সাংবাদিকদের যে কারণে আর্কাইভ ব্যবস্থা দরকার


সাংবাদিকদের যে কারণে আর্কাইভ ব্যবস্থা দরকার

 

একজন আর্কাইভিস্ট হিসেবে রহস্যনির্ভর চলচ্চিত্রের একটি গতানুগতিক দৃশ্য আমার খুব ভালো লাগে: একজন সাংবাদিক তার গ্যারেজে রাখা ফাইলপত্রের স্তুপের মধ্য থেকে একটি ধুলোপড়া বাক্স বের করছেন, অবিশ্বাস্যভাবে সেই বাক্সে কোনো পোকামাকড় বা ছত্রাকের অস্তিত্ব নেই, কিন্তু তাতেই লুকোনো সেই মোক্ষম প্রমাণগুলো, যা দিয়ে ছবির অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা যায়। দৃশ্যটিকে আমার কাছে ফ্যান্টাসি মনে হয়, যে কোনো সিনেমার শেষে মধুরেণ সমাপয়েতের মতোই।

আমি কয়েক বছর একটি নিউজরুমে সাংবাদিকদের পাশাপাশি কাজ করেছি। সেখানে দেখেছি, বিভিন্ন ফাইল ও কাগজপত্র কতটা অগোছালো অবস্থায় থাকে। কাগজ বা কম্পিউটার – দুই ক্ষেত্রেই। আমি সহকর্মীদের দেখেছি, রিপোর্টিংয়ের প্রক্রিয়াতেই ডুবে থাকতে। একটি প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার আগেই, তাদের নতুন আরেকটি প্রতিবেদনের জন্য ফাইল গুছাতে হতো। ফলে, পুরোনো কোনো বিষয়ে আবার খোঁজ করতে হলে, অথবা রিপোর্টে তিনি যে উপসংহার টেনেছেন তা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হলে এবং সেগুলো আবার পর্যালোচনার দরকার পড়লে, রিপোর্টাররা একেবারে এলোমেলো অবস্থার মধ্যে পড়ে যেতেন।

কোনো প্রকল্পের মাঝখানে এসে বিপুল পরিমাণ ডাউনলোড করা ডেটা কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে বিপদে পড়ার চেয়ে, অনুসন্ধানের উপকরণ কোথায় সংরক্ষণ করা হবে সে ব্যাপারে আগে থেকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা সহজ।

 

 

ডেটার যত্ন নিতে সময় ও অর্থ লাগে ঠিক, কিন্তু রিপোর্টিংয়ের অপূরণীয় কোনো তথ্য খোয়া গেলে, তার জন্য আরও অনেক বেশি দাম চুকাতে হয়। সেটি হতে পারে কোনো সাক্ষাৎকার যা আবার নেওয়া প্রায় অসম্ভব, অথবা এমন কোনো সরকারি নথি যা একটি ওয়েবসাইটে ছিল কিন্তু পরে গায়েব, হতে পারে অডিও রেকর্ডে লুকিয়ে থাকা একটি ডিটেইল অথবা কোনো ইমেইল আলাপচারিতা, নাকি কোনো টেক্সট মেসেজ?

অনুসন্ধানের জিনিসপত্র সংরক্ষণের পরিকল্পনা করার সময় ভারসাম্যের জন্য সাংবাদিকদের তিনটি প্রধান বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। আমি যে কাজে পটু, তথ্য সংরক্ষণের সেই সাধারণ দিকটি তো আছেই, কিন্তু এর সঙ্গে আইনি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখা চাই।

মিডিয়া অ্যাটর্নি লিন ওবেল্যান্ডার, ইন-হাউজ পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন দ্য নিউ ইয়র্কারে, আমার সাবেক কর্মস্থল দ্য ইন্টারসেপ্টে এবং আরও বেশ কিছু নিউজরুমে; এবং এখন কাজ করছেন আইনি প্রতিষ্ঠান ব্যালার্ড স্পাতে। তাঁর মতে, “একটি মৌলিক নীতি হলো, সাংবাদিকরা কীভাবে তাদের কাজ করবেন সেটি আইনি দায়বদ্ধতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া উচিৎ নয়।” তবে তাঁর পরামর্শ হলো, নোট বা রেকর্ড গুছিয়ে রাখার কারণে ভবিষ্যতে কোনো রিপোর্টারের উপকার হলে, সেই নথিপত্র সংরক্ষণ করে রাখাই ভালো।

