ফিরে দেখা ২১ ফেব্রুয়ারী


ফিরে দেখা ২১ ফেব্রুয়ারী

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি?”

ভাষা আন্দোলন ঘিরে অনুপ্রেরণাদায়ী এই সঙ্গীতটি আমাদের সবারই জানা। “একুশে ফেব্রুয়ারী” আসলেই সবচেয়ে বেশি বেজে ওঠে এই গান। “২১শে ফেব্রুয়ারী” ভাষা আন্দোলন হয়েছে। এমন তথ্য সবার জানা থাকলেও বাঙ্গালী জাতির অর্জনের দিনের আরো কিছু ঘটনা হয়ত অনেকের জানান নেই। একুশে ফেব্রুয়ারী দিন কি হয়েছিলো। এছাড়া এর পরের দিনগুলোতে আন্দোলন কোন দিকে মোড় নিয়েছিলো সেই তথ্য জানাতেই বিজেসি নিউজের এমন আয়োজন।

বাংলা ভাষার জন্যে শান্তিপুর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক, জব্বার, শফিউর সহ প্রায় ১২ জন।

সাল ১৯৫২, তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারী, দুপুটা…. ৩টা…..

আব্দুল জব্বার, বার্মায় প্রায় একযুগ কাটিয়ে দেশে ফিরে পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডে (পিএনজি) যোগদান করেন। পিএনজি ভেঙ্গে দেওয়া হলে পরবর্তীকালে তিনি আনসার বাহিনীতে যোগদান করেন। ময়মনসিংহ থেকে প্রশিক্ষণ শেষে নিজ গ্রামে ‘আনসার কমান্ডার’ হিসেবে কাজ করেন এসময় তিনি বিয়ে করেন বন্ধুর বোন আমেনা খাতুনকে। কয়দিন পরেই তাদের ঘর আলো করে সন্তান আসে। যার নাম বাদল। ২০ ফেব্রুয়ারী শহীদ জব্বার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান ক্যান্সারে আক্রান্ত শাশুড়িকে দেখতে। অসুস্থ শাশুড়ির জন্য তিনি বের হলেন ফল কিনতে। কিন্তু মেডিকেলের গেটের বাইরে দেখলেন বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে অনবরত শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে ছাত্র-জনতা। উত্তেজিত জনতার শ্লোগান শুনে জব্বার ভুলে গেলেন ফল আনার কথা। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে আসলে জব্বার তাতে যোগদান করেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করে এবং জব্বার গুলিবিদ্ধ হন। সেদিন রাতেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মারা যান আবদুল জব্বার।

এদিকে হোস্টেলের ১২ নং শেডের বারান্দায় ছিলেন আবুল বরকত। পুলিশ যে গুলিটা চালিয়েছিল, সেটা আসলেই ছিল খুব এলোপাথাড়ি। একটি গুলি ছুটে যায় হোস্টেলের ১২ নং শেডের বারান্দায়, সেখানেই লুটিয়ে পড়েন বরকত। অবাক হয়ে তার ক্ষতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, “আরে, আমার দেখি গুলি লেগেছে…”। সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলেন। তাকেও নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে, কিন্তু রাত আটটায় তাকেও মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। শহীদ বরকতের বয়স ছিল মাত্র ২৫। রাতেই এক ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে তাকে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে।

এই ভাষা আন্দোলনে প্রায় ১২ জন শহীদ হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস সালাম। পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলিতে তিনি লুটিয়ে পড়েন, তবে মারা যান দেড় মাস পর, এপ্রিলের সাত তারিখে, ২৭ বছর বয়সে। পেশায় তিনি ছিলেন ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের পিয়ন, থাকতেন নীলক্ষেতের কোয়ার্টারে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ডিএমসির হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলি এসে সরাসরি আঘাত হানে আন্দোলনরত হিসাব বিজ্ঞানের ছাত্র রফিকের মাথায়। সেখানেই তার খুলি উড়ে যায়। ছয়-সাত জন ধরাধরি করে তাকে এনে রাখেন ঢাকা মেডিকেলের এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায়। ড. মশাররফুর রহমান খান তার ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে কুড়িয়ে নিয়ে আসেন। রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ রফিককে সমাহিত করা হয়। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৬। তিনি ছিলেন এই নির্মম আক্রমণে প্রথম শহীদ।

