মামুনুলের মানবিকতা, জিনা নাকি বিয়ে


মামুনুলের মানবিকতা, জিনা নাকি বিয়ে

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশী আলোচিত ঘটনার মধ্যে অন্যতম জিনা বা ব্যাভিচার। ব্যভিচারের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে ‘Adultery’, ‘Extramarital affair, ‘Extramarital sex’ ‘Illicit love’, ’Extramarital love’ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলা ভাষায় অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক বুঝাতে যে দুটি শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায় তা হলো ‘ব্যভিচার’ ও ‘পরকীয়া’। আবার কারও কারও মতে দুজন বিবাহিত নারী-পুরুষ যারা আইনত স্বামী-স্ত্রী নন তাদের পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক পরকীয়া,আর দু’জন অবিবাহিতের পারস্পরিক সম্মতিতে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ককেও ব্যভিচার বলা হয়।

আমাদের বর্তমান ও পূর্বের সমাজ ব্যবস্থায় এরকম ঘটনা হরহামেশা ঘটেছে। তবে জিনা বা ব্যাভিচারে পর্যাপ্ত শাস্তির বিধান থাকলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োগ নেই। তবে ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় এর জন্যে রয়েছে কঠোর আইন। ইসলাম মানুষের জন্য সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। ইসলামী জীবনব্যবস্থায় জিনা বা ব্যভিচার ঘৃণ্যতম অপরাধ। ইসলামে জিনাকারী বা ব্যভিচারকারীর জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির বিধান।

ইসলামী পরিভাষায়, যিনাʾ (زِنَاء) বা জিনা (زِنًى বা زِنًا) হলো অবিবাহিত বা বিবাহিত দুইজন মানুষের মধ্যকার যৌনক্রিয়া। জিনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যে বিষয়গুলো রয়েছে তা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে তবে জীবনের যে দুইটি পর্যায়ে এগুলো সংঘটিত হয় তা হলো বিবাহের পূর্বে যৌনক্রিয়া (অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর মাঝে যে যৌনক্রিয়া সংঘটিত হয়)এবং বিবাহের পরের যৌনক্রিয়া (অর্থাৎ বিবাহিত পুরুষ ও নারীর মাঝে সংঘটিত যৌনক্রিয়া, যারা একে অপরের সঙ্গে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ নয়)।

এগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন ভাবে যৌনকর্মের মাধ্যমে জিনা হয়ে থাকে যেমন: পরকীয়া- বিবাহিতদের অবৈবাহিক যৌন সম্পর্ক,পতিতাবৃত্তি- অর্থ বা অন্য যেকোনো কিছুর বিনিময়ে যৌনসঙ্গম, সমকামিতা- সমলিঙ্গীয়দের যৌন সম্পর্ক, অজাচার- পরিবারের সদস্য বা রক্তের সম্পর্ক আছে এমন কারো সঙ্গে যৌনসঙ্গম, পশুকামিতা- পশুর সঙ্গে যৌনসঙ্গম, ধর্ষণ- জোরপূর্বক যে যৌনসম্পর্ক করা হয় ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। জিনা বা ব্যভিচারের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃন্য ও জঘন্যতম ব্যভিচার হচ্ছে মাহরাম অর্থাৎ মা, বোন, খালা, সৎ মা, মেয়ে অর্থাৎ চিরনিষিদ্ধ নারী বা মহিলাদের সঙ্গে সংগম করা।

এছাড়াও ইসলামের ইতিহাসে কোনো পুরুষের সঙ্গে দাসীর যৌনকর্মও জিনার অন্তর্ভুক্ত, যদি না দাসী ওই পুরুষের নিজের সম্পত্তি হয়। এছাড়াও চুম্বন, বিভিন্ন অঙ্গে স্পর্শ ও আলিঙ্গন, স্পর্শকাতর আদর, হস্তমৈথুন, মুখমৈথুন ইত্যাদি যেকোনো ধরনের যৌনক্রিয়া প্রতিক্রিয়া জিনার পরোক্ষ প্রকরণ হিসেবে ধরা। ব্যভিচার করা মারাত্মক গুনাহ। আল্লাহ তাআলা ব্যভিচারের কাছেও যেতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। তা একটি অশ্লীল কাজ এবং খারাপ পন্থা।’ (সুরা:বনি ইসরাঈল:৩২)। এছাড়াও নবীজী (সা.) দেহব্যবসায়ী ও দেহ ব্যবসা করে উপার্জিত অর্থ সম্পর্কে বলেন, ‘কুকুর বিক্রি করে উপার্জিত অর্থ যেমন নিকৃষ্ট, তেমনি নিকৃষ্ট যেনাকারিনীর উপার্জিত অর্থ।’ (মুসলিম শরীফ) লুত সম্প্রদায়ের ধ্বংসের জন্যে দশটি কারণ ছিলো। তার মধ্যে অন্যতম একটি কারণ ছিল সমকামীতা, যা তাদের আগে কোনো সম্প্রদায় করেনি। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র আল কোরআনে বলেন, ‘লুত তার সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা যা করছ এমন অশ্লীল কাজ তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ করেনি, তোমরা নারীদের পরিবর্তে পুরুষদের দ্বারা যৌনবাসনা পূরণ কর; রাহাজানী কর এবং নিজ মজলিসে গর্হিত কাজ কর? জওয়াবে তার সম্প্রদায় কেবল এ কথাই বলল, যদি তুমি সত্যবাদী হও তবে আল্লাহর আযাব আন।’ (সূরাঃ আল-আনকাবুত,আয়াত-২৯)

এছাড়াও স্বমেহন বা হস্তমৈথুনকারী, মুখমৈথুনকারী এরা আরেক শ্রেনীর জিনাকারী। এই শ্রেনীর লোকদের ওপর রাসূলের লানত রয়েছে। হাত, পা, জিহ্বা ইত্যাদি অঙ্গের মাধ্যমে এসব গর্হিত কাজ এবং বিভিন্ন খারাপ কাজ করার ফল সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তাদের কৃতকর্মের বিরুদ্ধে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও পা সাক্ষী দিবে।’ (সূরা আন নূর, আয়াত-২৪)

জিনা করা কবিরা গুনাহ যে গুনাহ তাওবা ছাড়া মাফ হয় না। এছাড়াও বিভিন্ন সহীহ হাদীসে নবীজীর বক্তব্য এভাবে এসেছে যে, ‘কোনো পরনারীর প্রতি নজর দেয়া চোখের জিনা, যৌনতা সম্পর্কিত অশ্লীল কথাবার্তা জিহ্বার জিনা, অবৈধ সম্পর্কের কাউকে স্পর্শ করা হচ্ছে হাতের জিনা, ব্যভিচার করার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে যাওয়া পায়ের জিনা, খারাপ অশ্লীল কথা শোনা কানের জিনা এবং মনের মাধ্যমে কল্পনা ও আকাংখা করা মনের জিনা। অত:পর লজ্জাস্থান এই চাহিদার পূর্ণতা দেয় অথবা অসম্পূর্ণ রেখে দেয়।’ (সহীহ বুখারী শরীফ, সহীহ মুসলিম শরীফ, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে আন-নাসায়ী)

জিনা বা ব্যভিচারের কঠিন শাস্তির কথা পবিত্র কোরআন ও হাদীস সমূহে উল্লেখিত আছে। জিনার সম্পর্কে ইসলাম ধর্মে কঠিন বিধান রয়েছে। জিনা বা ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কে হজরত মুহম্মদ (সা.) এর হাদিস বর্ণিত আছে যে, ‘আমি একদিন স্বপ্নে একটি চুলা দেখতে পেলাম যার ওপরের দিক ছিল সরু এবং ভেতরের দিক ছিল প্রশস্ত, যেখানে আগুন উত্তপ্ত হচ্ছিল এবং তার ভেতরে নারী পুরুষেরা চিৎকার করছিল। আগুনের শিখার উঠানামার সঙ্গে সঙ্গে তারাও উঠানামা করছিল, এ অবস্থা দেখে আমি জিবরাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? জিবরাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন উত্তর দিল, এরা হলো অবৈধ জিনাকারী নারী ও পুরুষ।’ (সহীহ আল-বুখারী)