অবশ্য, অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রতিবেদনের বেলায় তথ্য সংরক্ষণের যে ঝুঁকি, তা-ও বিবেচনার নিতে বলেছেন লিন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “আপনি যদি গোপন কোনো সোর্সের সঙ্গে কাজ করেন এবং সেই রেকর্ডগুলো আবার দেখার প্রয়োজনীয়তা না থাকে, এবং আপনাকে স্পষ্টভাবে বলা না হয় যে, এখানে মামলার ঝুঁকি আছে – তাহলে সেই সোর্সের দেওয়া জিনিসপত্র ফেলে দেওয়ার চর্চা শুরু করাই উত্তম।” এসব ক্ষেত্রে সোর্সের ওপর থেকে ঝুঁকি কমানোর জন্য, যথার্থ নিরাপত্তা প্রোটোকল মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আপনি ব্যবহার করতে পারেন ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়- এমন কম্পিউটার, এনক্রিপ্টেড মেসেঞ্জিং টুল ও হার্ড ড্রাইভ, এবং নিতে পারেন এমন আরও কিছু পদক্ষেপ।

রিপোর্টারদের জন্য আরেকটি সাধারণ নীতির কথা উল্লেখ করেছেন লিন: “যাই করা হোক না কেন, ধারাবাহিকভাবে করে যেতে হবে। যদি তাদের কাছে গত ২০ বছরের সব নোট থাকে এবং মাত্র একটি প্রতিবেদনের নোট তারা মুছে ফেলেন এবং দেখা গেল সেটিতেই গোলমাল হয়েছে — এটি একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।”

আমি কয়েক বছর একটি নিউজরুমে সাংবাদিকদের পাশাপাশি কাজ করেছি। সেখানে দেখেছি, বিভিন্ন ফাইল ও কাগজপত্র কতটা অগোছালো অবস্থায় থাকে।

ডিজিটাল সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ধারাবাহিকতা প্রধান বিষয়। আর্কাইভিস্টদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট সূত্র থাকে না যে, কিভাবে ফোল্ডারগুলো সাজাতে হবে/নামকরণ করতে হবে, বা কত দিন পরপর ব্যাকআপ নিতে হবে। বরং আমরা এমন একটি ব্যবস্থা তৈরির পরামর্শ দেই, যেটি আপনার কাছে অর্থবহ হয়। এখানে আপনি সাধারণ কিছু বিষয় প্রয়োগ করতে পারেন, যেগুলো আমি নিচে ব্যাখ্যা করব। তারপর সেই নীতিতে অটল থাকতে হবে।

সংক্ষিপ্ত এই প্রবন্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ হয়নি। তবে এটুকু বলা যায়: এটি বেশ কিছু অভ্যাসের একটি সামগ্রিক ইকোলজি। এর শুরুটা হয় সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ বা কোনো ম্যাটেরিয়াল তৈরির সময়। এরপর আপনি কী বিষয়ের ওপর রিপোর্ট করছেন বা যে দেশে কাজ করছেন সেখানকার নির্দিষ্ট কোনো আইন – ইত্যাদি মাথায় রেখে আপনাকে সব কিছু গুছিয়ে রাখতে হবে। এবং এগুলো নিরাপদে রাখার ক্ষেত্রে সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধারাবাহিকতা। আপনি যদি সুপারিশকৃত নিরাপত্তা প্রোটোকলের একটি ধাপও ছেড়ে আসেন, তাহলে সেটি আপনার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র বা গোপনীয় সোর্সের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

নিরাপত্তা এবং পরবর্তী সময়ে সহায়তা পাওয়া – এই দুই কারণেই আর্কাইভিংয়ের কাজে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)-এর গবেষণা সম্পাদক ও লাতিন আমেরিকা সমন্বয়ক এমিলিয়া ডিয়াজ-স্ট্রাক। কোনো অনুসন্ধানী প্রকল্প শুরুর আগে সাংবাদিকদের প্রতি তার প্রধান পরামর্শ হলো: “আগেভাগে পরিকল্পনা করুন।” কোনো প্রকল্পের মাঝখানে এসে বিপুল পরিমাণ ডাউনলোড করা ডেটা কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে বিপদে পড়ার চেয়ে, অনুসন্ধানের উপকরণ কোথায় সংরক্ষণ করা হবে সে ব্যাপারে আগে থেকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা সহজ।

