নির্বাচন কভারেজ: সাংবাদিকদের যে বিষয়গুলো মনে রাখা জরুরী
২৮ জানুয়ারি ২০২১, ০২:১৯ এএম
নির্বাচন মানে দেশের জনগনের সামনে তাদের কন্ঠ বেছে নেবার সুযোগ। জাতীয়ভাবে নির্বাচনকে বলা যেতে পারে দেশের প্রতিটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। নির্বাচন সামনে আসা মানেই টেলিভিশন, পত্রিকা, রেডিও, ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ায় নাগরিকের চিন্তা, ইচ্ছা ও আকাঙ্খা সম্পর্কে জানান দেবার ছড়াছড়ি। সেসময় সংবাদ মাধ্যমগুলোর অতি ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। নির্বাচনে জালিয়াতি, কালো টাকার ছড়াছড়ি, ভোট জালিয়াতি, ব্যালট চুরি, ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোট প্রদান, হাজারো সত্য কিংবা ভুল তথ্য উপস্থাপন, বিদেশী হস্তক্ষেপসহ আরও নানান ধরনের ঘটনা ঘটার আশংকা তৈরি হয়। জাতির সামনে সত্য এবং বস্তুনিরপেক্ষ সেসব তথ্য তুলে দিতে সাংবাদিকদের নিতে হয় নানান ধরনের প্রস্তুতি। কী কী থাকে সেই প্রস্তুতিতে? কীভাবে একটি সমগ্র নির্বাচনকে দেশের প্রতিটি মানুষের সামনে সত্য, বস্তুনিরপেক্ষ এবং নির্ভুলভাবে উপস্থাপন করা যায়? এসব নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
পরিকল্পনা ও বাজেট
প্রথমেই মনে রাখতে হবে রিপোর্ট করার জন্য নির্বাচন একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। চারিদিকে এর কাজকর্ম বিস্তৃত। এই বিস্তৃত কর্মযজ্ঞকে একত্রে এনে সংবাদ প্রকাশ করতে হিমশিম খেয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে যদি কাজের ধরন, টিম গঠন এবং দায়িত্ব বন্টন করা যায় তাহলে এই অসাধ্য সহজেই সাধন করা সম্ভব। সেকারণে সাংবাদিক যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন সে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে বেশি। সুন্দর একটি পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রয়োজন একটি সুন্দর বাজেট তৈরি করা যেন কাজের ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা সর্বোচ্চ সুবিধা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে কাজ করতে পারেন। সাংবাদিক যেহেতু নিজে তথ্য সংগ্রহ করেন তাই এই কাজের পরিকল্পনা এবং বাজেট করার ক্ষেত্রে তিনিই তার প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে পারবেন।
নাগরিকের প্রাধান্য
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতাকারীদের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকের মতামত, চিন্তা, আকাঙ্খার প্রতিফলন। তাদের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতাকারীদের কাছে যথাযথ উপস্থাপন সাংবাদিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতাকারীদের চাইতেও ভোটার বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাদের দেয়া ভোটেই প্রতিদ্বন্দিতাকারীরা প্রতিনিধি আকারে নির্বাচিত হয়।
নির্বাচনী আইন
নির্বাচন নিয়ে সংবাদ উপস্থাপন করতে গেলে নির্বাচনী আইনগুলো থাকা চাই নখদর্পনে। নির্বাচনে দল কীভাবে গঠিত হবে, কীভাবে নির্বাচনী আসন নির্ধারিত হবে, হেল্পিং বুথ বসানোর নিয়ম কী হবে, কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে সে ব্যাপারে আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপ কী হবে এসব ব্যাপার জানা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ নির্বাচনী আইন নিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ৭ টি বিধিমালা প্রকাশিত হয়েছে যা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী আইন (http://www.ecs.gov.bd/) অপশনটিতে গেলে পাওয়া যায়।
নির্বাচনী আইন
নির্বাচনী ব্যয়
