মর্মান্তিক ঘটনার শিকার ও সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার নেয়ার কৌশল


মর্মান্তিক ঘটনার শিকার ও সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার নেয়ার কৌশল

অবিচার, বৈষম্য, যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে মানুষ যে কষ্ট ও ভোগান্তির মধ্যে পড়ে, সেগুলো নিঃসন্দেহে সাংবাদিকদের আগ্রহের জায়গা। তবে, ট্র্যাজেডির শিকার হয়েছেন- এমন মানুষদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কোনো নির্ভুল বা যথার্থ পদ্ধতি নেই। প্রতিটি ঘটনাই আলাদা, এবং একেক ক্ষেত্রে একেক ধরনের নৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সংশয়ের মুখোমুখি হতে হয় একজন গণমাধ্যমকর্মীকে। এইক্ষেত্রে কিছু কৌশল গ্রহণের পাশাপাশি দুর্ঘটনার শিকার মানুষটির প্রতি হতে হবে মানবিক ও সংবেদনশীল। এছাড়াও তার প্রতি পূর্ণ সম্মান দেখিয়ে সাক্ষাৎকারটি নিতে হবে।এমন সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পর্যাপ্ত মনোযোগ ও সুরক্ষা। যার মধ্যে আছে:

  • সাক্ষাৎকারদাতাদের সুরক্ষা। বিশেষ করে, তারা যেন আবার নতুন করে ভিকটিম না হন;
  • তথ্যের সুরক্ষা;
  • সহকর্মীদের সুরক্ষা এবং
  • নিজের নিরাপত্তা

সাক্ষাৎকার নিতে ছোটার আগে প্রতিবেদনটির কথা আরেকবার ভাবতে হবে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে- শুধুই রিপোর্টিংয়ের জন্য কারো খুবই ব্যক্তিগত মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতি নতুন করে জাগিয়ে তোলার প্রয়োজন আছে কিনা? কী পাবো আমরা  এখান থেকে? এসব চিন্তাভাবনা শেষে যখন চূড়ান্ত হয়ে যাবে যে, প্রতিবেদনে কোনো ভিকটিম বা বেঁচে ফেরা ব্যক্তির সাক্ষাৎকার যোগ করা জরুরি, তখন সেই সাক্ষাৎকার কিভাবে নিতে হবে, তা নিয়ে কিছু পরামর্শ থাকছে এখানে: 

১. সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিন

এই পেশার একটি সাধারণ নিয়ম হলো: নিজের সাংবাদিক পরিচয়টি শুরুতেই স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে, কোনো জায়গায় পরিচয় দেওয়া নিরাপদ না মনে করলে পরামর্শটি এড়িয়ে যান।

২. সময় নিয়ে সাক্ষাৎকার নিন

আপনার হাতে যদি সময় কম থাকে, তাহলে সাক্ষাৎকারদাতাকে আগেই জানিয়ে দিন। এবং মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত প্রশ্ন না করে, সাধারণ কিছু প্রশ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুন। তা না হলে, কেউ হয়তো আপনাকে খুব বেদনাদায়ক কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাইবেন, যা আপনি হয়তো ভালোমতো শুনবেন না। কারণ আপনার তাড়া আছে। শুধুই কী ঘটেছিল ধরনের প্রশ্নের মধ্যে আটকে থাকবেন না। তাদের নিজেদের সম্পর্কেও নানা কিছু জানতে চান। তারা কেমন আছেন, কিভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করছেন, ঘটনাটি তাদের জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে, কিভাবে তারা এই পরিস্থিতির মধ্যে টিকে আছেন, ইত্যাদি।

৩. সাক্ষাৎকারের জন্য ভালো জায়গা বেছে নিন

আদর্শ পরিস্থিতিতে, সাক্ষাৎকার এমন জায়গায় নেওয়া উচিৎ যেখানে আপনি কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়াই কথা বলতে পারবেন। যেখানে ভালোমতো শোনার জন্য উঁচু স্বরে কথা বলতে হবে না। এবং যেখানে কোনো বিপদআপদের ভয় থাকবে না।