এখানে সাধারণ কিছু পরামর্শ থাকছে যেগুলো দিয়ে সাংবাদিকরা তথ্য সংরক্ষণের চর্চাকে আরও উন্নত করে তুলতে পারেন। এগুলো অবশ্য শুধু কম বা মাঝারি পর্যায়ের নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রতিবেদনগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের রিপোর্টিংয়ের জন্য আরও কঠোর প্রোটোকল প্রয়োজন। তখন হয়ত সব উপকরণ একটি এয়ার-গ্যাপড কম্পিউটারে (যেসব কম্পিউটারের ওয়্যারলেস কার্ড খুলে ফেলা হয়েছে এবং সেটিকে কখনো ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি) সংরক্ষণ করে রাখতে হতে পারে, কিছু নির্দিষ্ট জিনিস ধ্বংস করে ফেলতে হতে পারে, এমনকি শারিরীক নিরাপত্তা সংক্রান্ত পদক্ষেপও নিতে হতে পারে।

 

 

১. প্রাসঙ্গিক ফাইলগুলো একটি ফোল্ডারে রাখুন এবং সেটির একটি অর্থবহ নাম দিন

আপনার প্রকল্পগুলোকে একটি অর্থবহ নাম দেওয়ার ধারাবাহিক অভ্যাস গড়ে তুলুন। এখানে থাকতে পারে তারিখ, যে প্রকাশনার জন্য লিখছেন তার নাম এবং কিছু বর্ণনামূলক শব্দ। যেমন, “২০২১০৭_জিআইজেএন_ডিজিটাল প্রিজারভেশন”- এটি হতে পারে একটি সহজ ফাইল নামকরণ পদ্ধতি। এভাবে প্রতিটি প্রকল্পের জন্যই আলাদা ফোল্ডার তৈরি করুন এবং প্রাসঙ্গিক সব কিছু সেই ফোল্ডারের ভেতরে রাখুন। হার্ড ড্রাইভে সার্চ করেও আপনি বিভিন্ন ফাইল খুঁজে পেতে পারেন। কিন্তু এভাবে সব কিছু গুছিয়ে রাখলে আপনি সময় বাঁচাতে পারবেন। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্ক্রিনশট, ছবি, অডিও ও ভিডিও সংরক্ষণ করে রাখার ক্ষেত্রে, যা প্লেইন টেক্সট দিয়ে সার্চ করা যায় না। কম্পিউটার, ক্যামেরা বা অডিও রেকর্ডারে তৈরি ফাইলগুলোতে প্রায়ই একই ধরনের নামকরণ করা হয়। তাই, এগুলো পরবর্তীতে ঠিকঠাক নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ফোল্ডারে গুছিয়ে রাখা উচিৎ।

যদি ভয় থাকে – সরকার বা কোনো কোটিপতির চাপে আপনার প্রতিবেদনটি সরিয়ে নেওয়া হতে পারে, বা এমনিতেই আপনি যদি আপনার কাজের একটি যথার্থ রেকর্ড রাখতে চান – তাহলে আপনার উচিৎ চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি ভালোভাবে সংরক্ষণ করা।

যে ফাইলগুলোতে আপনার সবচে গুরুত্বপূর্ণ ডেটা আছে বা যেগুলো আপনি লেখায় সূত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন ভাবছেন, সেই ফাইলগুলো নতুনভাবে নামকরণ করা কাজের হতে পারে। আপনার কাছে যদি কাগজে লেখা নোট থাকে বা প্রাসঙ্গিক নথি থাকে, সেগুলোও ডিজিটাল ফোল্ডারের মতোই একই নামের একটি কাগজের ফাইলে সংরক্ষণ করুন। তাহলে পরবর্তীতে আপনি দ্রুতই এই দুই জায়গার মধ্যে সংযোগটি ধরতে পারবেন। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিবেদন প্রকাশের চুক্তিও যত্ন করে সংরক্ষণ করুন। কারণ প্রতিবেদনের মালিকানা ও পুনঃব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন নিয়ম থাকতে পারে।