নির্বাচনে প্রতিটি প্রার্থীর ব্যয়ের একটি সীমানা নির্ধারণ করে দেয় নির্বাচন কমিশন। প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের উৎস কী, সে উৎস আইনসিদ্ধ কিনা, অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে নির্বাচনী নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা এসব তথ্য জনগনের সামনে উপস্থাপন করাও সাংবাদিকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
নির্বাচনী ব্যয় সংক্রান্ত নির্দেশনা
ভোটার নিবন্ধনের নিয়মাবলি
নির্বাচনে জনগণেরর ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির নিয়ম ঠিকমতো মানা হচ্ছে কিনা, কেউ বাদ পড়ে গেলে সে অন্তরভুক্ত হবার সুযোগ পাচ্ছে কিনা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদিভেদে কেউ কোন ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে কিনা এসব তথ্যও অনুসন্ধানের মাধম্যে তুলে আনা। এক্ষেত্রে আন্তরজাতিক পর্যায়ে ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সাথে দেশের ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়ার তুলনামূলক প্রতিবেদনও করা যেতে পারে। ভোটার নিবন্ধনের প্রক্রিয়া জানতে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়া অপশনটিতে (http://www.ecs.gov.bd/page/registration-process) ঢু মেরে সহজেই প্রক্রিয়াটি জেনে নিতে পারবেন একজন সাংবাদিক। এক্ষেত্রে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় কোন প্রকার অনিয়ম হলে তিনি ধরতে পারবেন সহজেই।
ভোটার নিবন্ধনের নিয়মাবলি
যাচাই করা
নির্বাচনে প্রার্থীরা নানান ধরনের তথ্য এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রার্থীর পরিচিতির উপর ভিত্তি করে কোন সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না। অতীতে তার প্রতিশ্রুতির সাথে তার বর্তমান কথা মিল রয়েছে কিনা তা যাচাই করে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞদের একটি তালিকা তৈরি করে রাখতে হবে যেন চাওয়ামাত্রই প্রার্থীদের প্রদানকৃত তথ্য যাচাই করে দেখা যায়। ফ্যাক্ট চেক করা নিয়ে বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বিশ্বস্ত কিছু প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়ার পাশাপাশি সাংবাদিকেরা নিজেরাও চাইলে একটি টিম গঠন করতে পারেন যাদের কাজ হবে বিভিন্ন বিষয় যাচাই করে দেখা।
বিভিন্ন জরীপ সম্পর্কে সচেতনতা
নির্বাচনী সাংবাদ উপস্থাপনে জনগনের জনমত নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের অন্যতম প্রধান বিষয়। এক্ষেত্রে জনমত নিয়ে করা জরীপ করা করছে, কাজটিতে অর্থায়ন করা করছে, জড়িপে কারা অংশ নিচ্ছে, কী ধরনের প্রশ্ন করা হচ্ছে, প্রশ্নের উত্তর দিতে সাধারণ জনগ্ণের ওপর কোন ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা, জড়িপের ফলফাল কী আসছে, নতুন মতামত গ্রহণ করার পর জড়িপের ফলাফলে পরিবর্তন আসছে কিনা এসব তথ্য সঠিকভাবে জনগনের সামনে উপস্থাপন করতে হবে কেননা ভুলভাবে কোন কিছু উপস্থাপন হলে একদিকে যেমন সাংবাদিকতার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে তেমনি কোন এক পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্বেরও অভিযোগ আসাটা অমূলক থাকবে না। সেকারণে জনগনের মতামত উপস্থাপ্নের ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিককে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
ব্যালট পরীক্ষা করা
নির্বাচনের আগে থেকেই ব্যলটবক্স পরীক্ষা করা এবং ভোট দেয়ার নিয়মাবলি নাগরিকের সামনে তুলে ধরা যেন ভোট দেয়ার আগে থেকেই নাগরিকেরা এই প্রক্রিয়ার সাথে ভালভাবে পরিচিত হতে পারে।
https://www.youtube.com/watch?v=4ErkiRRBZjU
নির্বাচনী দিনের প্রস্তুতি