৪. সিদ্ধান্ত নিন: রেকর্ড করবেন নাকি নোট নেবেন

সাক্ষাৎকারদাতাকে জিজ্ঞাসা করুন, কথপোকথন রেকর্ড করলে তার কোনো আপত্তি আছে কিনা। সাক্ষাৎকারদাতার চোখে চোখ রেখে কথা বলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি নোটপ্যাড ব্যবহার করেন, তাহলে লিখতে লিখতেই সাক্ষাৎকারদাতার চোখের দিকে তাকান। কথোপকথন রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নিলে, ভালোমতো প্রস্তুতি নিন। কারিগরী সমস্যার জন্য সাক্ষাৎকারের মাঝপথে যেন কোনো সমস্যা তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করুন। এবং ব্যাকআপ নিতে ভুলবেন না। সাক্ষাৎকারে উঠে আসা কিছু বক্তব্য যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, যেমন যদি কেউ প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষদর্শী বা ভিকটিম হিসেবে কোনো ঘটনার ব্যাপারে কথা বলে, তাহলে তা অবশ্যই রেকর্ড করা উচিৎ। এটি হয়তো পরবর্তীতে আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। বা আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্তের কাজে আসতে পারে। 

৫. সাক্ষাৎকারদাতাকে প্রস্তুত করুন

সাক্ষাৎকার শুরুর আগে ভিকটিমের সাথে কিছু সাধারণ আলাপ করে নিন। আপনার অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য কী এবং আপনি এখান থেকে কী আশা করছেন, তা ভালোমতো বুঝিয়ে বলুন। এতে সাক্ষাৎকারদাতা মানসিকভাবে তৈরি হতে পারবেন, কোনো প্রশ্ন তার কাছে আক্রমণাত্মক মনে হবে না, এবং আপনার কাছে তেমন কোনো প্রত্যশাও থাকবে না। সাক্ষাৎকারদাতারা আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন কিনা, বা বলতে চান কিনা- সেই সিদ্ধান্ত তাদেরকেই নিতে দিন।

৬. নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে দিন

ইন্টারভিউ দেয়ার সময়ে সাক্ষাৎকারদাতা যেন কোনো চাপ অনুভব না করেন। সাক্ষাৎকার শুরুর আগে তাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিন, যে প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে ইচ্ছে করবে, তারা শুধু সেগুলোরই জবাব দেবেন। আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লে বা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করলে যে কোনো সময় তারা বিরতি নিতে পারেন বা সাক্ষাৎকার শেষ করে দিতে পারেন। অথবা আপনাকে অনুরোধ করতে পারেন ঝুঁকিপূর্ণ কোনো তথ্য প্রকাশ না করার জন্য। এগুলো তাদের অধিকার। 

৭. প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবুন

মর্মান্তিক ঘটনার শিকার, এমন কোনো ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে গেলে প্রয়োজন সহানুভূতি-বোধ। নিজেকে সেই মানুষটির জায়গায় বসিয়ে চিন্তা করুন: যদি সেই ব্যক্তি আপনার ঘনিষ্ঠ কারো পরিবারের সদস্য হতেন, তাহলেও কি আপনি প্রশ্নটি একইভাবে করতে পারতেন? একইসঙ্গে, এমন প্রশ্ন করুন, যেগুলোর উত্তর উন্মুক্তভাবে দেওয়ার সুযোগ থাকবে। এতে করে ভিকটিম তার ইচ্ছেমতো কথা বলতে পারবেন। 

৮. হয়ে উঠুন মনোযোগী শ্রোতা

সাক্ষাৎকারদাতা ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য আই কন্ট্যাক্ট বজায় রাখুন এবং নিশ্চিত করুন, বাইরের কোনো শব্দ (যেমন মোবাইলের রিংটোন বা ভাইব্রেশন) যেন আপনার মনোযোগ সরিয়ে দিতে না পারে। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় রিপোর্টার হিসেবে আমাদের সব সময় একইসঙ্গে চারটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়: সাক্ষাৎকারদাতা আমাদের কী বলছে, একই জিনিস আবার বলার সময় কী ঘটছে, আমাদের চারপাশে কী ঘটছে (দিনের আলো কমে আসতে পারে বা আশেপাশে অন্য মানুষের উপস্থিতি নজরে আসতে পারে), এবং সাক্ষাৎকারটি কোন দিকে যাচ্ছে। 

৯. এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান, যা ভিকটিমকে অপরাধী বানায়

মর্মান্তিক ঘটনার শিকার কোনো কোনো ব্যক্তি অনেক সময় অপরাধবোধে ভোগেন। তারা নিঃসঙ্গ ও ভীত অবস্থায় থাকেন এবং দেখা যায় খুব অল্প মানুষই তাদের কথা বিশ্বাস করেন। কারণ, তাদের সত্যগুলো প্রায়ই এমন এক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, যেটি গড়ে তোলা হয়েছে অন্যায়-অন্যায্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা মানুষদের সম্মানহানির জন্য। 

আপনার প্রশ্নের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান, যেগুলো ভিকটিমকে অপরাধী বানায়। যেমন “এত রাতে অন্ধকারে হাঁটাহাটি করতে আপনার ভয় লাগে না?” এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার বদলে জিজ্ঞাসা করুন: এই এলাকায় রাতে কি প্রায়ই বিদ্যুৎ চলে যায়? কিংবা এলাকাটি কি বিপজ্জনক? মনে রাখুন, আপনার প্রশ্ন ভিকটিমকে যেন কখনোই দোষী না বানায়।

১০. নির্দিষ্ট কোনো মর্মান্তিক ‍মুহূর্তের স্মৃতি জাগিয়ে তোলার যৌক্তিকতা আছে কিনা, বিবেচনা করুন

কিছু অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এমন নির্দিষ্ট তথ্য দরকার হয়যেখানে প্রচণ্ড মানসিক চাপ বা ট্রমার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যেমন ধর্ষন, যৌন নিপীড়ন বা পুলিশি নির্যাতন নিয়ে কোনো প্যাটার্ন অনুসন্ধানের সময় এমন তথ্য প্রয়োজন হতে পারে। এই ধরনের সাক্ষাৎকার তখনই করা উচিৎ যখন ভিকটিম তা করতে রাজি হবেন এবং কাজের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সেটির যথার্থ যৌক্তিকতা থাকবে। এ ধরনের প্রশ্নগুলো সাক্ষাৎকারদাতার কাছে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠতে পারে। ফলে সেগুলো নিয়ে খুব সংবেদনশীলভাবে কথা বলতে হবে। বিরতি দিয়ে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় নিতে হবে। যদি আপনার অনুসন্ধানে এতো বিস্তারিত তথ্যের প্রয়োজন না থাকে, তাহলে সেই ভিকটিমের আগের কোনো জবানবন্দি থেকে তথ্য সংগ্রহ করাই ভালো। 

১১. ট্রমার গভীরতা বুঝতে বিভিন্ন পথ অবলম্বনের কথা বিবেচনা করুন

শব্দ-বাক্য ছাড়াও আরো নানাভাবে প্রকাশ ঘটে মানসিক চাপ বা আঘাতের। যন্ত্রণাদায়ক সব স্মৃতি নতুন করে সামনে না এনে, কিভাবে আপনি ভিকটিমের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারেন, সেই পদ্ধতি খুঁজে বের করুন। তাদের লেখা কোনো কবিতা, গান বা আঁকা ছবি, ডায়েরির পাতা দেখতে চান। বা তাদের কোনো বিশেষ প্রার্থনার কথা শুনতে চান। এগুলোর মাধ্যমে আপনি তাদের মানসিক ব্যাপারগুলো বুঝতে পারবেন, মানসিক আঘাতের স্মৃতি জাগিয়ে না তুলেই। একটি ভালো কৌশল হলো: ভিকটিমদের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাওয়া। সাধারণত দেখা যায়, স্বপ্নগুলোর ভাষ্য এতো জমাট হয় যে আপনার আর এমন কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনই পড়ে না, যেগুলো তাদের মানসিক আঘাতের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে। 