যেসব ডেটা ও নথি আপনি আপনার প্রতিবেদনের দাবির সপক্ষে ব্যবহার করবেন, সেগুলোর জন্য আলাদা একটি ফোল্ডার তৈরির বিশেষ পরামর্শ দিয়েছেন আইসিআইজে-র ডিয়াজ স্ট্রাক। পরে কিছু ফাইল মুছে ফেলার সময়ও, লিখে রাখুন কোনটি মুছে ফেলেছেন এবং সেই তথ্য কোথা থেকে পেয়েছিলেন। তখন কেউ আপনার বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ জানালে আপনি চট করে প্রাসঙ্গিক তথ্যপ্রমাণ বের করতে পারবেন বা স্মৃতি থেকে বলতে পারবেন, কিভাবে আপনি সেই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন। আইসিআইজেতে ডেটা নিয়ে কাজের সময় ডিয়াজ স্ট্রাকের সহকর্মীরা সব ডেটার মূল ফাইলগুলো এক জায়গায় গুছিয়ে রাখেন। এবং শেষপর্যন্ত তারা ডেটার যে সংস্করণটি থেকে রিপোর্ট করেছেন, সেটিও গুছিয়ে রাখেন। ডেটা ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি ও পরিবর্তনগুলোও তারা লিপিবদ্ধ করেন এবং মূল ডেটার সঙ্গে এই পুরো পদ্ধতিটির নথিও তারা সংরক্ষণ করেন।

 

২. ফাইলের ব্যাকআপ নিন, এবং আবার ব্যাকআপ নিন

আর্কাইভ সংক্রান্ত কাজের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে LOCKSS: “Lots Of Copies Keeps Stuff Safe.” (অনেকগুলো কপি সব কিছু নিরাপদে রাখে)। ডিজিটাল ফাইলের নতুন একটি কপি এতো সহজে তৈরি করা যায় যে, এক সাথে বেশ কয়েক কপি ফাইল আপনি রেখে দিতে পারেন। এটি আপনাকে ডেটা হারানো সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে সাহায্য করবে। আপনার ফাইলগুলোর অন্তত একটি কপি অন্য জায়গায় সংরক্ষণ করাটাও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, কম্পিউটারের ফাইলগুলো একটা পোর্টেবল হার্ড ড্রাইভে কপি করে রাখাটা একটি দারুন শুরু হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি কম্পিউটার ও ব্যাকআপ ডিস্ক- দুটোই এক জায়গায় রাখেন, এবং কোনো কারণে সেই জায়গাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আপনি সব ডেটাই হারাবেন, যদি না আপনি ফাইলগুলো ক্লাউডেও আপলোড করে রাখেন। আবার একইভাবে, ক্লাউডে আপলোড করা ব্যাকআপ যদি কাজ না করে, তাহলেও আপনি ডেটা হারানোর ঝুঁকিতে থাকবেন, যদি না সেগুলো আপনার হার্ড ড্রাইভে সংরক্ষণ করা থাকে।

ফাইলগুলো একটি এক্সটারনাল হার্ড ড্রাইভে ব্যাকআপ নিয়ে রাখুন। অ্যাপলের টাইম মেশিন ও উইন্ডোজের ব্যাকআপ এই প্রক্রিয়াটিকে স্বয়ংক্রিয় করে ফেলতে পারে। অথবা গুরুত্বপূর্ণ ফোল্ডারগুলো নিয়মিত ব্যাকআপ নিয়ে রাখার জন্য ক্যালেন্ডারে একটি রিমাইন্ডার দিয়ে রাখুন। ড্রাইভটি যখন পূর্ণ হয়ে যাবে, তখন এটিকে স্পষ্টভাবে নামকরণ করে ঠাণ্ডা ও শুষ্ক জায়গায় সংরক্ষণ করুন। নামকরণের ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে পারেন, কোন সময় থেকে কোন সময়কার তথ্য আপনি এটিতে সংরক্ষণ করেছেন। আপনি যদি আর্কাইভের জন্য অর্থ খরচ করতে রাজি থাকেন, তাহলে রেইড অ্যারে ব্যবহার করতে পারেন। এটি আসলে একটি পরস্পর সংযুক্ত হার্ড ড্রাইভ ব্যবস্থা। রেইড ড্রাইভ অনেক উপায়ে ডেটা সংরক্ষণ করে, যার ফলে একটি ড্রাইভ ব্যর্থ হলেও ডেটাগুলো সুরক্ষিত থাকে। আপনার অনুসন্ধানী প্রকল্পটি যদি সংবেদনশীল হয়, তাহলে সুরক্ষিত পাসওয়ার্ড ব্যবস্থা দিয়ে ড্রাইভ এনক্রিপ্ট করুন।

