“ঝড়ের যত নাম”


“ঝড়ের যত নাম”

কোনো দেশ বা অঞ্চলে কখন, কোথায়, কোন ঝড় হয় তা নিয়ে বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্যেই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়। 

আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৫ সাল থেকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু হয়। 

ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষজন। এতে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয় সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।

বিভিন্ন সময়ে আসা এই ঝড়ের থাকে বাহারী নাম। জেনে নেয়া যাক, ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের আদ্যোপান্ত। 

নামকরণের প্রক্রিয়া

বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার অধীনস্থ বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটি। সমুদ্রের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এই আঞ্চলিক কমিটি তৈরি করে। উত্তর ভারত মহাসাগরে যেসব সৃষ্ট ঝড় সেগুলোর নামকরণ করে World Meteorological Organization-WMO। এর ৮টি সদস্য রাষ্ট্র— বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যাণ্ড ও ওমান। এদের একত্রে বলা হয় ‘স্কেপে। 

আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থার-আরএসএমসি সঙ্গে সমন্বয় করে ২০০৪ সাল থেকে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোয় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে। আরএসএমসি দেশগুলো থেকে যে তালিকা পায় সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সংক্ষিপ্ত তালিকা করে ডব্লিউএমওর কাছে পাঠায়। ডব্লিউএমও ও বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের আরএসএমসির সদস্য দেশগুলোর কাছে ঝড়ের নামগুলো পাঠায়।

এই অঞ্চলে আরএসএমসির সদস্য রয়েছে বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ। বাকি ১২টি দেশ হলো ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাত ও ইয়েমেন।

২০০৪ সালে বাংলাদেশের দেওয়া নামে প্রথম ঘুর্নিঝড়ের নামকরন করা হয়। সেটির নাম ছিলো ‘অনিল’। এই ঘূর্ণিঝড়টি ভারতে আঘাত করেছিল। বাংলাদেশে আঘাত হানা নামকরণ হওয়া প্রথম ঘূর্ণিঝড় ছিল ‘সিডর’। এটি ছিল ওমানের দেওয়া নাম।

যেভাবে নাম নির্বাচন করা হয় 

আঞ্চলিক কমিটির সদস্য দেশগুলো সম্ভাব্য ঝড়গুলোর জন্য আগে থেকেই বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করে রাখে। ঝড় হলেই নামগুলো ব্যবহার করা হয়। তবে এক নাম দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা হয় না। 

আগে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ঝড়গুলোর নাম হতো সন্তদের নামে। যেমন সান্তা আনা, স্যান ফেলিপ (১ম), স্যান ফেলিপ (২য়)। এরপর ঝড়ের নামকরণ করা হতো অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মানুষের কাছে এসব নাম একটু বেশিই জটিল শোনায়। এ ধরণের নামের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও সুনির্দিষ্ট নামকরণ লিখিত বা মৌখিক যেকোনো যোগাযোগে অধিকতর সহজ। ফলে এ ধরনের নাম ব্যবহার অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত। যেমন ১৪ দশমিক ৩ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে ঝড়টি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে বলার চেয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ধেয়ে আসছে বলা অনেক সহজ এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে দ্রুত সহায়ক। 

স্কেপের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, প্রতিটি দেশ থেকে ১০টি করে নাম জমা নেওয়া হয় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করার জন্য। 

অন্য অঞ্চলের নামকরণ

গত কয়েক শতাব্দী ধরে আটলান্টিক ঝড়ের নাম দেয়া হয়ে আসছে যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এরপরে আবহাওয়াবিদরা মিলে মেয়েদের নামে ঝড়গুলোর নামকরণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৩ সালে US Weather Service আনুষ্ঠানিকভাবে Q, U, X, Y, Z ব্যতীত A থেকে W পর্যন্ত আদ্যক্ষরে মেয়েদের নামে ঝড়ের নামকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ নিয়ে ৬০ এবং ৭০ এর দশকে নারীদের প্রতিবাদের মুখে অবশেষে ১৯৭৮ সালে ছেলেদের নামেও ঝড়ের নামকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। 

বছরের প্রথম ঝড়ের নাম রাখা হত A আদ্যক্ষর দিয়ে, দ্বিতীয় ঝড়ের নাম রাখা হত B আদ্যক্ষর দিয়ে, এভাবে চলতে থাকতো। আবার জোড় সালের বিজোড় ঝড়গুলোর (মনে করি ২০১৪ সালের ৩য় ঝড়) নাম রাখা হত ছেলেদের নামে আর বিজোড় সালের বিজোড় ঝড়গুলোর নাম রাখা হত মেয়েদের নামে। 

এক বছরে ২১ টির বেশি হারিকেন উৎপন্ন হলে (২০০৫ সালে যেমন হয়েছিল), গ্রিক বর্নমালা অনুযায়ী নামকরণ করা হয়- হারিকেন আলফা, বিটা ইত্যাদি। 

কিভাবে নামকরণ করা হয়?

২০০৪ সাল থেকে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোয় ঝড়ের নামকরণ শুরু হয়। সে সময় আটটি দেশ মিলে মোট ৬৪টি নাম প্রস্তাব করে। এদিকে এই নামগুলো থেকে নামকরণ করা শেষ হলে বর্তমানে ১৩ দেশ নতুন করে নামের প্রস্তাব করেছে।

ঝড়ের নাম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কিছু ব্যাপার লক্ষ্য রাখা হয়। যে নামই রাখা হবে সেটি যাতে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা সামাজিক ভাবে কোনোরকম বিতর্ক বা ক্ষোভ তৈরি না করে।

উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, ২০১৩ সালে একটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া হয়েছিল ‘মহাসেন’। নামটি প্রস্তাব করেছিল শ্রীলংকা। কিন্তু সেখানকার সাবেক একজন রাজার নাম ছিল ‘মহাসেন’। ফলে তখন এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এমনকি শ্রীলংকার গণমাধ্যমে সেটিকে নামহীন ঝড় বলা হয়। পরবর্তীতে রেকর্ডপত্রে ঝড়টির নতুন নাম নির্ধারণ করা হয় ‘ভিয়ারু’।

কিভাবে নামকরণ হলো ইয়াস

"ইয়াস" নামটি নামকরণ করেছে ওমান। একটি স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে। "ইয়াস" শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ইংরেজী ভাষায় এর অর্থ "জেসমিন"।