ভালো লিখতে হলে একজন সাংবাদিকের যা জানা দরকার


ভালো লিখতে হলে একজন সাংবাদিকের যা জানা দরকার

ছবি : সংগৃহীত

 

অনেক সাংবাদিকই লেখালেখির প্রতি তাদের ভালোবাসা থেকে সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত হোন। আমরা শব্দের পর শব্দ গেঁথে বাক্য সৃষ্টি করি গল্প বলার জন্য তবে সবসময়ই  শব্দের সংখ্যা আর ডেডলাইনের দিকে আমাদের নজর রাখতে হয়। অধিকাংশ সময়ই, এই লেখার প্রক্রিয়া এবং সেটা ছাপার অক্ষরে দেখা আমাদের জন্য বেশ উপভোগ্য একটা ব্যাপার।

কিন্তু ভালো লেখা আসলে কী? এটা কি শুধুমাত্র একজন তীক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন সাংবাদিকের অতি সাবধানে সবচেয়ে সুন্দর শব্দমালা চয়ন করার ক্ষমতা? নাকি এটা সংক্ষিপ্ত, যথার্থ এবং পরিষ্কারভাবে একটি গল্প বলার দক্ষতা?

উত্তরটা আপনি জানেন। কিন্তু মাঝেমধ্যেই ছাপা অক্ষরের প্রতি সাংবাদিকদের দুর্বলতাই তাদের ভয়ংকরতম শত্রুতে পরিণত হয় এবং আমরা আমাদের গল্পগুলো অর্থহীন কথাবার্তা দিয়ে ভরিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলি।

পুরষ্কারজয়ী সাংবাদিক স্টিভ গ্যামেল, যাঁর লেখালেখির ক্ষেত্রে ২৪ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে, Journalism.co.uk  তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলো তাঁর নতুন বই “Write Like You Mean It : Mastering Your Passion for the Written Word” নিয়ে কথা বলতে। বইটিতে তথ্য সাজানো থেকে শুরু করে রাইটার্স ব্লক কাটিয়ে ওঠার পদ্ধতিসহ লেখালেখি সংক্রান্ত প্রচুর টিপস রয়েছে যার মাধ্যমে যে কেউ তাদের লেখার মান উন্নত করার চেষ্টা করতে পারেন। আকারের সুবিধার জন্য  সাক্ষাৎকারটি সামান্য সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। বিজেসি নিউজের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

 

একজন লেখক হিসেবে, আপনি বিগত কয়েক দশকে মিডিয়ার জগতে কী কী পরিবর্তন দেখেছেন?

অবশ্যই পরিবর্তন হয়েছে। আগে যেসব শুধু প্রিন্ট-কন্টেন্ট ছিলো, যেমন সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ইত্যাদি, সেগুলোকে ডিজিটাল কন্টেন্টে নিয়ে যাওয়ার একটা ক্রমবর্ধমান চাপ রয়েছে। তাছাড়া, হালের ট্রেন্ড অনুযায়ী কন্টেন্ট এবং ভিডিও তৈরি করতে হয় যাতে সেগুলো বিপুলসংখ্যক সচেতন পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে পারে। গ্রাহকেরা সেই তথ্যই চান যেটা এই মূহুর্তে তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি এখন একটা দৈনন্দিন প্রতিযোগিতার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে প্রত্যেকেই চেষ্টা করছে গ্রাহকের চাহিদা সবার আগে মিটিয়ে প্রথম হতে।

দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত একজন হিসেবে আমি আপনাকে বলতে পারি, যদিও আমি এখনো প্রিন্ট এডিশনগুলোর জন্য লিখি তবে তাদের মূল মনোযোগ অবশ্যই, ‘প্রথমে অনলাইন’ । স্বাভাবিকভাবেই, এটা লেখকদের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের উপযোগী কন্টেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে অনেকটাই বাধ্য করেছে।

কিন্তু লিখিত শব্দ সবসময়ই শক্তিশালী। লেখকদের এখনো লেখা প্রয়োজন, এবং  তাদের লেখনী এবং গল্প বলার ঢং হবে এতো শক্তিশালী যে সেটা প্রথম বাক্য থেকেই পাঠকদের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হবে।

 

ভালো লেখার জন্য আপনার প্রথম তিনটি টিপস কী?

