ফেসবুকে সংবাদ প্রকাশের সময় যা মনে রাখা দরকার


ফেসবুকে সংবাদ প্রকাশের সময় যা মনে রাখা দরকার

ছবি : সংগৃহীত

 

ফেসবুক প্ল্যাটফর্মটি একদিকে ইতিবাচক পোস্টগুলোকে মানুষের কাছে যেমন দৃশ্যমান করে ঠিক তেমনই  নিম্নমানের সাংবাদিকতাকে কোনো ছাড় দেয়না।  পিঙ্ক নিউজের সম্পাদক হিলারি মিশেল বলেন, ফেসবুকে নানা রকম সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এটি বৃহত্তম ট্র্যাফিক সরবরাহকারী। তাই ফেসবুকে পোস্ট করার সময় কিছু করণীয় এবং যা করা যাবেনা তা মানতে হবে।

হিলারি মিশেল রিচ পিএলসির এডিনবরা লাইভে কর্মরত থাকাকালীন একটি পোস্ট নিয়ে সমালোচিত হোন। তিনি প্রকাশনাটির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এক দম্পতির ব্যক্তিগত মুহুর্ত নিয়ে একটি পোস্ট করেন। পরে সেই দম্পত্তির বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। আর্টিকেলটিতে এক দম্পতির অন্তরঙ্গ মুহুর্তের একটি ছবি ছিল। ছবিটি পিক্সেল করা হয়েছিল। কিন্তু ছবিটিকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ডিমনেটাইজেশন বলে আখ্যা দেয় এবং প্ল্যাটফর্মটিতে পোস্টটি এক বছরেও কোনো গুরুত্ব পায়নি বলে জানান হিলারি।

পিঙ্ক নিউজের মাধ্যমে, তিনি সংবাদ প্রকাশকদের বিরুদ্ধে ফেসবুক যে ধরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে সে সম্পর্কে সতর্ক করেন। তবে ফেসবুক প্ল্যাটফর্মটি যে খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটিও উল্লেখ করেন হিলারি। তিনি আরো জানান পিঙ্ক নিউজ ফেসবুক থেকে তাদের মাসিক ট্র্যাফিকের অর্ধেকেরো বেশি (৫৮ শতাংশ) পায়। বাকিগুলো অনুসন্ধান (২৫ শতাংশ), ফ্লিপবোর্ড এবং অন্যান্য ছোট উৎস (৬ শতাংশ) এবং অভ্যন্তরীণ (৬ শতাংশ) দিয়ে গঠিত।

 

ডিমনেটাইজেশন এবং ডাউনর‌্যাংকিয়ে কী হয়?

ফেসবুকের নর্দার্ন ইউরোপের সংবাদ অংশীদারিত্বের প্রধান সারাহ ব্রাউন জার্নালিজম ডট কো ডট ইউকে-কে বলেন যে, সাধারণত ব্যবহারকারীরা যে  বিষয়বস্তুকে অপছন্দ করবে তার বিরুদ্ধে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবস্থা নেবে। এখানে দুটি ক্যাটাগরি আছে। একটি এনগেজমেন্ট বাইট এবং আরেকটি ক্লিক বাইট।

তিনি বলেন, এনগেইজমেন্ট বাইট সম্পর্কে মোটামুটি সবাই জানেন। এটা এমন একটা কৌশল যার মাধ্যমে মানুষ লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করে। এভাবেই টপিকটা মানুষের কাছে পৌঁছায়। ফেসবুক এমন অসংখ্য পোস্ট পায় এবং এনগেজমেন্ট বাইটগুলো শনাক্ত করতে পারে। এই মডেলটায় কিছু নির্দেশিকা থাকে বলে জানান সারাহ ব্রাউন।

এরপর থাকে ক্লিকবাইট। সব ব্যবহারকারীই কখনো না কখনো ক্লিকবাইটের শিকার হয়েছেন। ক্লিকবাইট এমন পোস্টগুলোকে বলা হয় যেগুলোর হেডলাইনের সাথে ভিতরের লেখার কোনো মিলই থাকেনা অনেক সময়। অনেক সময় খুব লোভনীয় হেডলাইন থাকে যা পড়ে পাঠক ধারণাই করতে পারেন না ভিতরে কী লেখা আছে। আবার কখনো লেখাগুলোকেও অতিরঞ্জিত করা হয়।

সারাহ বলেন, এধরণের ক্লিকবাইটে মূলত ফিড কম থাকে। এক্ষেত্রেও কিছু নির্দেশিকা মানা হয় বলে জানান তিনি। তিনি আরো জানান যে কোনো পেজ যদি সন্দেহজনক এবং প্রতারণামূলক হয়, লেখক এবং প্রকাশকদের কোনো তথ্য ছাড়া সংবাদ থাকে সেসবক্ষেত্রে ফেসবুক ওই পেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

