আরও প্রভাবশালী রিপোর্ট তৈরির ৭টি উত্তম চর্চা


আরও প্রভাবশালী রিপোর্ট তৈরির ৭টি উত্তম চর্চা

ছবি : সংগৃহীত

 

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। এখন পর্যন্ত এটি হয়ে আছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ। চার দশক পেরিয়ে গেলেও, এখনো এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে নির্ভীক, জবাবদিহিমূলক রিপোর্টিংয়ের আদর্শ উদাহরণ হিসেবে।

কিন্তু বোমা ফাটানো এই প্রতিবেদন সাধারণ মানুষের সামনে নিয়ে আসার জন্য ওয়াশিংটন পোস্টের দুই রিপোর্টার বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টেইন নিজের সক্ষমতার সবটুকু দিয়েছিলেন। সত্য উন্মোচনের জন্য এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁরা নানা সোর্স তৈরি করেছেন এবং নিজেদের সব ধরণের রিপোর্টিং দক্ষতা কাজে লাগিয়েছেন।

এশিয়া/প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রভাব তৈরি করা প্রতিবেদনগুলোর সঙ্গে জড়িত অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা দ্বাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে (#জিআইজেসি২১) বলেছেন: কীভাবে গল্পগুলো আকর্ষণীয়ভাবে বলা যায়, যা প্রভাবও তৈরি করবে।

 

১. প্রবেশাধিকার পেতে সৃজনশীল হোন

বেলুচিস্তানের কয়লাখনিতে বন্ধকি শ্রম নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য গার্ডিয়ানের পাকিস্তান প্রতিনিধি শাহ মির বালোচ বুঝেশুনেই ছদ্মবেশ ধারনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। রিপোর্টিংয়ের জন্য এ ধরণের প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া বিপজ্জনক। এতে আইনি ও নৈতিক ঝুঁকি থাকতে পারে। তারপরও কিছু গল্প আছে, যা শুধু এই উপায়েই বলা সম্ভব। খনিতে প্রবেশ করার জন্য, স্থানীয় এক পরিদর্শককে শিক্ষার্থী হিসেবেপরিচয় দিয়েছিলেন বালোচ। বলেছিলেন, একটি গবেষণার জন্য তাঁকে খনি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। পরিদর্শক শুরুতে তাঁকে খনিতে যাওয়ার অনুমতি দেননি। একটু ব্যাখ্যা করে, ‘আমি তাকে বলেছিলাম আমার ব্যাপারে চিন্তা না করতে। এবং শেষপর্যন্ত তিনি আমাকে সেখানে যেতে দিয়েছিলেন এই বিশ্বাস থেকে যে, এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাকে জড়াব না,’ বলেছেন বালোচ।

এভাবেই তিনি উন্মোচন করেছিলেন: কয়লাখনিগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং কর্ম ও জীবনযাপনের নির্মম পরিস্থিতির কথা। 

 

২. ধৈর্যশীল হোন

প্যান্ডোরা পেপার্স নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাংবাদিকদের দুই বছর ধরে ফাইলগুলো সাজাতে হয়েছে, সাক্ষাৎকারের জন্য সোর্স খুঁজে বের করতে হয়েছে, এবং উন্মুক্ত নথিপত্র বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। তারপরই কেবল এটি প্রকাশযোগ্য হয়েছে। ফলে গল্পটি ভালোমতো বলার জন্য কত সময় লাগবে, তা বুঝতে পারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ম্যাকলে কলেজের জার্নালিজম প্রোগ্রামের প্রধান সু স্টিফেনসন বলেছেন, এই বাস্তবতা দিনশেষে সাংবাদিকদের ভালো প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। ‘এতে করে আপনি প্রয়োজনীয় গবেষণা করতে পারবেন এবং প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িত প্রাসঙ্গিক সবার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন’।

 

৩. ঠিক পথে থাকার জন্য টাইমলাইন তৈরি করুন

টোকিওর অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম তানসার রিপোর্টার নানামি নাকাগাওয়া বলেছেন, ‘সাংবাদিকদের উচিত টাইমলাইন তৈরি করা, অগ্রগতির হিসেব রাখা, এবং প্রতিটি পদক্ষেপের রেকর্ড রাখা, যেন প্রতিবেদনের জন্য কোনো কিছু বাদ না যায়’। তাঁর মতে, ‘টাইমলাইন করা থাকলে, যদি কিছু বাদও পড়ে, তা সহজে পূরণ করা যায়’। কখন কী ঘটেছিল- তার একটি পর্যায়ক্রমিক ব্যাখ্যাও পাবেন টাইমলাইন করা থাকলে। জটিল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে এটি সেরা পদ্ধতি।

ছবি : সংগৃহীত

 