১২. শান্ত থাকুন

মর্মান্তিক কোনো ঘটনা সম্পর্কে বা কোনো শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কথা বলতে বলতে সাক্ষাৎকারদাতা কেঁদে ফেলছেন। কখনো কখনো আপনার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার মধ্যেও সংবেদনশীলতার অভাব থাকতে পারে, বা বিষয়টির কারণেও তিনি অনেক আবেগী হয়ে উঠতে পারেন। দেখা যাবে, হয়তো সেই ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার ভেতরের অনেক চাপা আবেগ বেরিয়ে আসছে। 

সাক্ষাৎকারদাতা যদি কেঁদে ফেলেন, তাহলে বিচলিত হবেন না। সংবেদনশীল মন নিয়ে জিজ্ঞাসা করুন, তার কী প্রয়োজন। এবং তাকে পানি খেতে অনুরোধ করুন। টিস্যু এগিয়ে দেওয়া সবসময় ভালো বার্তা দেয় না। এতে কখনো কখনো মনে হতে পারে: সাংবাদিক যেন ভিকটিমকে তার আবেগ নিয়ন্ত্রন করতে এবং সাক্ষাৎকার চালিয়ে যেতে বলছেন। কাঁদার সময় ভিকটিমকে জড়িয়ে ধরাও ভুল বার্তা দিতে পারে। এবং এটি না করাই ভালো। বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি শারীরিক নির্যাতন বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। 

কিছু সময়, সাক্ষাৎকারদাতা হতাশা, ক্ষোভ বা বিরক্তি প্রকাশ করতে পারেন। তাদের পরিস্থিতিতে এমন প্রতিক্রিয়া আসা খুব স্বাভাবিক। তারা এমনকি সংবাদমাধ্যম নিয়েও অভিযোগ করতে পারেন। সেগুলো নিয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখানো বা তর্ক করা ঠিক হবে না। বরং, সেগুলো মন দিয়ে শুনুন। যদি পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং আপনি বিপদের আশঙ্কা করেন, তাহলে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজুন।

১৩. ঘুরে দাঁড়ানোর আবহ দিয়ে সাক্ষাৎকার শেষ করার কথা ভাবুন  

বেদনাদায়ক কোনো বিষয়ের ওপর সাক্ষাৎকার নেওয়ার শেষপর্যায়ে আপনি করতে পারেন এ ধরনের প্রশ্ন: “কিভাবে আপনি এসব পরিস্থিতি সামলেছেন?” বা “জীবন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আপনি কী কী করতে পারছেন?” জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তারা কী চিন্তা করছেন, তা নিয়ে কথা বলার জায়গা তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে তারা কথা বলতে পারেন তাদের সম্ভাবনা, ব্যক্তির শক্তি ও সম্মিলিতভাবে লড়াইয়ের গুরুত্ব নিয়ে। এভাবে সাক্ষাৎকার নিতে পারলে বেদনাদায়ক বিষয় নিয়ে আলাপের শেষটা হয় ইতিবাচক ভঙ্গিতে। 

সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে সাংবাদিকের উচিৎ সেই ভিকটিমকে ধন্যবাদ দেওয়া। কারণ তিনি সাংবাদিককে বিশ্বাস করে এমন সব বিষয়ে কথা বলেছেন, যেগুলো হয়তো তার জন্য অনেক কষ্টদায়ক ছিল। বিদায় নেওয়ার আগে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য আদানপ্রদান করে নিন। তবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেবেন না যা আপনি রাখতে পারবেন না। ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এই সাক্ষাৎকার অনেক বড় প্রভাব তৈরি করবে- এমন  কোনো প্রত্যাশাও তৈরি হতে দেবেন না। 

১৪. সব ধরনের সম্ভাব্য পরিণতি বিশ্লেষণ করুন

কিছু পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে যেসব জায়গায় সহিংসতার ঘটনা অহরহই ঘটে এবং কেউ বিচারের আওতায় আসে না, সেসব জায়গায় সাংবাদিককে চিন্তা করতে হবে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সাক্ষাৎকারদাতার পরিণতি কী হতে পারে। তাদের সঙ্গে নিয়েই বিশ্লেষণ করুন যে, এর ফলে কী ধরনের ঝুঁকি আসতে পারে, তারা এ ধরনের ঝুঁকির জন্য প্রস্তুত আছেন কিনা এবং কিভাবে এসব ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়।