সংবেদনশীল নয়, এমন ফাইলগুলো কোনো ক্লাউড সার্ভিসে ব্যাক আপ রাখার কথা চিন্তা করুন। কোন সার্ভিসটি গ্রহণ করবেন, তা নির্ভর করবে আপনার অবস্থান, নির্দিষ্ট চাহিদা, ও বাজেটের ওপর। যেমন, আপনি যদি অডিও ও ভিডিও ফাইল নিয়ে কাজ করেন, তাহলে হয়তো এমন কিছু বেছে নিতে চাইবেন যেটি কম খরচে অনেক জায়গা দেয়। যেমন ব্যাকব্লেজ। অথবা আপনি হয়তো আরও সুরক্ষিত একটি ব্যাকআপ সার্ভিসের কথা চিন্তা করতে পারেন, যেগুলো আপনার দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়। যেমন, সিঙ্ক বা ট্রেসোরিট। এখানে ফাইলগুলো আপলোড করার সময় এবং সংরক্ষণের সময়; দুই বার এনক্রিপ্ট করা হয়।

খুবই সংবেদনশীল ডেটা বা জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা সংক্রান্ত ডেটা হয়তো আপনি কোনো ক্লাউড ব্যাকআপ সার্ভিসে রাখতে চাইবেন না। সেক্ষেত্রে ডেটাগুলো একটি হার্ড ড্রাইভেই ব্যাকআপ নিন। এবং আপনার কর্মস্থল ও বাসস্থানের বাইরে অন্য কোনো জায়গায় সংরক্ষণ করুন। বাড়িতে ও কর্মস্থলে – দুই জায়গাতেই একটি করে কপি রাখুন। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য এটি ভিন্ন কোনো শহরে বা দেশে থাকা বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে রাখতে পারেন। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতই হোক বা কোনো পুলিশি অভিযান, ‍আপনার ডেটা সুরক্ষিত থাকবে। সংবেদনশীল ফাইল কোনো বিশ্বস্ত সহকর্মীর কাছে পাঠানোর জন্য ওনিয়নশেয়ারের মতো টর সার্ভিস ব্যবহার করতে পারেন। তারপর তাকে, যথার্থ নিরাপত্তা প্রোটোকল মেনে সেগুলো সংরক্ষণ করতে বলতে পারেন। এসব পদক্ষেপ নেওয়ার আগে অবশ্যই একজন ডিজিটাল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে নিন। এটিও মাথায় রাখুন যে, সব সময় ব্যাকআপ নেওয়া আর্কাইভিংয়ের একটি প্রধান নীতি হলেও, কখনো কখনো সংবেদনশীল জিনিসের কপি বেশি জায়গায় রাখাও ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

 

৩. চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি সংরক্ষণ করুন

২০১৭ সালে, কর্মীদের ইউনিয়ন গঠন প্রচেষ্টার জবাবে, বিলিয়নিয়ার জো রিকেটস, তার মালিকানাধীন স্থানীয় সংবাদ ওয়েবসাইটের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সাইটের পুরো আর্কাইভও ছিল। সেগুলো অবশ্য একটা সময় আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু এই ঘটনা থেকে পরিস্কার হয়ে গেছে যে, অনলাইন নিউজ কন্টেন্ট কত ক্ষণস্থায়ী হতে পারে। অন্যান্য নানা কারণেও অনলাইন কন্টেন্ট গায়েব হয়ে যেতে পারে। যেমন, কোনো ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (সিএমএস) পরিবর্তন আনা হলে পুরোনো অনেক কন্টেন্ট খুঁজে পাওয়া কঠিন হতে পারে। অথবা কোনো সাইট হঠাৎ করে তাদের ব্যবসায়িক মডেল থেকে আর্কাইভ করা কন্টেন্টকে সরিয়ে দিতে পারে। এবং সেগুলো আর সংরক্ষণ না-ও করা হতে পারে।

