বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেন্দ্রের বৈশ্বিক উত্থান


বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেন্দ্রের বৈশ্বিক উত্থান

নরওয়েতে সুজোর কার্যালয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে পার ক্রিশ্চিয়ান ম্যাগনাস (বাম থেকে তৃতীয়)। ছবি: জুলফিকার ফাহমি

নরওয়ের সাংবাদিক পার ক্রিশ্চিয়ান ম্যাগনাসের মাথায় চিন্তাটি প্রথম আসে, ২০০৯ সালে, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলিতে গিয়ে। সেই সফর থেকেই জানা, বার্কলির গ্রাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজমে একটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রকল্প আছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধানের নানান কৌশল ও পদ্ধতি শেখানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি শীর্ষ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জোট বেঁধে তাদের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই অনুসন্ধান পরিচালনা করেন, এবং সেগুলো প্রকাশ করেন।

সিক্সটি মিনিটস প্রোগ্রামের সাবেক প্রযোজক ও এই প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা, লোওয়েল বার্গম্যান সেসময় ম্যাগনাসকে বলেছিলেন, “গ্রাজুয়েশনের সময় আমাদের শিক্ষার্থীদের এক হাতে থাকে মাস্টার্স ডিগ্রী, আরেক হাতে পুলিৎজার পুরস্কার।” কথাটি ম্যাগনাসের মনে গেঁথে যায় এবং এই মডেলটি চালু করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি নরওয়েতে ফিরে আসেন। 

এক দশক পর, সেটি ঠিকই করে দেখান ম্যাগনাস। ২০১৮ সালে তার উদ্যোগে বার্গেন ইউনিভার্সিটিতে যাত্রা শুরু করে সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম, স্থানীয় ভাষায় যার সংক্ষিপ্ত রূপ, সুজো। শুরুতে শিক্ষার্থী ছিলেন মাত্র চারজন। তার পর থেকে, এখন পর্যন্ত এই মাস্টার্স প্রোগ্রামে যোগ দিয়েছেন ৩০ জনেরও বেশি। এই প্রোগ্রামের চারটি সেমিস্টারের একটি নির্ধারিত থাকে তাত্ত্বিক পড়াশোনার জন্য। এবং বাকি তিনটিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মৌলিক রিপোর্টিংয়ে মনোযোগ দেন। এবং কাজ করেন, নরওয়ের শীর্ষ সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যমগুলোর সঙ্গে। ৩০ বছর ধরে রিপোর্টার, এডিটর ও তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে কাজ করা ম্যাগনাস এই সেন্টারটির নেতৃত্ব দেন।

এই মাস্টার্স প্রোগ্রামের প্রথম দিককার একজন শিক্ষার্থী, ইয়োহানা ম্যাগডালেনা হিউসেবে। ২০১৯ সালের মে মাসে, তার বছরব্যাপী এক অনুসন্ধান প্রকাশিত হয় নরওয়ের সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র ভারদেন্স গাং-এ। প্রবীণদের আত্মহত্যার মত উপেক্ষিত একটি বিষয় নিয়ে তার করা দুই পর্বের অনুসন্ধানটি জাতীয় পরিসরে বড় ধরনের বিতর্ক জন্ম দেয়। এবং এটি নরওয়েতে পুলিৎজারের সমতুল্য, স্কুপ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। বোঝাই যায়, যাত্রা শুরুর পরপরই সাফল্য পেয়েছিল, সুজো।

এখন আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মনোযোগ দিচ্ছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ ও চর্চায়। সুজোর মতো, সম্প্রতি যাত্রা শুরু করা এমন আরো ছয়টি একাডেমিক সেন্টার গত বছরের অক্টোবরে যুক্ত হয়েছে গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের সঙ্গে। নতুন এই সদস্যরা ছড়িয়ে আছে উত্তর আমেরিকা থেকে উত্তর ইউরোপ পর্যন্ত। এখন, এই মডেলের ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে আরো বিস্তৃত জায়গাজুড়ে। ২০০৮ সালে, উইটওয়াটারস্ট্রান্ড ইউনিভার্সিটিতে গড়ে ওঠে এমন একটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সেন্টার; ২০১১ সালে, কলম্বিয়ার আন্দিজ ইউনিভার্সিটিতে; এবং ২০১৬ সালে জাপানের ওয়াসেদায়। লন্ডন ইউনিভার্সিটি-ভিত্তিক ফরেনসিক আর্কিটেকচারের বয়স হয়ে গেছে ১০ বছর। তারাও পরিচালনা করেছে বেশ কিছু দারুন অনুসন্ধান। এদের মধ্যে ছিল: চিলিতে কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার এবং পশ্চিম পাপুয়ায় চিরহরিৎ বন ধ্বংসের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ সব বিষয়। জিআইজেএনের বর্তমান সদস্যদের প্রায় অর্ধেকই কোনো না কোনোভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত। পড়ালেখা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি, তারা  হাতেকলমে কাজ করার জায়গা, ইন্টার্নশিপ ও স্কলারশিপের সুযোগ করে দিচ্ছে।

সময়ের সাথে দ্রুতগতিতে বাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কেন্দ্র। কিন্তু এই ধারাটির নেপথ্যে কী আছে? 