এক নম্বর হলো, আপনাকে গল্প বলতে জানতে হবে এবং গল্পের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখাতে হবে, সে আপনি যে গল্পই বলুন না কেন। আপনি সাংবাদিক, ব্লগার বা নন-ফিকশন লেখক, যা-ই হোন, কাগজে শুধু শব্দের পর শব্দ লিখে যাওয়ার প্রক্রিয়ার ঊর্ধ্বে ওঠার সহজাত ইচ্ছে আপনার থাকতে হবে। আপনি সেই গল্পটা বলুন যেটা মানুষ পড়তে চায়। যেমনটা আমি আমার বইয়ে বলেছি, ‘মানুষ মানুষের সম্পর্কে পড়তে চায়। এটা আপনার লেখাকে আরো সহজবোধ্য এবং আকর্ষণীয় করে তুলবে’।

দ্বিতীয় টিপ হলো কর্তৃবাচ্য ব্যবহারে দক্ষ হওয়া। এটা আপনার লেখাকে শক্তিশালী করার অন্যতম উপায়। কর্তৃবাচ্য ব্যবহার করলে প্রত্যেকটা বাক্যই আরো জোরদার, আরো সোজাসাপ্টা এবং প্রভাববিস্তারে সক্ষম। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পাঠক আপনার লেখার আবেগটি অনুভব করতে পারবেন।

তৃতীয় টিপ হলো নিজেকে গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আরো উন্মুক্ত করে দেয়া এবং সেই গঠনমূলক সমালোচনাগুলোকে সুযোগ হিসেবে নেয়ার অভ্যাস করা যাতে আপনি নিজেকে আজকের চেয়ে আগামীকাল আরো ভালো একজন লেখকে পরিণত করতে পারেন। নিজে অন্যান্য লেখকদের সাথে মিশুন, একে অন্যের কাজ দেখুন এবং সেই সময়টির অপেক্ষা করুন যখন অন্য কোনো লেখক বা মেন্টর আপনাকে এমন কিছু জায়গা দেখিয়ে দেবে কীভাবে আপনি আরো ভালো লিখতে পারতেন এবং ভবিষ্যতেও আরো ভালো লিখতে পারেন।

ছবি : সংগৃহীত

সঠিক শব্দচয়ন অনেক সময় বেশ কঠিন। আপনি সংবেদনশীল বিষয়গুলো, যেমন, ট্রমা, কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা মৃত্যু, কীভাবে সামলান?

বিভিন্ন বিষয়ের জন্য বিভিন্নরকম পন্থা, তাই বিষয়বস্তুই ঠিক করে দেবে যে আপনি কোন পন্থা অবলম্বন করবেন। স্বাভাবিক নিয়ম হলো সচেতনভাবে শুরু করা, কারা আপনার পাঠক সেই সম্বন্ধে জানা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের রীতিনীতি সম্পর্কে সহানুভূতিশীল থাকা এবং আপনার লেখা প্রত্যেকটি শব্দ নিরপেক্ষ এবং সচেতনভাবে ব্যবহার করা।

ধরুন, আপনি সোজাসাপ্টাভাবে সত্যিটা তুলে ধরতে চান, কিন্তু সেটা আপনার এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে এর সাথে জড়িত কিংবা ট্রমা, ট্র্যাজেডির শিকার ব্যক্তি, বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা তার সদস্য আঘাতপ্রাপ্ত না হোন এবং আপনি তাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেন।

আপনি যাদের নিয়ে লিখছেন, শুরুতেই যদি নিজেকে তাদের জায়গায় বসান, তাহলে আপনার পক্ষে শব্দচয়ন করা সহজতর হবে কারণ আপনি সার্বিক পরিস্থিতি, তাতে জড়িত লোকজন এবং আপনার অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। ফলে আপনি গল্পের সবচেয়ে ভালো সংস্করণটা লিখতে পারবেন।

 

একটি আকর্ষণীয় গল্পের অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলো কী কী?