ইন্টারনেট আর্কাইভ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডেটা সংরক্ষণ করলেও, এটি প্রতি দিন প্রতিটা সাইটের সব পেজ সংরক্ষণ করে না। ফলে কোনো প্রতিবেদন বা পোস্ট এখানে না-ও থাকতে পারে, অথবা আপনি যে পেজটি খুঁজছেন, তা পাওয়ার জন্য আপনাকে অনেক সময় ব্যয় করতে হতে পারে। যদি ভয় থাকে – সরকার বা কোনো কোটিপতির চাপে আপনার প্রতিবেদনটি সরিয়ে নেওয়া হতে পারে, বা এমনিতেই আপনি যদি আপনার কাজের একটি যথার্থ রেকর্ড রাখতে চান – তাহলে আপনার উচিৎ চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি ভালোভাবে সংরক্ষণ করা। ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রতিবেদনগুলো সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। ওয়েব প্রযুক্তি ক্রমাগত পরিবর্তন হওয়ায়, হয়তো দেখা যাবে ইন্টারনেট আর্কাইভ দিয়ে ভালোমতো সংরক্ষণের পরও পরবর্তীতে প্রতিবেদনের ভিজ্যুয়ালাইজেশন বা অ্যানিমেশন ঠিকঠাক রেন্ডার হচ্ছে না। তাই, আপনার প্রকাশিত সব কাজ যথার্থভাবে সংরক্ষণের জন্য এই পদক্ষেপগুলোর কথা বিবেচনা করুন।

প্রবন্ধটি ইন্টারনেট আর্কাইভে সেভ করুন। এটি করতে পারেন আপনার ব্রাউজারে ওয়েব্যাক মেশিনের এক্সটেনশন যুক্ত করে। সেটিতে ক্লিক করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেজটি সংরক্ষণ করে ফেলবে ইন্টারনেট আর্কাইভ।

ওয়েবসাইটটি পিডিএফ আকারে সেভ করুন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের ফোল্ডারটিতে অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে সংরক্ষণ করুন। পিডিএফ করলে আপনি হয়তো কিছু গ্রাফিক্যাল কন্টেন্ট হারিয়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু পিডিএফকে একটি আর্কাইভের ফরম্যাট হিসেবেই বিবেচনা করা হয় এবং এটি বিভিন্ন জায়গায় সহজে ওপেন করা যায় ও ব্যাকআপ নেওয়া যায়।

ইন্টারঅ্যাকটিভ কন্টেন্টের জন্য, পুরো ওয়েবসাইটটির একটি রেকর্ডিং তৈরি করুন। এ কাজে ব্যবহার করতে পারেন কনিফার। এই ওয়েব রেকর্ডিং টুলটি তৈরি করা হয়েছিল ইন্টারনেট-ভিত্তিক শিল্পকর্ম সংরক্ষণের জন্য। কনিফারের মাধ্যমে আপনি কোনো ওয়েবপেজ ভিডিও আকারে রেকর্ড করতে পারবেন। এরপর সেই রেকর্ডিংটি ডাউনলোড করতে পারবেন ডব্লিউএআরসি ফরম্যাটে (ইন্টারনেট আর্কাইভেও ওয়েবপেজগুলি এই একই ফরম্যাটে সেভ হয়)। আপনি এটিকে পরবর্তীতে ভিডিওর মতো করে চালিয়ে দেখতে পারবেন।

এটি মনে রাখা জরুরি যে, ডিজিটাল আর্কাইভিং একটি চলমান চর্চার বিষয়। এটি এমন কিছু না যে আপনি একবার একটি পদক্ষেপ নিলেন আর তারপর সেটি ভুলে গেলেন। গ্যারেজে পড়ে থাকা ধুলোমাখা বাক্সের মতো কোনো জিনিস ডিজিটাল জগতে নেই। এখানে প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। এবং আপনার ফাইলগুলো যেন ভবিষ্যতে ভালোমতো সংরক্ষিত থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্য আপনাকেও বিকশিত হতে হবে (কল্পনা করুন তো, আপনার ইন্টারভিউ নোটগুলো আপনি এখনো ফ্লপি ডিস্কে রাখছেন!)।