ইউনিভার্সিটি অব বার্গেনের সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের শিক্ষার্থী ইয়োহানা ম্যাগডালেনা হিউসেবে। তাঁর কাজ মনোনীত হয়েছিল মর্যাদাপূর্ণ একটি পুরস্কারের জন্য। ছবি: ওলে আলেক্সান্ডার সাউ

 

নিরাপদ আশ্রয়

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চর্চার জায়গা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় – একটু অদ্ভুতই শোনায়। কারণ প্রথাগত শিক্ষা সাধারণত একটু ধীরগতির, বদ্ধ এবং বিশেষায়িত প্রকৃতির হয়। তাই মনে হতে পারে, জনস্বার্থ রিপোর্টিং আসলে তাদের কম্মো নয়। কিন্তু এতক্ষণ যে মডেল নিয়ে কথা হলো, তার প্রবক্তারা বলছেন, উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের জন্য দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রথমত, নিউজরুমগুলো যেখানে প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে পারছে না, সেখানে তারা পরবর্তী প্রজন্মের অনুসন্ধানী সাংবাদিক তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এবং দ্বিতীয়ত, সংবাদমাধ্যম যখন টাকার অভাবে ব্যয়বহুল রিপোর্টিং প্রকল্প হাতে নিতে পারে না, তখন জটিল অনুসন্ধান পরিচালনার উদ্যোগ নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আসতে পারে।

উইটস-এর সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও জিআইজেএন-এর পর্ষদ সদস্য অ্যান্টন হারবার বলেছেন, “ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন কাজগুলো করার ক্ষেত্রে একটি নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়।”

হারবার, উইটস জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) প্রতিষ্ঠা করেন মেডিল ইনোসেন্স প্রজেক্ট থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে। ১৯৯০-এর দশকে শিকাগোর নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে চালু হয় এই প্রকল্প। মেডিল ইনোসেন্স, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক একদম শুরুর দিকের প্রচেষ্টা, যেখানে মেডিল জার্নালিজম স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা, ইলিনয় রাজ্যে বিচারব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে অনুসন্ধান করেন। (বেশ কিছু হাই-ইমপ্যাক্ট প্রতিবেদন জন্ম দেয়া ইনোসেন্স প্রজেক্ট নিয়ে সম্প্রতি কিছুটা অবিশ্বাসও তৈরি হয়েছে।)

উইটস জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের অংশ হিসেবে, ডব্লিউজেপি-ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বিচারব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে অনুসন্ধান করছে। তাদের প্রতিবেদনের জন্য অন্তত দুজন ব্যক্তি বেঁচে গেছেন হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ত্রুটিপূর্ণ রায় থেকে। 

“এই বিষয়গুলো নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য সময় ও দূরদৃষ্টি প্রয়োজন হয়। আমরা এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী অনুসন্ধান পরিচালনার জায়গা তৈরি করেছি। প্রথাগত নিউজরুমগুলোতে এ ধরনের অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন। বিশেষভাবে আমাদের দেশে,” বলেছেন হারবার। তিনি ছিলেন মেইল অ্যান্ড গার্ডিয়ানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, যা গত কয়েক দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার সবচে অগ্রণী রাজনৈতিক ও অনুসন্ধানী প্রকাশনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ডব্লিউজেপি-র কর্মীরা মাঝেমধ্যে উইটস-এর শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেন। কিন্তু এটি একটি স্বতন্ত্র অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম হিসেবে কাজ করে; এবং তারা নিজেরাই প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশ করে। আপনি চাইলে, একে বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক মার্শাল প্রজেক্ট বলতে পারেন।

