"এলএসডি'র" সাতকাহন


"এলএসডি'র" সাতকাহন

প্রায় ১১ বছর আগে বলিউডে একটা চলচিত্র রিলিজ পেয়েছিলো, নাম ছিলো লাভ, সেক্স অর ধোকা। ঐ সময়ে সংক্ষিপ্ত এই চলচিত্রকে বলা হতো এলএসডি। বন্ধু মহলে এই শব্দটির ব্যাপক পরিচিতিও আছে। সেই থেকে এলএসডি মানে আমি এই চলচিত্রকেই বুঝি। এই নামে চলচিত্রের টাইটেল ট্র্যাকও রয়েছে।

এই ঘটনা কেন লিখলাম, সেটা জানানো জরুরি। কিছু দিন আগে সংবাদে দেখলাম এলএসডি একটি মাদক। এই মাদক এতটাই ভয়াবহ যে, নিজেকে খুন করতেও উদ্বুদ্ধ করবে।

এই ভয়ঙ্কর তথ্য পড়ে আগ্রহ বাড়লো আসলে এই মাদক কি! সাংবাদিক হিসেবে আরো একটু আগ্রহ বেশী।

১৯৩৮ সালে সুইস রসায়নবিদ হফম্যান সান্দোস ল্যাবরেটরি তে মেডিসিনাল প্ল্যান্ট স্কুইল এবং আরগট নামের একটি ছত্রাক নিয়ে নিয়ে গবেষণা শুরু করছিলেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিলো শ্বাসনালী এবং সংবহনতন্ত্রকে উদ্দীপ্ত করতে পারে এমন কোনো রাসায়নিক প্রস্তুত করা। একই সালের ১৬ নভেম্বর হফম্যান ছত্রাক থেকে একটি যৌগ সংশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি যা তৈরি করতে চেয়েছিলেন সেটির তেমন কোনো উপাদন যৌগটিতে পেলেন না। ফলে অনেকটা হতাশ হয়েই প্রজেক্টটি কয়েক বছরের জন্য বন্ধ রাখলেন হফম্যান।

এর ঠিক পাঁচ বছর পরের ঘটনা। অর্থাৎ ১৯৪৩ সাল। হফম্যান আবারো সেই গবেষনায় মনযোগী হলেন। যৌগটি সংশ্লেষন নিয়ে কাজ শুরু করতে গিয়ে, দুর্ঘটনাক্রমে সেই গবেষণা যৌগের ২৫০ মাইক্রোগ্রাম গিলে ফেলেন হফম্যান। ঠিক এরপরের ঘটনাটাই সবকিছুকে উলটে দেয়। এক ঘন্টা পরে তিনি অদ্ভুত এক জগতে হারিয়ে যেতে থাকলেন। যেখানে তিনি আজব সব আকৃতির বস্তু, তীব্র আলোর ঝলকানি এবং বিভিন্ন আলোক বর্ণালীর উপস্থিতি বিদ্যমান জায়গা দেখতে পেলেন। তিনি সেসময় তার সহকারীকে অনুরোধ করলেন তাকে বাসায় নিয়ে যেতে। সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে তখন সাইকেলের খুব প্রচলন ছিল। তারা সাইকেলে করে বাসার দিকে যাত্রা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে এই ঘটনাটি 'বাইসাইকেল ট্রিপ' নামে পরিচিত।

হফম্যান যে পদার্থটি দুর্ঘটনাক্রমে গিলে ফেলেছিলেন, সেটিই ছিলো বহুল আলোচিত 'লাইসারজিক এসিড ডাইথাইল্যামাইড' বা 'এলএসডি' ড্রাগ! এটি একধরনের হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ। যা খেলে মানুষ অন্য একটি অবাস্তব জগতে হারিয়ে যায়। এলএসডি নেয়ার পর সাধারণত মানুষ 'হ্যালুসিনেট' করে বা এমন দৃশ্য দেখে যা বাস্তবে নেই। অনেক সময় অলীক দৃশ্য দেখার কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে মানুষ।

হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগের যে কয়টি ড্রাগ আছে তাঁর মধ্যে এলএসডি 'সাইকাডেলিক ড্রাগ' এর মধ্যে পড়ে। এলএসডি’র ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। অনেকে এই ড্রাগকে 'এসিড' নামেও ডাকে। এছাড়াও এর আরো কয়েকটি নাম হলো স্ট্যাম্পস, লুসি, মাইক্রোডটস, পার্পল হার্টস, সানশাইন, হ্যাভেনলি ব্লু ইত্যাদি।

কিন্তু এই এলএসডি কিভাবে একজন মানুষকে হ্যালুসিনেটেড করে ফেলে এই ব্যাপারটি একটু জটিল।

সেরোটোনিন হরমোন এমন একটি হরমোন যা আমাদের দেহের বিভিন্ন আবেগ নিয়ন্ত্রণ, মেজাজ স্থিতিশীল রাখা, গতিবিধি, ঘুম, খাওয়া, পরিপাকসহ নিত্য দিনের কাজ করা ইত্যাদি ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এলএসডি যখন শরীরে ঢুকে তখন এটি আসলে সেরোটোনিনকে নকল করে। ফলে আমাদের মস্তিষ্ক এলএসডিকে সেরোটোনিন হিসেবে ভেবে নিয়ে কোষের সেরোটোনিন রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করে। আরো নির্দিষ্টভাবে বললে 'সেরোটোনিন 2A' রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়। এলএসডি মলিকিউল রিসেপ্টরের সাথে এমন প্রবল আকর্ষণে যুক্ত হয় যে সহজে আলাদা হতে চায় না, যার ফলে এলএসডির প্রভাব দীর্ঘসময় চলতে থাকে।

সেরোটোনিন রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে LSD হ্যালুসিনেশন ঘটায়। এছাড়াও এলএসডি মস্তিষ্কের 'ডিফল্ট মুড নেটওয়ার্ক' বা ডিএমএন কেও দুর্বল করে দেয়। অ্যানাটমির ভাষায় এটি 'মিডিয়াল ফ্রন্টোপ্যারাইটাল নেটওয়ার্ক' নামে পরিচিত।

ডিএমএন বেশ কিছু কাজ, যেমন- দিবাস্বপ্ন, কারো সম্পর্কে ভাবা, অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে রোমন্থন করা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে থাকে। এলএসডি এই ব্যাপারগুলোকে দমিয়ে ফেলে এবং পুরো মস্তিষ্কের মধ্যে যোগাযোগ ও সংযুক্তিকরণে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এলএসডি গ্রহণের ফলে চিন্তাভাবনার যে একটি অপরিবর্তনীয় ছাঁচ আছে সেটাকে অতিক্রম করে ফেলে।

এলএসডি গ্রহনের ব্যাড ট্রিপ বা গুড ট্রিপ যেকোনোটিই হতে পারে। অর্থাৎ আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে যে কোণো একটা ভালো অথবা মন্দ দুনিয়াতে ভ্রমন করাবে। এলএসডি গ্রহনের পরবর্তী একজন মানুষ হিংস্র, আতংকিত, শান্ত যেকোনো কিছুই হয়ে যেতে পারে। নিজেকে নিজেই আঘাত করা অথবা অন্য কাউকে আঘাত করে বসতে পারে। সবচেয়ে বহুল প্রচারিত এলএসডি’র ফলে মানুষের মাঝে “ওড়া বা ঊড়ে” যাওয়ার প্রবনতা বেড়ে যায়। এসময় অনেকেই খোলা জানালা, ছাঁদ বা বারান্দা থেকে লাফিয়ে পরার অনুভুতি জাগ্রত হয়।

