দুর্যোগ সাংবাদিকতাঃ কী করবেন, কী করবেন না?
২৬ মে ২০২১, ০৭:৩২ পিএম
![দুর্যোগ সাংবাদিকতাঃ কী করবেন, কী করবেন না?](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/whatsapp-image-2021-05-26-at-71006-pm-20210526193206.jpeg)
সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ, সুনির্দিষ্ট ও তথ্য নির্ভর সংবাদ উপস্থাপন যেকোন সংবাদকর্মীর প্রধান নৈতিক দায়িত্ব। দুর্যোগের সংবাদ করার ক্ষেত্রে সে দায়িত্বশীলতা আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। দুর্যোগ সাংবাদিকতায় সাংবাদিককে দুর্যোগের সাথে দুর্যোগগ্রস্থ এলাকার জনসাধারণের বোঝাপড়া সহজ এবং স্বচ্ছ করে তুলতে হয়। এক্ষেত্রে সাংবাদিকের প্রধান উদ্বেগের বিষয় নাগরিকের সুরক্ষা আর প্রধান দায়িত্ব থাকে নাগরিক কীভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারে, সুরক্ষার প্রয়োজনে তারা কোথায় যাবে, কার সাথে যোগাযোগ করবে এসব তথ্য ও প্রতিবেদন প্রচার করা।
বেশ কিছু গবেষণায় দুর্যোগ সাংবাদিকতাকে দুর্যোগহীন, দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন, দুর্যোগ পরবর্তী স্তরে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি স্তরে সাংবাদিককে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা রাখতে হয় যা একই সাথে তার প্রতিবেদনকে সমৃদ্ধ করে এবং তা দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তাই প্রতিবেদককে প্রতিটি স্তরের প্রতিই বিশেষ নজর দিতে হয়।
দুর্যোগহীন স্তর
সাধারণত যখন দুর্যোগহীন স্তরে দুর্যোগ সাংবাদিকতা নিয়ে তেমন কাজ দেখা যায় না কিন্তু দুর্যোগহীন স্তর দুর্যোগ সাংবাদিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ে প্রতিবেদক লম্বা সময় নিয়ে দুর্যোগ সংক্রান্ত নীতিমালা, আইনকানুন, সরকার ও বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রমকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পান। দুর্যোগ মোকাবেলায় দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের বিষয়গুলোতে আলোকপাত করতে পারেন এবং নীতি-নির্ধারনের ক্ষেত্রে জনসাধারণের মতামতকে প্রতিবেদনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করতে পারে।
দুর্যোগপূর্ব স্তর
দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করতে দুর্যোগপূর্ব প্রতিবেদনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ে সাংবাদিক তার প্রতিবেদনের মাধ্যমে দুর্যোগের প্রস্তুতি এবং ঘাটতি নিয়ে জনসাধারণের সাথে প্রশাসনের মধ্য যদি কোন দূরত্ব থাকে সে বিষয়ে উভয়পক্ষকেই আলোকপাত করবেন। এক্ষেত্রে সাংবাদিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বিপদসীমায় বসবাসরত জনগণের সুরক্ষায় সরকারের গৃহিত পদক্ষেপসমূহ তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া, সে পদক্ষেপে জনগণের কোন অংশ যদি বাদ পড়ে যায় সেটাও সরকারেকে অবহিত করবেন।
সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ও কর্তব্য। দুর্যোগ পূর্ববর্তী সচেতনতা অনেক জীবন বাঁচাতে পারে এবং ক্ষয়ক্ষতিও কমিয়ে আনতে পারে। এসময় আশ্রয় কেন্দ্র, সুরক্ষা সামগ্রী, বিশুদ্ধ পানি, খাবার, ত্রাণ বিতরণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, দুর্যোগ আঘাত হানার সম্ভাব্য সময়-সূচী, জরুরী যোগাযোগের নাম্বার, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ইত্যাদি অনেক বেশি পরিমাণে প্রচার করা প্রয়োজন।
দুর্যোগের ঝুঁকি এবং উচ্চ বিপদগ্রস্থ এলাকাগুলোতে করণীয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের মতামত এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিকভাবে সফল উদাহরণগুলো সামনে এনে দুর্যোগ মোকাবিলায় অসামান্য ভূমিকা রাখতে পারেন একজন সাংবাদিক। দুর্যোগপূর্ব স্তরে আসন্ন দূর্যোগের শক্তিমত্তা এবং তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মানুষের কাছে তথ্য প্রচার মানুষকে ভীত কিংবা আতঙ্কগ্রস্থ নয় বরং আরও সচেতন করে তুলবে।