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের দিন অনেক ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে সাংবাদিককে প্রথমেই নির্বাচনের জন্য নিজের সকল ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। নির্বাচনী রিপোর্ট প্রকাশ করার জন্য নির্বাচন কমিশনের অনুমতিপত্র বা প্রেসকার্ড আগেই সংগ্রহ করে রাখতে হবে। নির্বাচনের দিন যেহেতু যেকোন ধরনের ঘটনাই গুরুত্বপূর্ণ তাই প্রয়োজনে অতিরিক্ত সাংবাদিক নিযুক্ত করা যেতে পারে। বর্তমানে অনেক ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার, প্রবন্ধ, নিবন্ধ লেখক পাওয়া যায় যারা তথ্য দিয়ে নির্বাচনী রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করতে পারে। তবে নিয়োগের পূর্বে অবশ্যই তাদের কর্মদক্ষতা যাচাই করে নেয়া বাঞ্ছনীয়। সংবাদ প্রকাশে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যেমনঃ ক্যামেরা বা অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস পরীক্ষা করে দেখে রাখতে হবে তা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা। কোণ ত্রুটি থাকলে তা ঠিক করে নেয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু ডিভাইসও হাতে রাখা ভাল।
নির্বাচনের দিন
নির্বাচনের দিনটি একজন সাংবাদিকের জন্য সব অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। নির্বাচনের দিন ভোট দেয়ার সরঞ্জামাদি ঠিকমতো এবং যথাসময়ে পৌছেছে কিনা, ঠিক সময়ে ভোট শুরু হলো কিনা, ভোট কেন্দ্রে ভোটারের ওপর কোন ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা, সবাই সঠিকভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছে কিনা, নিরপেক্ষতা সঠিকভাবে অবলম্বন করছে কিনা, সকল দল এবং তাদের সমর্থকেরা সবাই ঠিকমতো নির্বাচনী আচরণবিধি মানছে কিনা, না মানলে সঠিক ব্যবস্থা গৃহিত হচ্ছে কিনা, ভোট শেষে ব্যালট সঠিকভাবে গণনা করা হচ্ছে কিনা, ফলাফল প্রকাশে কোন প্রকার অসদুপায় অবলম্বিত হচ্ছে কিনা, সর্বোপরি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কিনা তা যথাযথভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে।
নির্বাচনী ফলাফল
নির্বাচনী ফলাফল ঘোষনার সময় অনেক সাংবাদিকই সম্ভাব্য ফলাফল প্রকাশ করতে গিয়ে ফলাফল ঘোষনা দিয়ে ফেলেন। এক্ষেত্রে সাংবাদিককে তার নিজের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। সারাদিন প্রাপ্ত ফলাফল ঘোষনা করতে গিয়ে অনলাইনের যুগে তথ্য যাচাই না করেই সংখ্যা উল্লেখ করে দেন। এক্ষেত্রে তথ্য যদি সঠিক না হয় তা নির্বাচনী পরিবেশে উত্তেজনা কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই ভোট কেন্দ্রের প্রধান প্রিজাইডিং অফিসার ব্যতীত অন্যকারো দেয়া তথ্য প্রকাশ না করাই ভালো।
নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত থাকা
নির্বাচনে জনগন তার প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে একজন প্রার্থী সম্পর্কে প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্যের সিংহভাগ নেয় সাংবাদিকের দেয়া তথ্য থেকে। তাই সাংবাদিককে অবশ্যই সত্য তথ্য প্রচার করতে হবে এবং একই সাথে বস্তুনিষ্ঠতা এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ভুল করা কোন সুযোগ নেই।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও নিজের সক্ষমতা ও সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস করা দরকার। বস্তুনিষ্ঠ ও ভারসাম্য বজায় রাখা যেমন জরুরী তেমনি সংবাদের উপস্থাপন কৌশল সম্পর্কেও ধারনা থাকতে হবে। একই সংবাদ কিভাবে পাঠক কিংবা দর্শকের কাছে আকর্ষনীয় করে তোলা যায়, নজর দিতে হবে সেদিকেও। তবে সেক্ষেত্রে বস্তনিষ্ঠতা যেন হারিয়ে না যায়।