প্রতিবেদন প্রকাশের আগে সব তথ্য আরেকবার যাচাই ও মূল্যায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় নিন। সম্পাদকের সঙ্গে বসে ঠিক করুন। সাক্ষাৎকারের কোনো অংশের (যেমন, হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ) জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে কিনা। তেমন আশঙ্কা থাকলে সোর্সকে সুরক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনাও আগে থেকে ভেবে রাখুন। কখনো কখনো এসব ঝুঁকি এড়ানোর জন্য কিছু তথ্য বাদ দেওয়া যেতে পারে, ভালো কোনো সময়ের জন্য অপেক্ষা করা যেতে পারে, বা অন্য কোনো উপায়ে তথ্যটি প্রকাশ করার উপায় খোঁজা যেতে পারে। 

১৫. তথ্যগুলো যাচাই করুন

মানসিক আঘাতের ঘটনাগুলো প্রায়ই স্মৃতিকে প্রভাবিত করে। স্মৃতি বদলে যায়। স্মৃতি থেকে বলা ঘটনাগুলোর ভাষ্যও অনেক সময় অন্যরকম হয়ে যায়। কেউ হয়তো ভয়ের কারণে অন্যরকম বলে। কেউ হয়তো ঘটনাটি নিয়ে বোঝাপড়ার জন্য ভাষ্য বদলে দেয়। কেউ কেউ কিছু ব্যাপার ইচ্ছা করে ভুলে যেতে চায়। সময়ের সাথে সাথে বা সম্প্রতি অন্য কারো কাছ থেকে শোনা কথার কারণেও স্মৃতি থেকে বলা ভাষ্যের বদল ঘটে। এসব কারণে এ ধরনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে, সঠিক তথ্যটি বের করে আনার জন্য বাড়তি প্রস্তুতি ও মনোযোগ প্রয়োজন। প্রতিবেদনকে সমর্থন জোগায়, এমন বক্তব্যগুলো আপনাকে বের করে আনতে হবে। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় নিন। 

আপনার কাজটি যদি অনুসন্ধানী ধরনের হয়, তাহলে ভালোমতো রিপোর্টিং করাটা গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভাব্য সব ধরনের প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজ করতে হবে। এমন সব প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে যেগুলো আপনার প্রতিবেদনের বক্তব্যকে সমর্থন করে। তবে মাথায় রাখবেন, আপনার বক্তব্য বা অনুমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন তথ্য পেলে সেটিও কোনোভাবেই বাদ দিয়ে দেওয়া যাবে না।

মানসিক আঘাতজনিক কোনো ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়, তাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিন সাক্ষাৎকারটি আপনি কী জন্য নিচ্ছেন। এটি কী কোনো বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ হাজিরের জন্য নেওয়া হচ্ছে? নাকি কোনো কিছু যাচাইয়ের জন্য? নাকি আপনি কারো বক্তব্যের বিপক্ষ যুক্তিগুলো তুলে ধরে প্রতিক্রিয়া চাইছেন? আপনি যদি হামলার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির বা কর্তৃপক্ষের সাক্ষাৎকার নিতে যান, তাহলে মনে রাখবেন, তাদের কথাই শেষ কথা নয়। আপনার কাজের মধ্য দিয়ে যেন ভিকটিমকেই আবার ভিকটিম না বানানো হয়। ভিকটিমের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ উঠে থাকে, তাহলে সে ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়াও অবশ্যই নেওয়া উচিৎ প্রতিবেদন প্রকাশের আগে। 

সাংবাদিকতার প্রধানতম একটি নিয়ম যেমন তথ্য যাচাই করা; তেমনি এই ধরনের কাজের ক্ষেত্রে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হচ্ছে ভিকটিমকে নতুন করে ভিকটিম না বানানো।

 

লেখাঃ মার্সেলা তুরাতি, মেক্সিকান সাংবাদিক