দুর্যোগকালীন স্তর
দুর্যোগকালীন স্তরে সাংবাদিকের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ঘটনার গভীরে প্রবেশ করে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করতে হয়। তখন জনগণ এবং সরকারের সাথে সমান্তরালভাবে যোগাযোগ বজায় রাখতে হয়। এভাবে সহায়তা প্রার্থী এবং সহায়তাকারীর মধ্যে মূল সেতুবন্ধন সাংবাদিকের মাধ্যমেই তৈরি হয়।
দুর্যোগকালীন সাংবাদিককে সতর্কতার সাথে হতাহতের সঠিক সংখ্যা, বিস্তারিত বিবরণ, ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা, গৃহিত তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ, বিশেষ পরিস্থিতি, জনগনের ত্রান চাহিদা, অধিক ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকা, কোন এলাকায় কী ধরনের ত্রান প্রয়োজন, স্বেচ্ছাসেবকদের অবস্থান, উদ্ধারকারী বাহিনীর অবস্থান, তথ্য কেন্দ্র এসব বিষয়ে সংবাদ প্রচার করতে হবে। সেখানে সরকার যেমন সঠিক দিকনির্দেশনা পাবে তেমনি জনগণও তুলনামূলক সহজে এবং দ্রুততম সময়ে ক্ষতিক্ষতি কাঁটিয়ে উঠতে পারবে।
দুর্যোগ পরবর্তী স্তর
এই স্তরে সাংবাদিককে পরিস্থিতি, পূনর্বাসন ব্যবস্থাপনা, মানুষের নতুন উদ্যেমে জেগে ওঠা, চেষ্টা, পদক্ষেপ, কিভাবে দুর্যোগ সংঘটিত হলো, যে পরিমাণ বস্তুগত ও অবস্তুগত ক্ষতি সাধিত হয়েছে এসকল প্রতিটি বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে পারেন।
এসময় দুর্যোগের শিকার মানুষ, জনপ্রতিনিধি, সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় এবং পার্শ্ববর্তী হাসপাতাল, আশ্রয় কেন্দ্র, ত্রান বিতরণ কেন্দ্র ইত্যাদি জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে চাহিদা অনুযায়ী পুনর্বাসনের যোগান সম্পর্কে প্রতিবেদনের মাধ্যমে তথ্য উপস্থাপন করবেন।
দুর্যোগকালীন তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। একটি দুর্যোগ মোকাবেলায় এবং কাটিয়ে ওঠায় মানুষ গণমাধ্যমের দিকে অনেকাংশে তাকিয়ে থাকে। অনেক এলাকায় সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই তারা সাংবাদিকের কাছে নিজের দুর্দশা এবং চাহিদা তুলে ধরতে থাকে। কারণ গণমাধ্যম মানুষের মধ্যে এই আস্থা তৈরি করতে পেরেছে যে গণমাধ্যমে তার দুর্দশার চিত্র প্রচারিত হলে দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তিটি কিছুটা হলেও সহায়তা পেতে পারে।
দুর্যোগ সংবাদ উৎস
দুর্যোগ সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সংবাদ উতসের সাথে সাংবাদিকের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বজায় রাখতে হয়। সঠিক সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সংবাদ উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা অপরিহার্য। দুর্যোগ সাংবাদিকতায় একজন সাংবাদিক যেসব উৎস থেকে সংবাদ পেতে পারেন-
১. জাতীয় ও আঞ্চলিক সরকারি কর্মকর্তা, যারা দুর্যোগ সম্পর্কিত বিষয়ে দায়িত্বরত ও অবগত আছেন।
২. দুর্যোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
৩. বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সংশ্লিষ্ঠ গবেষক।
৪. হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা বিজ্ঞানী।
৫. দুর্গত এলাকায় কর্মরত পুলিশ, সেনাসদস্য, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন।
৬. বিশেষজ্ঞ এনজিও কর্মী।
৭. দুর্যোগ সংশ্লিষ্ঠ বিষয়ে আন্তজার্তিক প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তি।
৮. দুর্যোগ আক্রান্ত ব্যাক্তিবর্গ।
৯. আঞ্চলিক ভাবে দুর্যোগ মোকাবেলার সাথে সম্পর্কিত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের কর্মী।
১০. প্রত্যক্ষদর্শী, যারা দুর্যোগকালীন সময়ে ঘটনাচক্রে পুরো বিষয়টিকে অবলোকন করেছেন।
১১. বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠান সমূহ, আবহাওয়া অফিসসমূহ।
দুর্যোগ সাংবাদিকতা করতে একজন সাংবাদিক কী কী করবেন এবং করবেন না?