প্রতিনিয়ত এলএসডি গ্রহনের ফলে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দেয়। যেমন ব্যক্তিত্বহানী, ক্রমাগত ভয়, ডিপ্রেশন, মুড সুইং, বিভ্রম, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হতে পারেন। সাধারণত ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা এলএসডি’র প্রতিক্রিয়া থাকে। এর ফলে মানুষের হার্ট রেট বেড়ে যায়, উচ্চ রক্তচাপ, ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন, গায়েবী শব্দ, গায়েবী গন্ধ, ভেসে থাকা, উড়ে যাওয়া ইত্যাদি অদ্ভুত অনুভুতি হয়।

এলএসডি সাধারণত জিভের নিচে রেখে ব্যবহার করা হয়। এই অ্যাসিড প্রায়ই বল্টার কাগজ, চিনির কিউব, বা জিলেটিনে বিক্রি করা হয়। এই ড্রাগ ইনজেকশনের সাহায্যেও নেয়া হতে পারে।

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমীক্ষা বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হ্যালুসনেশনের জন্যে ১০% মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় এলএসডি গ্রহণ করেছেন। সত্যজিৎ রায় তার 'ফেলুদা' সিরিজের 'যত কান্ড কাঠমুন্ডুতে' গল্পে এলএসডির এই হ্যালুসিনেশনের বিষয়ে নিয়ে লিখেছেন।

এই এলএসডি’র প্রয়োগ সামরিক বাহিনীতেও হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র তত্ত্বাবধানে ১৯৫০ এর দিকে শুরু হয় 'এমকে আল্ট্রা' প্রজেক্ট। একে কখনও কখনও 'মাইন্ড কন্ট্রোল প্রোগ্রাম' নামেও ডাকা হতো। এই প্রজেক্টের অধীনে সেচ্ছাসেবক এবং বন্দীদের উপর এলএসডি এবং অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। সিআইএ মনে করছিলো এলএসডি তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ 'মানসিক অস্ত্র' হতে পারে। তবে ১৪ বছর পর ১৯৬৪ সালে এই প্রজেক্টের পরিধি ছোট করে আনা হয়।

শুধু সামরিক নয়, বিভিন্ন ভাবেই এলএসডি নিয়ে গবেষনা চালানো হয়। ১৯৬০ সালে সান ফ্রান্সিসকোর একটি মিউজিক্যাল পারফরম্যান্সে অংশগ্রহণকারীদের উপর এলএসডি প্রয়োগ করা হয়, যা 'এসিড টেস্টস' নামে পরিচিত। এছাড়াও একই সময়ে হার্ভাডেও চলে এই নিয়ে গবেষণা। সাইকোলজির প্রফেসর টিমোথি ল্যারি এবং রিচার্ড আলপার্ট এলএসডি ও অন্যান্য সাইকাডেলিক ড্রাগ নিয়ে তাঁর ছাত্রদের উপর পরীক্ষা চালান। তারা শিক্ষার্থীদের চেতনার উপর হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগের প্রভাব দেখতে চাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে তাদেরকে হার্ভাড থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ল্যারি পরবর্তীতে এলএসডিকেন্দ্রিক একটি 'সাইকাডেলিক রিলিজিয়ন' খুলে বসেন, যার নাম দেন 'লীগ ফর স্পিরিচুয়াল ডিসকভারি'।

একটা সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহার হয় এলএসডি’র। ফলে ১৯৭০ সালে এলএসডি-কে 'দ্য আনকন্ট্রোল্ড সাবস্টেন্সেস অ্যাক্ট' এর অধীনে এনে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের কনভেনশনে একে নিষিদ্ধের কথা বলা হয়। যার জন্য বেশিরভাগ দেশেই এলএসডি এখন এক নিষিদ্ধ রাসায়নিক।

তথ্যঃ military.com

drugs.com

npr.org

dw.com/en

wikipedia.org/wiki/Albert_Hofmann

drugfreeworld.org

bn.wikipedia.org/wiki/লাইসার্জিক_অ্যাসিড_ডাইইথ্যালামাইড