অন্যদিকে, প্রশিক্ষণকেই সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রাখে, সুজো। নরওয়ের এই সেন্টার, ঠিক নিউজরুমের মতো কাজ করে না। তারা নিজেদের উদ্যোগে কোনো প্রতিবেদনও প্রকাশ করে না। তারা বরং শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মৌলিক বিষয়গুলো শেখায় এবং তারপর তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করতে পাঠায়। অন্যান্য পত্রপত্রিকার জন্যেও কর্মশালা আয়োজন করে সুজো। এর মধ্য দিয়ে তারা, কর্মরত সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী দক্ষতা বাড়ায় এবং জটিল রিপোর্টিং প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে সহায়তা দেয়।

জোট বেঁধে কাজ করা

 

 

ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির আর্নল্ট সেন্টারের শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও ৬০ মিনিটস প্রোগ্রামের স্কট প্যালির সামনে বক্তব্য রাখছেন ক্যাথলিন জন্সটন। ছবি: ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির দ্য মিডিয়া স্কুল

 

 

কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থান নিয়েছে ডব্লিউজেপি ও সুজোর মাঝামাঝি জায়গায়। কানাডার কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইআইজে) নিজেদের পরিচয় দেয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও জাতীয় সংবাদমাধ্যম হিসেবে। একই কথা খাটে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির মাইকেল আই. আর্নল্ট সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের ক্ষেত্রেও। দুটি সংগঠনই জোট বাঁধে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে, যেন শিক্ষার্থী ও পেশাদার রিপোর্টারদের যৌথ অনুসন্ধানগুলো ছড়িয়ে দেওয়া যায় সহজে। 

আর্নল্ট সেন্টার ছয়টি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে গ্রে টেলিভিশন (যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তাদের ১৫০টি স্টেশন আছে) ও গ্যানেট-এর (ইউএসএ টুডেসহ প্রায় ২৫০টি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি) সাথে। ভবিষ্যতে, এটি অন্য আরো অনেক সংগঠনের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারে। এদের মধ্যে রয়েছে, অ্যারিজোনা রাজ্যের হাওয়ার্ড সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিম ও ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড। এসব তথ্য জানিয়েছেন, আর্নল্ট সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ক্যাথলিন জন্সটন। সিএনএন ও সিবিএস নিউজের অনুসন্ধানী প্রযোজক জন্সটন, ২০১৯ সাল থেকে কাজ করছেন আর্নল্ট সেন্টারের শিক্ষক ও সম্পাদক হিসেবে। তাঁর আশা: ভবিষ্যতে নিউজরুমটি শুধু শিক্ষার্থীরাই চালাবে। 

অন্যদিকে, কানাডাজুড়ে স্থানীয় পর্যায়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হিসেব রাখার জন্য তৈরি একটি ডেটা প্রকল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে আইআইজে। এই কাজে তাদের সঙ্গে আছে কানাডার ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্তত সাতটি বড় সংবাদমাধ্যম। কনকর্ডিয়া ও তাদের সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর আগেও বেশ কিছু গভীর অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দিয়েছে। যেমন, খাবার পানিতে উদ্বেগজনক পরিমাণে সীসার অস্তিত্বকানাডার ফার্স্ট নেশন আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে পানির ইস্যু, এবং তেল ও গ্যাস শিল্পের ক্ষমতা। 

এক দশকের বেশি সময় নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদক হিসেবে কাজ করার পর ২০১৮ সালে আইআইজে প্রতিষ্ঠা করেন কনকর্ডিয়ার স্নাতক পাট্টি সোনটাগ। কেন এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার মনে হয়েছিল সংবাদ-শিল্পের অবনতির ফলে যে তথ্য ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পূরণ করতে পারে নির্ভুল তথ্য প্রদানের মাধ্যমে। কানাডার কিছু বড় শহরে, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক প্রকাশনাগুলো এখন শহরের বড় সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে।”

বিজ্ঞাপনদাতা খোয়ানো ও পাওয়া

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে কেন্দ্রে রেখে কিছু প্রোগ্রাম আগে থেকেই পরিচালিত হতো বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু শীলা কোরোনেল মনে করেন, ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দা এবং সাংবাদিকতার প্রথাগত ব্যবসায়িক মডেলগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ায় এটি বেশ ভালোমতো ছড়াতে থাকে। ২০০৬ সালে তিনিই সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রোগ্রাম চালু করেছিলেন নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন টনি স্ট্যাবাইল সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম। 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গড়ে ওঠা এসব অনুসন্ধানী কেন্দ্রের জন্য অর্থায়ন হতে পারে বেশ কিছু উৎস থেকে। আর্নল্ট সেন্টার, ছয় মিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়েছে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির সাবেক ছাত্র, মাইকেল আর্নল্টের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী ও ধনী ব্যবসায়ী। 