সাংবাদিকদের ব্যবহার করা অনেক শব্দের কারণে একটি পোস্ট ক্লিকবাইটের আওতায় ধরা হয় বলে যোগ করেন হিলারি মিশেল। যেমন, মর্মান্তিক, হতবাক, অলৌকিক, আশ্চর্যজনক, আপনি বিশ্বাস করবেন না, অপ্রত্যাশিত, গোপন খবর, এইমাত্র প্রকাশিত যা কখনও জানতেন না, সেলেব বা তারকা (তাদের নাম ব্যবহার করে), 'আপনি বিশ্বাস করবেন না কি করেছেন তিনি ইত্যাদি। এ ধরণের শব্দ ব্যবহারের ফলে একটি লেখা ক্লিকবাইটের আওতায় ধরা হয় বলে জানান তিনি।

 

ফেসবুক ব্যবহারকারীরা প্ল্যাটফর্মে কী দেখেন?

সম্প্রতি ফেসবুক তাদের বিষয়বস্তুর স্বচ্ছতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে মার্কিনভিত্তিক ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের নিউজ ফিডে ঠিক কী দেখেন তা তুলে ধরা হয়। এখানে দেখা যায় যে, ফেসবুকে সর্বাধিক দেখা বিষয়বস্তু পুরো বিষয়বস্তু ভিউয়ের প্রায় ০.০৫ শতাংশ। এটি মূলত নিউজ ফিডে যখন কোনো টপিক আসে ঠিক তখন গণনা করা হয়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে, সবচেয়ে বেশি ভিউ থাকা প্রথম ২০টি ডোমেইন হচ্ছে সব কন্টেন্টের মোট ভিউয়ের ২.২ শতাংশ। যার মধ্যে সবার আগে আছে ইউটিউব। জিআইএফ আছে ২০তম অবস্থানে। আর এর মাঝে আছে ইউনিসেফ, ওয়াশিংটন পোস্ট, আমাজনের মতো বড় ওয়েবসাইটগুলোর ডোমেইন। লিংকের কথাও তুলে ধরা হয়েছে এতে। যাতে বলা হয় সবচেয়ে বেশি ভিউ পাওয়া কন্টেন্টগুলোর মাত্র ১৫ শতাংশের লিংক থাকে।

আর ইউআরএল-এর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে টপ লিস্টে আছে শিকাগো ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদন যা ফাইজার ভ্যাকসিন নেয়ায় একজন ডাক্তারের মৃত্যু নিয়ে করা হয়েছে। মিডিয়া বিশেষজ্ঞ থমাস বেকডালের মতে সংবাদ প্রকাশকদের জানা দরকার যে লেখা পড়ার ওপর খুব কম শতাংশ ভিউ নির্ভর করে।

 

ছবি : সংগৃহীত

 

তাতে কী?

বেকডাল ইমেইলের মাধ্যমে জার্নালিজম ডট কো ডট ইউকে-কে বলেন, এটা সবাই জানে যে ফেসবুকে সর্বোচ্চ পারফর্মিং কন্টেন্ট হয় যা মানুষের দেখতে মজা লাগে। কিন্তু এ ধরণের কন্টেন্ট সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে পারেনা বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, যে ফেসবুকে জনপ্রিয় কন্টেন্ট হলেই তা সাবস্ক্রাইবার বাড়াবে আবার যে কন্টেন্টের জন্য সাবস্ক্রাইব বেশি হবে সেটা ফেসবুকে জনপ্রিয় হবে বিষয়টি তেমন নয়।

তারমতে, ফেসবুকের সেরা বিষয়বস্তুগুলো সেই ধরণের হয় যা সংবাদপত্রে কাজ করবে না।

 

আমরা কি ভুল পথে চলছি?

একট বড় প্রশ্ন হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি কোন ধরণের পোস্টিংকে উৎসাহিত করে? এটি কোন প্রকাশনার ক্ষেত্রে কি ধরণের নৈতিকতাকে উৎসাহিত করে? বেকডাল বলেন, ফেসবুক এমনকিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে যাতে ব্যবহারকারীরা আরো স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এটি এখন নিউজফিড থেকে নেতিবাচক জিনিসগুলো বাতিল করার জন্য ব্যবহারকারীদের জরিপ করতে চাইছে। এমনকি নিম্নমানের বিষয়বস্তুকে একেবারে বাতিল করে অর্থপূর্ণ বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করছে বলেও জানান তিনি।

ফেসবুক যেহেতু ব্যবহারকারীদের জন্য একটি ইতিবাচক প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে সেহেতু সংবাদ প্রকাশকদের নিজেদের পোস্ট নিয়ে ভাবতে বলেন বেকডাল। তিনি মনে করেন, সংবাদমাধ্যম হিসেবে প্রকাশকদের উপলব্ধি করতে হবে যে হার্ড নিউজগুলোর জন্য ফেসবুক সঠিক প্ল্যাটফর্ম নয়।

 

মিম পোস্ট করাই কি এগিয়ে যাওয়ার পথ?