প্রাথমিক পর্যায়ে - ভালো, পরিচ্ছন্ন লেখা। তারপর নিখুঁত ব্যাকরণ, কর্তৃবাচ্য, একটি জোরালো কণ্ঠস্বর, ভিন্নধর্মী বাক্যবিন্যাস এবং শব্দচয়ন। কোনো গুণ বা বিষয়কে মানুষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সহজবোধ্য করে তোলা, কৌতূহলজাগানিয়া চমকপ্রদ লেখনশৈলী।

 

প্রচুর প্রকাশনা সংস্থা ভিডিওনির্ভর হয়ে পড়ছে এবং লেখকের সংখ্যা কমছে? বার্তাকক্ষে লেখকদের ভবিষ্যৎ কী বলে মনে করেন?

লেখকেরা শুধুই লেখেন, এটা বললে ভুল হবে। তারা আরো অনেক কিছুই করেন। তারা লেখেন, সোস্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেন। তারা ভিডিও বানান, কন্টেন্ট ব্যবস্থাপনা এবং বিন্যস্তকরণের কাজ করেন। তাদেরকে ‘একের মধ্যে অনেক’ বলতে পারেন। তাই যতোই অন্যান্য নতুন বিষয় আসুক, আমি বিশ্বাস করি লেখকেরা শুধু লেখার কাজ ছাড়াও আরো অন্য অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।

ছবি : সংগৃহীত

আজকের দিনে নতুন করে শুরু করতে চাওয়া একজন তরুণ লেখককে কী পরামর্শ দেবেন?

সাহস নিয়ে এগিয়ে যাও। তুমি জন্মেছো লিখবে বলে এবং সবশেষে তুমি যে জিনিসটা চাও, সেটা হলো তোমার শোবার ঘরের কোনো তাকে তোমার শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো গায়ে ধুলো মাখছে। একবার যখন এগিয়ে গেছো, ঠিক করো কোন বিষয়ে লিখতে তোমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে এবং সেই ধারার অন্য লেখকরা, যারা তোমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবেন, তাদের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা নাও এবং প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো। চেষ্টা করো যাতে তুমি আজকের চেয়ে আগামীকাল ভালো লিখতে পারো।

পড়ো, পড়ো এবং আরো বেশি পড়ো কিন্তু পড়ার সময় সচেতন এবং অনুসন্ধানী থাকো। যেটা পড়লে, তার মধ্যে কোনটা তোমার ভালো লেগেছে? কোনটা ভালো লাগেনি? তুমি কীভাবে এটা আরো ভালো করে লিখতে? ক্যারিয়ারের শুরুতে কিছু ভালো অভ্যাস শুরু করো যেগুলো বহু বছর পরেও তোমাকে ফল দিয়ে যাবে।

 

আপনার প্রিয় কোনো সরঞ্জাম আছে?

হ্যাঁ, একটা কাগজের প্যাড এবং কলম। আমি জানি এটা খুবই সেকেলে শোনায় কিন্তু একটা খালি কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার কাছে বেশি চাপের মনে হয়। এর চেয়ে কাগজে-কলমে লেখা ঢের আরামদায়ক। আপনি সৃষ্টির রস আস্বাদন করতে পারছেন এবং বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারছেন। তাছাড়া, আপনি কিছুই হারিয়ে ফেলছেন না, হোক সেটা গল্পের কোনো অনবদ্য আইডিয়া, প্লট টুইস্ট বা বিক্ষিপ্ত চিন্তা যেগুলো পরে ব্যবহার করতে পারেন।

 

সমকালীন অসাধারণ লেখকদের জন্য কোনো উৎসাহজাগানিয়া বার্তা?

সবসময় আপনি যে লেখক হতে চেয়েছেন, সেই লেখক হয়ে ওঠার জন্য প্রস্তুত হোন, এটার জন্য প্রয়োজন নিরন্তর চেষ্টা, নিয়মিত অনুশীলন এবং দৃঢ়সংকল্প। শুধু লেখার জন্য লিখবেন না। সেটাই লিখুন যেটা আপনি লিখতে চান এবং সেটা এমনভাবে লিখুন, যেমনভাবে পাঠক পড়লে আপনি নিজেকে সফল মনে করবেন।

 

জার্নালিজম ডট কো ডট ইউ কে অবলম্বনে ফাল্গুন ভট্টাচার্য