৪. উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ে সম্পর্ক তৈরি করুন

ভালো একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির জন্য আপনাকে সম্পর্ক তৈরি, হাই-প্রোফাইল সংগঠন এবং করপোরেশন থেকে শুরু করে শ্রমিক ইউনিয়ন, রাজনীতিবিদ ইত্যাদি নানান ধরণের মানুষের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা শিখতে হবে। আবার একইসঙ্গে দারোয়ান, কেরানি, বা সরকারি দপ্তরের সেক্রেটারির মতো গেটকিপারদের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি। এই মানুষদের অনেকেই এড়িয়ে যান বা পাত্তা দেন না। কিন্তু প্রায়ই এ ধরণের সোর্স থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যের সূত্র পাওয়া যেতে পারে, যা প্রতিবেদন তৈরির কাজ ত্বরান্বিত করে। ফিক্সারদের সঙ্গে মিলেও কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন বালোচ, বিশেষ করে সাংবাদিকের যদি কোনো জায়গার প্রচলিত ভাষা বা প্রথা সম্পর্কে ভালোমতো জানা না থাকে। ‘ফিক্সাররা জানতে পারেন, প্রতিবেদনটির জন্য আপনাকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে এবং কারও নজরদারির মুখে পড়লে কীভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে,’ বলেন বালোচ।

 

৫. সরেজমিন রিপোর্টিংকে সঙ্গী করুন

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় প্রায়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ওপেন সোর্স রিপোর্টিং। তবে পুরোনো-আমলের সরেজমিন রিপোর্টিংও ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কারণ প্রায়ই এভাবে বেরিয়ে আসে বড় কোনো বিষয়। সোর্সের সন্ধান, নথিপত্র সংগ্রহ করা, ব্যক্তি ধরে ধরে তথ্য যাচাই করার মতো কৌশলগুলো যে কোনো রিপোর্টারের সেরা বন্ধু। প্রায়ই এভাবে এমন সব তথ্য উন্মোচিত হয়, যা প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। বালোচ বলেছেন, মাঠপর্যায়ে গিয়ে বিষয়টির কে, কী, কোথায় দেখার মাধ্যমে সাংবাদিক বিষয়গুলো যেভাবে অনুধাবন করতে পারেন, তা ডিজিটাল কোনো উপায়ে সম্ভব হয় না।

 

৬. সোর্সের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করুন, বন্ধুত্ব নয়

সোর্সের সঙ্গে স্পষ্টভাবে কথা বলুন। কখনোই বেশি ফলাফলের প্রতিশ্রুতি দেবেন না, বা সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা এড়িয়ে যাবেন না। তবে অকপট হওয়া মানেই সব কিছু পুরোপুরি খুলে বলা নয়, করতে পারা ভালো দক্ষতা। এবং প্রধান গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো সূত্রের সঙ্গে শেয়ার না করাই ভালো। বিশেষ করে যদি এটি সংবেদনশীল কোনো হুইসেলব্লোয়ার বা তথ্য ফাঁসের ঘটনা হয়। কঠোরভাবে পেশাদারি সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন অস্ট্রেলিয়ার এবিসি নিউজের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মিডিয়া ডাইভারসিটির ডিজিটাল ডিরেক্টর কেভিন নুয়েন। তিনি বলেছেন, ‍‍‍‘সূত্র আপনার বন্ধু নন, এমনকি যদি আপনি সেই প্রতিবেদন তাদের সাহায্য করার জন্যও করে থাকেন। তাঁরা হয়তো আপনাকে নিয়ে পুরোপুরি খুশি হবেন না’।

 

৭. তথ্য দিয়ে রিপোর্ট করুন, কিন্তু একটি গল্পও বলুন

দুর্দান্ত অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও দীর্ঘ মেয়াদে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না বা নেহাতই সামান্য প্রভাব ফেলে। কারণ, রিপোর্টার, তথ্যগুলোকে একটি ভাষ্যের মালায় বুনতে পারেন না, যা পাঠক আকৃষ্ট করে, এবং তাদের ধরে রাখে। অনুসন্ধানের বিষয় খুবই জটিল ছিল— এমন কোনো অজুহাতই গল্প বলার ক্ষেত্রে খাটে না। ফলে, তথ্য ব্যবহার করুন, প্রমাণ উপস্থাপন করুন, একইসঙ্গে বিষয়টি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নাটকীয় কাঠামো ব্যবহার করুন এবং বিষয়টির প্রভাব ব্যক্তিগত পর্যায়ে বোধগম্য করে তুলুন। পাঠকদের বিষয়টির ভেতরে নিয়ে আসুন, তাঁদেরকে বিষয়টি নিয়ে ভাবিয়ে তুলুন, এবং এটি বিবেচনা করুন যে, কীভাবে প্রতিটি বাক্য দিয়ে পাঠককে গল্পের আরও ভেতরে নিয়ে যাওয়া যায়।

 

(জিআইজেএনে প্রকাশিত আরিঞ্জ চিজিওকের লেখাটি বিজেসি পাঠকদের জন্য সরাসরি তুলে ধরা হলো।)