> দুর্যোগ নিয়ে সংবাদ প্রচার করতে গেলে একজন সাংবাদিক অবশ্যই সবার আগে নিজের এবং তার সহকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন। মাথায় রাখতে হবে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা সবসময়ই সাধারণ এলাকা থেকে আলদা। এখানে অবশ্যই সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে।
> সাংবাদিক নিজে অবশ্যই নিজের প্রয়োজনীয় খাবার, পানি, ওষুধ সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের ব্যাটারি, চার্জ দেয়ার সামগ্রী, গাড়ীর পর্যাপ্ত জ্বালানী ইত্যাদি সংগ্রহে রাখতে হবে। কেননা দুর্যোগ পরবর্তীতে সাধারণ মানুষেরই খাবার, পানি ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি থাকে।
> সাংবাদিকের অবশ্যই তার নিউজরুমের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। তার অবস্থান সম্পর্কে নিউজরুম যেনো সর্বদা অবগত থাকে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারণ তার যেকোন বিপদ হলে নিউজরুম থেকেই সবার আগে তাকে বিপদমুক্ত করতে সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ করবে।
> দুর্যোগে সাক্ষাৎকার নেয়ার ক্ষেত্রে সাংবাদিককে অবশ্যই সংবেদনশীল হতে হবে। কেননা সাক্ষাৎকার প্রদানকারী ব্যক্তি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকতে পারেন।
> দুর্যোগে কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবারের কাছে সংবাদ পৌঁছনো আগে তার নাম প্রচার করা থেকে বিরত থাকা ভালো। প্রাথমিক ব্রেকিং নিউজ প্রদানের সময়কাল শেষে প্রতিবেদক বিস্তারিত এবং বিশ্লেষণধর্মী সংবাদ প্রচারে মনোযোগ দিবেন।
> দুর্যোগ মোকাবেলায় যে ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি গৃহিত হয়েছিল তা কতখানি কার্যকর এবং আরও কী কী করলে ভালো হতো সেদিকে নজর দিবেন।
> দুর্যোগ কেটে গেলে সাংবাদিক আবার যে দুর্যোগহীন স্তর সে স্তরে ফিরে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সাংবাদিকতায় মনোযোগ দিবেন।
সমগ্র বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অন্ত্যন্ত দুর্যোগপ্রবণ দেশ। সারাবছরই দেশে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের অবির্ভাব হয়। এসময় এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় সাংবাদিকের দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। দুর্যোগ সাংবাদিকতা বিষয়ে তেমন কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দেখা যায় না। বেশি বেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ দুর্যোগ সাংবাদিক তৈরি করলে দুর্যোগ মোকাবেলায় আরও অনেক বেশি ভূমিকা রাখা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী এবং ব্যক্তি পর্যায়ের নানান উদ্যোগ। শক্তিশালী গণমাধ্যম গঠনের পথে এ ধরনের উদ্যোগ অত্যন্ত অপরিহার্য।
সংবাদ সূত্র এর আরও লেখা
![যেভাবে এলো বিশ্ব টেলিভিশন দিবস](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/tv-20211121151036.jpg)
যেভাবে এলো বিশ্ব টেলিভিশন দিবস
![ডাক দিবস ও ডাক বিভাগের পেছনের কথা](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/244523811-3044081192472642-6755327437833148826-n-20211010173915.jpg)
ডাক দিবস ও ডাক বিভাগের পেছনের কথা
![প্যান্ডোরা পেপারস বিশ্লেষণ : কার লাভ কার ক্ষতি](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/01-20210821172148-20211006174948.jpg)
প্যান্ডোরা পেপারস বিশ্লেষণ : কার লাভ কার ক্ষতি
![স্বপ্নের মেট্রোরেল, পরিবহন খাতে এক যুগান্তকারী সংযোজন](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/241077875-241939531243884-7422228049899510050-n-20210916184829.jpg)
স্বপ্নের মেট্রোরেল, পরিবহন খাতে এক যুগান্তকারী সংযোজন
টুইন টাওয়ার হামলার ২০ বছর, যা ঘটেছিল সেদিন
আফগানিস্তানে তালেবানের সুলুক সন্ধান
![বিশ্ব আলোকচিত্র দিবসের আদ্যোপান্ত](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/237707296-898372890753721-1009306698826530390-n-20210819143019.jpg)
বিশ্ব আলোকচিত্র দিবসের আদ্যোপান্ত
![](https://www.bjcnews.com/media/advertisement/ad300x250.png)