ফেসবুক দর্শক বা পাঠক বৃদ্ধির জন্য একটি দরকারি জায়গা হতে পারে। পিঙ্ক নিউজ গত এক বছরে ৪৭৫ হাজার লাইক থেকে ৫০৭ হাজারে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু মিশেল জানান যে এটি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৭৫ হাজার লাইকে আটকে ছিল। একটি মিম যখন ভাইরাল হয় তখন থেকেই লাইক বাড়তে থাকে।

মিশেল আরো বলেন যে ছবিযুক্ত পোস্ট সবচেয়ে ভালো কাজ করে। বিশেষ করে যেই পোস্টগুলো সেলিব্রেটিদের নিয়ে করা হয়। তাদের ফেসবুকে এখন অনেক ইমোজি, ভিন্নধর্মী মজাদার পোস্ট, ক্যাপশন, লিংক সহ এবং লিংক ছাড়া পোস্ট করা হয় বলেও জানান তিনি।

 

এটি কেমন ধরণের সাংবাদিকতা?

আপনি হয়তো ভাবছেন, কেন একটি সংবাদ সংস্থা রসিকতা এবং মিম নিয়ে মাথা ঘামাবে? ফেসবুক কিন্তু বিভিন্ন ধরণের পোস্ট খুঁজছে, কিছু লিঙ্ক সহ, কিছু আপনার নিজস্ব ছবি এবং ভিডিও সহ। মূল বক্তব্য হচ্ছে শুধু হার্ড নিউজ দিয়ে ভালো পারফরমেন্স আশা করা যাবে না।

মিচেলের পরামর্শ হলো ক্লিকবাইট এড়িয়ে চলা, ছবিযুক্ত পোস্টকে প্রাধান্য দেয়া, ঘন্টায় একবারের বেশি পোস্ট না করা, মূল ভিডিও এবং ছবির সাথে লিংক দেয়া।

 

আর কী করণীয়

ফেসবুকে একটি ভেরিফাইড পেজ থাকার মানে এই না যে তা আপনার পোস্টগুলো কতোটা দেখানো হয়েছে। এরসাথে ভেরিফিকেশনের কোনো সম্পর্ক নেই। ভেরিফিকেশনের মানে হচ্ছে প্রকাশক হিসেবে আপনার বৈধতা নিশ্চিত করা।

সারাহ ব্রাউন বলেন যে তিন উপায়ে সংবাদ প্রকাশকেরা তাদের পোস্টকে প্লাটফর্মে ভিজিবল করতে পারেন। প্রথমত ফেসবুক সবসময় মূল প্রতিবেদন, তথ্য, বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দেয়। তাই এ বিষয় খেয়াল করলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়। দ্বিতীয়ত ফেসবুক সঠিক এবং তথ্যবহুল সংবাদকে প্রাধান্য দেয়। তৃতীয়ত এলাকাভিত্তিক পোস্টগুলোকেও ফেসবুক প্রাধান্য দেয়।

 

পোস্ট করার সময় নিচের দরকারি চেকলিস্টও যা একটি বিষয়কে সংবাদ হিসেবে তুলে ধরবে:

১। বিষয়বস্তুর এই অংশটি কি সময়োপযোগী ঘটনা, চলমান ঘটনা বা অনুসন্ধানের উপর কি প্রতিবেদনটি করা হচ্ছে?  এটা কি সম্পাদকীয় নাকি শুধু মতামত?

২। এই বিষয়বস্তুর অংশটি কি কোনো লেখক, সাংবাদিক বা লেখকের ক্রেডিট দিচ্ছে?

৩। এই বিষয়বস্তুটির তথ্যগুলো কি সঠিক?

৪। এই বিষয়বস্তুর কি সম্পাদকীয় স্বচ্ছতা আছে?

৫। এই বিষয়বস্তুর কি তারিখ অথবা টাইমস্ট্যাম্প আছে?

 

জার্নালিজম ডট কো ডট ইউকে অবলম্বনে সাবরিনা আফরোজ