জাতীয় প্রেস ক্লাব: পেছন ফিরে দেখা


জাতীয় প্রেস ক্লাব: পেছন ফিরে দেখা

শুধু সাংবাদিক সমাজেরই নয়, জাতীয় প্রেস ক্লাব বাঙালি জাতির অহঙ্কার। সাংবাদিকদের একটি প্রফেশনাল ক্লাব হলেও বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে গোড়া থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে জাতীয় প্রেস ক্লাব । ১৯৬৪ সালের দাঙ্গাবিরোধী শান্তি মিছিল, ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে মিছিল প্রেস ক্লাব থেকেই শুরু হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় এবং স্বৈরশাসনের দুঃসহ দিনগুলিতে প্রেস ক্লাবই হয়ে উঠেছিল আন্দোলন ও সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল।
অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৫ সালে কলকাতায় প্রথম প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার পূর্ণচন্দ্র সেন এবং সেক্রেটারি ছিলেন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার মণীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। আর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন অমৃতবাজার পত্রিকার অবনিমোহন মজুমদার ও দ্য স্টেটসম্যান-এর ডব্লিউ. এইচ নানি-সহ মোট ৪৫ জন সাংবাদিক।
 
১৯৪৮ সালে দেশ ভাগের পর এ অঞ্চলে প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। উদ্যোক্তা ছিলেন অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি পি.এম বালান, ইংল্যান্ডের ডেইলি মেইল-এর প্রতিনিধি ও দৈনিক সংবাদ-এর তৎকালীন সম্পাদক খায়রুল কবির এবং বার্তা সম্পাদক সৈয়দ নূরুদ্দিন।
 
প্রায় দুই বছর পর এ আলোচনায় যুক্ত হন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডাইরেকটর অব ইনফর্মেশন সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন এবং দি অবজার্ভারের সম্পাদক আব্দুস সালাম। এক পর্যায়ে এপিপি-র ম্যানেজিং এডিটর এ.এম.এ আজিমকে সভাপতি এবং ইউপিপি-র সম্পাদক আব্দুল মতিনকে সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান প্রেস ক্লাব (ইপিপিসি) নামে স্মারক পরিমেল সমিতি গঠিত হয়।
 
এরপর ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাংবাদিকদের সম্মেলনে প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পরে এ নিয়ে আর আলোচনা এগোয়নি।
 
১৯৫৪ সালের ২০ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেস ক্লাবের নামে মাসিক ১০০ টাকা ভাড়ায় বরাদ্দ করা হয় ১৮ তোপখানা রোডের সরকারি লাল রঙের ভবনটি। ১৯৪৭-এর আগে এ বাড়ি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোয়ার্টার ছিল এবং এতে বাস করতেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পরে বাড়িটি প্রেস ক্লাবের নামে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চিফ সেক্রেটারি এন. এম খান। এজন্য তাঁকে প্রেস ক্লাবের প্রথম আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়।
 
পূর্ব পাকিস্তান প্রেস ক্লাবের প্রথম সভাপতি হন দৈনিক আজাদ-এর যুগ্ম সম্পাদক মুজীবুর রহমান খাঁ। প্রথম সম্পাদক ছিলেন দৈনিক সংবাদের জহুর হোসেন চৌধুরী। প্রথম বৈঠকের পর ১৯৫৫ সালের ১২ জানুয়ারি, ব্যবস্থাপনা কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রেস ক্লাবকে ক্লাব হিসেবে রেজিস্ট্রি করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৫৯-৬০ সালে।
১৯৭২ সালের ৫ মার্চ তৎকালীন সভাপতি আবদুল আউয়াল খানের নেতৃত্বে ক্লাবের নাম পূর্ব পাকিস্তান প্রেস ক্লাব-এর পরিবর্তে জাতীয় প্রেস ক্লাব রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর আগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রেস ক্লাব ভবনে মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। অপারেশন সার্চলাইট পুরো ক্লাব ভবনটি বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলো।
 
১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এ জায়গাটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের নিজস্ব জায়গা হিসেবে বরাদ্দ দেয় এবং নতুন ভবন নির্মাণ করে। ১৯৫৫ সালে ক্লাবের লোগো নির্বাচন করা হয়। আর ১৯৯৫ সালে প্রেস ক্লাবের পতাকা ও প্রতীক নির্বাচন করা হয়।
 
পঞ্চাশের দশকে প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিল প্রায় পঞ্চাশ জন। ১৯৬১ সালে সাংবাদিকদের প্রথম ওয়েজ বোর্ড ঘোষিত হয়। এর পর সংবাদপত্র, সাংবাদিক এবং সে সঙ্গে ক্লাবের সদস্য সংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকারি অর্থে জাতীয় প্রেস ক্লাবের বর্তমান ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের দুটি অডিটোরিয়াম, ভিআইপি লাউঞ্জ, ক্যান্টিন, টিভি কক্ষ, অতিথিশালা, কম্পিউটার সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার আছে।
 
জাতীয় প্রেস ক্লাবের বর্তমান গঠনতন্ত্রে জীবন, স্থায়ী ও সহযোগী-এই তিন শ্রেণির সদস্যপদ দেওয়ার বিধান রয়েছে। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা ও প্রেস ক্লাবের প্রতি বিশেষ অবদানের জন্য জীবন সদস্যপদ, পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য স্থায়ী সদস্যপদ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তাদের সহযোগী সদস্যপদ দেওয়া হয়। সহযোগী সদস্যদের ভোটাধিকার নেই। সব মিলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের এখন সদস্য সংখ্যা প্রায় আটশ আর ক্লাব পরিচালনা কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৭ জন।
বিভিন্ন সময় এ জাতীয় প্রেস ক্লাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মুজীবুর রহমান খান, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম, আবদুল মতিন, এ এম এ আজিম, তফাজ্জল হোসেন, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, এ বি এম মূসা, শহীদুল হক, আবদুল আওয়াল খান, এ জেড এম এনায়েতুল্লাহ খান, আনোয়ার হোসেন, আবুল হাশেম, গিয়াস কামাল চৌধুরী, ফাজলে রশীদ, মোজাম্মেল হক, হাসান শাহরিয়ার, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মনিরুল আলম, শওকত মাহমুদ, শ্রী স্বপন কুমার সাহার মতো দেশ বরেণ্য সব সাংবাদিক।
 
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের এ ধরনের সংগঠন প্রেসগিল্ড নামেও পরিচিত। বর্তমানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম এবং সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন।