠে মানুষের বিজয় উল্লাসে। ওরা এসেছে এই বাণী উচ্চারিত হতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধ্বনি উঠে জয় বাংলা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যৌথ বাহিনীর জন্য মানুষ এগিয়ে আসে ফুলের ডালি নিয়ে হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা নিয়ে।……”

সেই দিনের আরো কিছু সময়ের বর্ণনা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে বিজয় মুহূর্ত নিয়ে আবারো লেখা হয়েছে: ‘বিজয়ের মধ্য দিয়ে নয় মাসের দু:স্বপ্নের অবসান ঘটলো। বাংলার মানুষ আবার তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার পেলো। পথে প্রান্তরে, পর্বতাঞ্চলে নদনদী খালে বিলে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে বাঙালি আবার নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে। ছায়ার মতো অনুসারী মৃত্যুর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকতে হবে না। আর রাতের অন্ধকারে প্রতিটি অচেনা শব্দ মৃত্যুর অশুভ পদধ্বনি হয়ে আসবে না। চারদিকে আনন্দ আর উল্লাসের ঢেউ।’

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে জাগরুক মুক্তির চেতনা। সোনার বাংলাদেশ বিনিমার্ণে দৃপ্ত পথচলার জয় হোক।