সুজো, তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বাৎসরিকভাবে ৩৫ লাখ নরওয়েজিয় ক্রোনার (৪১০,০০০ ডলার) পেয়েছে ফ্রি স্পিচ ফাউন্ডেশন, ফ্রিট ওর্ড ও সেভিংস ব্যাংক ও স্পেয়ারব্যানকেন ভেস্ট থেকে। এর সঙ্গে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ১৫ লাখ ক্রোনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে আসা এসব অনুদানের মেয়াদ এবছরই শেষ হয়ে যাবে। তবে সুজো আশা করছে, এই  ঘাটতি পুষিয়ে নেয়া যাবে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া টাকার মাধ্যমে। 

জোটবদ্ধ সাংবাদিকতা ও তথ্য আদানপ্রদানের লক্ষ্যে ডেটা হাব চালুর জন্য গুগল নিউজ ইনিশিয়েটিভের ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ থেকে অনুদান পেয়েছে কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইজে। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়ার জন্য ইনস্পিরিট ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ১১০,০০০ ডলার পেয়েছে উপহার হিসেবে। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল রিপোর্টিং সেন্টারও এ ধরনের অনুদান পেয়েছে সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ রিসার্চ কাউন্সিল অব কানাডা, কানাডিয়ান ইনস্টিটিউটস অব হেলথ রিসার্চ এবং আরো কিছু বড় ফাউন্ডেশন থেকে। 

তবে কিছু বিশ্ববিদ্যায়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে: রিপোর্টিংয়ের কারণে অনুদানদাতাদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়নও তৈরি হয়। 

২০০৭ সালে এমনটিই ঘটেছিল কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। টেলিকম কোম্পানি, ভেরাইজনের অনুদানে পরিচালিত হতো তাদের “ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট ব্রেকফাস্ট” লেকচার সিরিজ। কিন্তু স্ট্যাবাইল সেন্টারের শিক্ষার্থীরা যখন স্থানীয় দৈনিক, টাইমস ইউনিয়নের সঙ্গে জোট বেঁধে অনুসন্ধান করতে শুরু করে, তখন তাদের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়েছিল ভেরাইজন। টুইন টাওয়ারের হামলার পর ভেরাইজন কিভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের জরুরি সাহায্য পেয়েছিল, তা নিয়ে পরিচালিত হয়েছিল অনুসন্ধানটি। 

কোরোনেলের মনে আছে, ভেরিজনের “খুবই ক্ষুব্ধ” এক মুখপাত্র জিজ্ঞাসা করছিলেন, কেন এই শিক্ষার্থীদের এরকম গুরুতর বিষয় নিয়ে কাজ করতে দেওয়া হয়েছে। লেকচার সিরিজের জন্য টাকা দেওয়াও বন্ধ করে দেয় কোম্পানিটি। কেন তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি তাদের কাছ থেকে। (এই লেখার জন্যও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ভেরাইজন।)

২০১৩ সালে রিপাবলিকান নেতৃত্বের উইসকনসিন আইনসভা চেষ্টা করেছিল উইসকনসিন-মেডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের নির্ভরতা বাড়াতে। যেন উইসনকসিন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বের করে দেওয়া যায়।

শিক্ষা বনাম চর্চা

অর্থায়নের উৎস ছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব অনুসন্ধানী কেন্দ্র অন্যান্য আরো অনেক দিক দিয়ে একে অপর থেকে আলাদা। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্নল্ট সেন্টারের নীতিমালা নিশ্চয়তা দেয় যে, তাদের কাজ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকার ডব্লিউজেপি তাদের রিপোর্টিং নিয়ে আলোচনা করে সাংবাদিকতা বিভাগের সাথে। এবং বিতর্কিত কোনো অনুসন্ধান প্রকাশের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবীদের পরামর্শ নেয়।

ডব্লিউজেপি-র হারবার বলেছেন, এটি একটি যৌক্তিক ব্যবস্থা। যদি কখনো আদালত পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পেছনে থাকবে। (তিনি এটিও যোগ করেছেন যে, এখনো কোনো প্রকল্পে সেন্সরশিপ আরোপ করেনি বিশ্ববিদ্যালয়)। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ও আর্নল্ট সেন্টারকে আইনি সমর্থন দেয় বলে জানিয়েছেন জন্সটন।

সাক্ষাৎকারদাতারা জিআইজেএনকে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হিসেবে থাকার সুবিধা হলো: বড় একটি প্রতিষ্ঠানের সমর্থন পাওয়া যায়। কেউ হয়তো ছোট, স্বাধীন কোনো সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে সহজেই একটি মামলা ঠুকে দিতে পারে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাওয়ার সময় সে হয়তো পিছপা হবে। এখানে সাংবাদিকদেরও একটি একাডেমিক মাণদণ্ড মেনে কাজ করতে হয়। যখন সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমেই প্রশ্নের মুখে পড়ছে, তখন এই ধরণের উদ্যোগ বেশ কার্যকর হয়ে ওঠে। 

