‘বীর’ এর নেই কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ!


‘বীর’ এর নেই কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ!

এখন থেকে সব ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দটি ব্যবহার করতে হবে। এই শব্দ ব্যবহারের বিধান রেখে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আদেশটি জারি করা হয়।

তবে এই ‘বীর’ শব্দটির অর্থ কি! ইন্টারনেট, আভিধানিক ইত্যদি অর্থ মতে-

খুবই সাধারনভাবে ‘বীর’ শব্দ দ্বারা আমরা বুঝি এমন একজন ব্যাক্তি, যিনি অসাধারন কিংবা অতি মানবীয় গুনাবলীর অধিকারী। যার অসাধারন কর্মকান্ড দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর। যার শক্তিমত্তা বিপুল, দুঃসাহসিক কার্যাবলী সম্পাদন ও বুদ্ধি-কৌশল প্রয়োগ তুখোড়।

তবে, প্রাচীন গ্রীক পৌরাণিকে আবার বীরের অর্থ কিছুটা ভিন্ন। যা একজন অর্ধ দেবতা ও অর্ধ মানব চরিত্রের অধিকারী। সাথে আছে শক্তিমত্তা ও দুঃসাহসিকতা। দেবরাজ জিউস এবং মানবী আল্কমেনের পুত্র হারকিউলিস এমনই একটি চরিত্র। গ্রীকদের কাছে তিনি ‘বীর’। পরবর্তীতে, প্রাচীন গ্রীসে পুরুষ ও নারী উভয় চরিত্রেই দেবতার পরিচিতি ঘটানো হয়। ধর্মীয় ভাবনার আলোকে এই বীরেরা বিভিন্ন বিপদ আপদকে পাশ কাটিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

প্রাচীন ও বর্তমান উভয় সময়েই বিভিন্ন বীরত্বের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধর্মে বীরদের আগমন। এক্ষেত্রে রামায়নের ইন্দ্রজিত, মহাভারতের ভীম বা দ্রোণাচার্য কিংবা শাহানামার রুস্তম বা ইসফানদিয়ার আবার নিজ বাহুবলে বলিষ্ঠ।

ইসলাম ধর্মে আবার বীরত্ব অস্ত্র নির্ভর নয়, বরং যিনি ক্ষমা, দয়া, দান, রাগ নিয়ন্ত্রন ও তাকওয়া অবলম্বনকারী তাকেই ‘বীর’ বলা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে হামজা, আলী, খালিদ বা সালাউদ্দিন আয়্যুবি সবাই ‘বীর’ হিসাবে পরিচিতি পেলেও তাদের ‘বীর’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়নি। কারন তাদের ও মুসলিমদের বিশ্বাস অভিন্ন; শক্তি আল্লাহর উপহার, এটা বীরদের নিজস্ব নয়।

পূর্বে শুধুমাত্র যুদ্ধ জয় কিংবা বিদ্রোহ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখা ব্যাক্তিদেরই বীরের মর্যাদা দেয়া হতো, তবে আধুনিক বিশ্বে এই প্রাচীন অর্থ পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে অসম্ভব সাহসিকতা বা বীরত্ব প্রদর্শন করাকেও বীরের মর্যাদা দেয়া হয়। যেকোনো ধরনের সৎ, সাহস, মানুষের কল্যাণে আসে এমন যে কোনো কাজ করা ব্যাক্তিকেও ‘বীরে’র খেতাব দেয়া হয়।

বর্তমানে ক্রীড়াক্ষেত্রেও এই শব্দের প্রয়োগ করা হয়। যেকোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় কোনো পদকপ্রাপ্ত অথবা যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকমন্ডলে দেশের নাম উজ্জল হয় এমন ক্ষেত্রেও ‘বীরে’র সম্মান দেয়া হয়।

১৮৪১ সালে থমাস কার্লাইল, ‘অন হিরোজ, হিরো ওরশীপ এন্ড দ্যা হিরোইক ইন হিস্ট্রি’ শিরোনামে একটি বই লেখেন। এই বইয়ে তিনি তাদেরকেই বীরের মর্যাদা দিয়েছেন, যারা সাংগঠনিক পরিবর্তন করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলেন। এতে ভালো-মন্দ উভয় ব্যাক্তিরাই জায়গা পেয়েছিলেন। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুইডিশ কূটনীতিবিদ রাউল ওয়ালেনবার্গ প্রায় দশ হাজার ইহুদির জীবন বাঁচিয়ে বিশ্বের কাছে বীরের মর্যাদা পেয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে এই বিষয় নিয়ে অনেক মতান্তরও রয়েছে।

একেক ধর্ম, সমাজ, দেশে আর সময়ে বীরের সংজ্ঞাটা আসলে একেক রকম। তবে বাঙ্গালীর কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় অংশ নেয়া প্রতিটি মানুষই ‘বীর’। এক্ষেত্রে দেখা হয় না জাতি, ধর্ম, বর্ণ অথবা সমাজ।