 

আন্দোলনে অংশ নেয়া কর্নেল এস ডি আহমদ এর ভাষ্যমতে,

“দুপুর প্রায় পৌনে তিনটা হবে। বিনা ওয়ার্নিংয়ে পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করল। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, ফাঁকা গুলি, পুলিশ বোধ হয় ছাত্র-জনতার বিরাট সমাবেশ ভেঙে দিতে ভয় দেখাতে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছে। পরক্ষণেই বুঝলাম, আসল গুলিই ছুঁড়ছে। আমি ছিলাম তখন টিনের চোঙ্গা হাতে আমাদের হোস্টেলের ১৫ নম্বর ব্যারাক বরাবর ফুলার রোডের ধারে। আমার অবস্থান থেকে প্রায় তিন গজ দূরে ভিড়ের মধ্যে ২০-২২ বছরের একটি ছেলে রক্তঝরা একটা মাথার খুলির ওপরের অংশটা বাটির মতো হাতের তালুতে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগল, “এই দেখুন, পুলিশের নৃশংসতা!” তাকিয়ে দেখলাম, বাটির মতো মাথার খুলির অংশটিতে রয়েছে রক্তময় কিছু মাথার ঘিলু। কী নিদারুণ এই দৃশ্য! পরে জানা গেল, এটা ছিল শহীদ রফিকের মাথার খুলির অংশ।”

আমরা সবাই ২১ শে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা জানলেও অনেকেই আমরা জানিনা কি হয়েছিলো ২২শে ফেব্রুয়ারী। আগের দিনের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলন চলছিল সেদিনও, নওয়াবপুর রোডে।

সেদিন সকাল দশটার দিকে রঘুনাথ লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসের জন্য বের হলে নওয়াবপুর রোড পার হবার সময় পুলিশ সেদিনই গুলি চালায়। গুলি লাগে শফিউরের পিঠে। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে তাকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। গুলিতে তার কলিজা ছিঁড়ে যায়। মারা যান সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায়। ৩৪ বছর বয়সে। কিন্তু মারা যাবার পর তার লাশ পুলিশ আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করেনি। পরে তাকে শহীদ আবুল বরকতের কবরের পাশেই দাফন করা হয়।

৮/৯ বছর বয়সী অহিউল্লাহ নামের একজন শিশুও মারা যায় পুলিশের গুলিতে। ভাষা শহীদদের ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়। শহীদ শফিউরকে অবশ্য এ পদক দেয়া হয় ২০০৫ সালে।

২৩ শে ফেব্রুয়ারী…..

সারা রাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রবৃন্দ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে কাজ করেন। ২৪ তারিখের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল। হাতে লেখা কাগজে যুক্ত করা হয়েছিল, ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। এটি উদ্বোধন করেন আন্দোলনে শহীদ শফিউর রহমানের পিতা।

২৬ ফেব্রুয়ারী স্মৃতিস্তম্ভটি পুলিশ ভেঙে দেয়। দু’বছর পর নতুন করে বানানো হয় শহীদ মিনার। বড় করে বানানো শুরু হয় ১৯৫৭ সালে, স্থপতি হামিদুর রহমানের নকশা মাফিক। মার্শাল’ল এর কারনে ১৯৫৮ সালে কাজ থেমে যায়,সেটি শেষ হবার পর ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম উদ্বোধন করেন শহীদ মিনার। সেটিও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী ভেঙে ফেলে, কিন্তু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার পুনর্নিমাণ করে সেটি।

ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রায় দশ বছর পর ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। সংবিধানের ২১৪ অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়: “The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali”

এছাড়াও যে ঘটনাটি আমরা অনেকেই জানি না….

১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায়, সেখানে ১১ জন বাঙালি নিহত হয়। পরবর্তীতে আসামের তিন বাংলা-প্রধান জেলায় বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ভাষা আন্দোলনের পর জাতীয়তা নিয়ে সচেতনতা বেড়ে ওঠে। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান আবারো বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে এখনো হিন্দুয়ানি প্রভাব রয়ে গেছে।”

তথ্যঃ ইন্টারনেট