তবে সব কিছুই যে খুব নির্বিঘ্নে চলে, এমনও নয়। হারবার বলেছেন “শিক্ষা ও বাস্তবে চর্চার মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বের কথা।” যেমন, যখন বিশ্ববিদ্যালয় বলে, বাইরে থেকে আনা সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার ও প্রশাসকদের পে স্কেলের ভেতরেই রাখতে হবে। “বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড়, আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, যারা এ ধরনের কাজ করার জন্য গড়ে ওঠেনি। ফলে বিষয়গুলো বেশ জটিল। কিন্তু আমরাও এর মধ্যেই কাজ চালিয়ে যাওয়ার রাস্তা বের করি,” বলেছেন হারবার।

অন্যদিকে, জন্সটন বলেছেন, তিনি আর্নল্ট সেন্টারের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দেন। কারণ, অন্যান্য সংগঠনের মতো, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়েরও নিজস্ব কিছু “প্রথা-পদ্ধতি” আছে। ম্যাগনাস বলেছেন, এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় খুবই সহযোগিতামূলক আচরণ করেছে। তবে তার মাথায় আছে, কখনো না কখনো অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সুজোর জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। “এমন দিন সত্যিই আসবে। এবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রধান আসবেন। আমি আমার নতুন বস পাব। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতার লড়াই বা নেপথ্যের সব ঝগড়া-বিবাদের কথা কমবেশি সবারই জানা।”  

যেমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে

কাজে ব্যস্ত মাকোতো ওয়াতানাবে (সবার বামে) ও ওয়াসেদা ক্রনিকল দল। ছবি: ওয়াসেদা ক্রনিকল

প্রতিবন্ধকতা অবশ্য সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল ওয়াসেদা ক্রনিকলের জন্য। টোকিও-ভিত্তিক এই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের শুরুতেই সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে। (এই সম্পর্কচ্ছেদের ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য তারা দ্রুতই নিজেদের নাম পরিবর্তন করে। তাদের নতুন নাম: টোকিও ইনভেস্টিগেটিভ নিউজরুম, টানসা।)

ক্রনিকলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক মাকোতো ওয়াতানাবে জিআইজেএনকে বলেছেন, “আমি শুরুতে ওয়াসেদা ক্রনিকলকে, ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকেই চালাতে চেয়েছিলাম। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সংগঠন থাকাটা নীতিগতভাবে খুব দারুন ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল।” মানুষের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত আবহ এবং সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ ও চর্চার সুযোগের কারণেই তিনি এদিকে ঝুঁকেছিলেন। “কিন্তু বাস্তবে, এটি এসব মহৎ আদর্শের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেনি।”

ওয়াতানাবের ভাষ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও ক্রনিকল সত্যিকারের কোনো সহায়তা পায়নি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফিসের জায়গা ভাড়া নিয়েছিলেন বাণিজ্যিক দরে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়মনীতির কারণে অনুদান সংগ্রহও বাধার মুখে পড়ছিল। ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর জার্নালিজমের তৎকালিন প্রধান এই প্রকল্পকে  সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য কখনো পাওয়া যায়নি বলেই জানিয়েছেন ওয়াতানাবে। (এ ব্যাপারে ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের  বক্তব্য জানতে চাওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।)

বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চার দারুন সাফল্য, বিশেষ করে আর্নল্ট সেন্টারের সম্পূর্ণ স্বাধীন আর্থিক মডেলের কথা শোনার পর ওয়াসেদা ক্রনিকলের গিসবার্ট মজা করে বলেছেন: “আমাদের তো তাহলে ইন্ডিয়ানাতে চলে যাওয়া উচিৎ!”

ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া স্কুলের অধ্যাপক, জন্সটন অবশ্য এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রকল্প নিয়ে আশাবাদী। তিনি বলেছেন, “এখন সংবাদপত্র ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যম যেরকম সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে আর্নল্ট সেন্টার ও হাওয়ার্ড সেন্টারের মতো গ্রুপগুলোই এই ঘাটতি পূরণ করতে যাচ্ছে। সেটি হয়তো এখনই হবে না। আমরা হয়তো এখন এক বালতি পানির মধ্যে কয়েকটি ফোঁটা মাত্র। কিন্তু আমরা বাড়ছি।”