জিনাকারীদের শাস্তিঃ

ইসলামে জিনাকারীদের জন্য যেমন পৃথিবীতে রয়েছে কঠিন শাস্তি তেমনি পরকালে রয়েছে অনন্তকালের জাহান্নামের আগুন। পৃথিবীতে একজন জিনাকারীর শাস্তি হিসেবে ১০০ বেত্রাঘাতের বিধান রয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন,‘ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত পুরুষ ও নারী যারা, তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত কর, তাদের এই বিষয়ের করুণা যেন তোমাদেরকে দুর্বল না করে, এমন বিষয়ে যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং মহাপ্রলয় দিবসের ওপর বিশ্বাস রাখো এবং বিশ্বাসীদের একদলকে তাদের শাস্তির সাক্ষী করে রাখো।’(সূরা- আন-নুর: আয়াত- ২)

মহানবী (সা.) বলেছেন, বিচার দিবসে তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না ও তাদের পবিত্রও করবেন না এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নির্ধারিত থাকবে। তারা হলো ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক এবং অহংকারী দরিদ্র। হযরত ইবন মাসউদ (রা.)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ কী? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা। অথচ তিনি প্রত্যেক প্রাণীর স্রষ্টা। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, তারপর কী? তিনি বললেন, তোমার সন্তান তোমার সঙ্গে আহার করবে—এ আশঙ্কায় তাকে হত্যা করা। আমি আবার আরজ করলাম, তারপর কী? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে তোমার ব্যভিচার করা। (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)। নবী (সা.) যিনাকারীর শাস্তি বর্ণনা দেন যে, ‘একজন অবিবাহিত পুরুষ এবং একজন অবিবাহিত নারীর ব্যভিচারের ক্ষেত্রে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন পেতে হবে। আর যদি বিবাহিত পুরুষ বিবাহিত নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করে তাহলে তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে।’ (সহীহ মুসলিম)

জিনাকারীর পরকালের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো যিনাকারী তওবা না করে মৃত্যুবরণ করে তাহলে তার স্থান হবে জাহান্নাম। নবী কারীম (সা.) বলেন, ‘যে আমাকে তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী জিনিসের এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী জিনিসের নিশ্চয়তা (সঠিক ব্যবহারের) দেবে আমি তার জন্য বেহেশতের নিশ্চয়তা দিব।’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) এবং মহান আল্লাহ তায়াল বলেন, ‘আর তারা সংযত রাখে নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহকে, তাদের স্ত্রী ও দাসী ছাড়া এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। সুতরাং কেউ এগুলো ছাড়া অন্য কাউকে কামনা করলে তারা হবে সীমা লঙ্ঘনকারী। এবং যারা প্রতিশ্রুতি ও আমানত রক্ষাকারী; আর যারা নিজেদের ইবাদতে যত্নবান থাকে। তারাই হবে ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী, যেখানে তারা স্থায়ী হবে।’

আল্লামা জাজিরি (রা.) তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ব্যভিচার ও এর প্রভাবের ক্ষতি অগণিত। এতে চারিত্রিক, ধর্মীয়, শারীরিক, সামাজিক, পারিবারিক সর্বোপরি পাপ কাজে জড়িয়ে পাপিষ্ট হওয়ার ক্ষতি রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ব্যভিচারীর দোয়া কবুল করেন না। তার থেকে ঈমানের নূর চলে যায়। যেখানে ব্যভিচার চলে, সেখানে রহমতের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। ব্যভিচার চুরি, হত্যা ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক। ব্যভিচারের ফলে এইডসের মতো কঠিন রোগ হয়।