সব শেষে, মনে রাখুন যে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই আপনার সৃজনশীল কাজগুলো সংরক্ষণের জন্য দায়বদ্ধ নয়। আপনি যদি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কর্মকাণ্ডের একটি রেকর্ড রাখতে চান, তাহলে আপনাকে কিছু পদক্ষেপ নিতেই হবে এবং সাংবাদিকদের জন্য এই আর্কাইভিংয়ের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো ফরম্যাটের সংবাদ আর্কাইভ – তা সে কোনো সংবাদপত্রের বান্ডল হোক, কোনো ফিল্ম, রিপোর্টারের স্টেনো প্যাডের ব্যক্তিগত আর্কাইভ, অথবা হাল আমলের বিটস ও বাইটস – সব কিছুই খুব গুরুত্বপূর্ণ, ইতিহাস নিয়ে আমাদের সম্মিলিত বোঝাপড়ার জন্য। আমাদের সময় খুব ক্ষণস্থায়ী বলে রেকর্ডগুলোও ক্ষণস্থায়ী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।

 

বাড়তি রিসোর্স

 

দ্য অ্যাক্টিভিস্টস গাইড টু আর্কাইভিং ভিডিও: যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নিরাপদে ভিডিও তৈরি ও শেয়ার করতে চান, তাদের উদ্দেশে এই সহায়ক ম্যানুয়ালটি তৈরি করেছিল আন্তর্জাতিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, উইটনেস। আপনার কাজ যদি ভিডিও নিয়ে না-ও হয়; তারপরও এই পরামর্শগুলো সাংবাদিকদের জন্য অনেক প্রাসঙ্গিক হবে। এখানে আলোচনা করা হয়েছে কিভাবে মেটাডেটা ফাইল তৈরি, বিশ্লেষণ ও ডিলিট করতে হয়; সোর্সের সুরক্ষায় আদর্শ চর্চা, নিরাপদে ফাইল স্থানান্তর ও ব্যাকআপ ইত্যাদি নানা বিষয়।

প্রিজার্ভ দিস পডকাস্ট: এটি তৈরি করা হয়েছে স্বাধীন পডকাস্ট নির্মাতাদের জন্য। অপেশাদাররা কিভাবে একটি মিডিয়া আর্কাইভ গড়ে তুলতে পারেন, তার খুঁটিনাটি খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এই সাইটের রিসোর্সে (যার মধ্যে আছে একটি প্রবন্ধ, একটি পডকাস্ট ও একটি ম্যাগাজিন)।

ডিজিটাল প্রিজারভেশন ডট গভ: যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের এই সাইটে বলা হয়েছে কিভাবে অ্যানালগ জিনিসপত্রকে ডিজিটাল সংস্করণে রূপান্তর এবং নিরাপদে সংরক্ষণ করতে হয়।

ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন: ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সোর্সের সুরক্ষা নিয়ে সাংবাদিকদের বেশ কিছু প্রশিক্ষণ-রিসোর্স প্রদান করে এফপিএফ।

এনডেনজারড বাট নট টু লেট: দ্য স্টেট অব ডিজিটাল নিউজ প্রিজারভেশন: আপনি আরও আগ্রহী হলে ইউনিভার্সিটি অব মিজৌরির রেনল্ড জার্নালিজম ইনস্টিটিউটের এই গবেষণাটি দেখতে পারেন। এটির মূল বিষয়বস্তু হলো সংবাদমাধ্যমে আর্কাইভ চর্চা। ডিজিটাল নিউজ কন্টেন্ট সংরক্ষণের জন্য নিউজরুমগুলো কী পদক্ষেপ নিতে পারে, সেই সংক্রান্ত পরামর্শও আছে এখানে। আরজেআই একটি ওপেন সোর্স টুলও বানাচ্ছে, যা গণমাধ্যমগুলোকে কন্টেন্ট সংরক্ষণে সাহায্য করবে।

 

তালয়া কুপার; ছবিটি তার ব্যক্তিগত টুইটার থেকে নেয়া

 

নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক আর্কাইভিস্ট ও গবেষক তালয়া কুপার গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কে লেখাটি লিখেছেন। তিনি দ্য ইন্টারসেপ্ট-এ এডওয়ার্ড স্নোডেন আর্কাইভে এবং স্টোরিকর্পস-এ আর্কাইভ ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। লিখেছেন লাইব্রেরিয়ানদের জন্য নজরদারি-বিরোধী ও প্রাইভেসি সংক্রান্ত প্রযুক্তির গাইড, “অ্যানোনিমিটি”। এখানে তাঁর সহ-লেখক ছিলেন অ্যালিসন ম্যাক্রিনা।

 

বিজেসির পাঠকদের জন্য গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কে প্রকাশিত লেখাটি  হুবহু তুলে ধরা হল।