সাংবাদিকদের জন্য মামলা ও আইনি ঝুঁকি এড়ানোর গাইড


সাংবাদিকদের জন্য মামলা ও আইনি ঝুঁকি এড়ানোর গাইড

ছবি : সংগৃহীত

 

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যে কতটা হুমকিতে পড়েছে, তা গত ১২ মাসে বেশ প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। মহামারির কারণে গত এক বছরে হুমকি আরও বেড়েছে। গোটা বিশ্বে, ভুয়া তথ্য মোকাবিলার নামে দমনমূলক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে চলেছেন স্বৈরশাসকেরা, অনলাইনে তথ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার বাড়তে দেখা যাচ্ছে এবং সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার ওপর দমন-পীড়নও চলছে সমানতালে। 

সাংবাদিকেরা সহিংসতা ও বিধিবহির্ভূত আটকের শিকার হয়ে চলেছেন, তাদেরকে গোপন নজরদারির লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে এবং এই প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে সংঘাত ও নির্বাচনের সময়গুলোতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের হুমকি বা হামলার জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না এবং সাংবাদিকদের ওপর সহিংস হামলার জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী বা কোনো অরাষ্ট্রীয় শক্তিকে বিচারের মুখোমুখিও হতে হয় না।

সাংবাদিকেরা এখন যেসব ভিত্তিহীন মামলার শিকার হচ্ছেন, তা আগে কখনো দেখা যায়নি। স্ল্যাপ (স্ট্র্যাটেজিক ল-স্যুটস অ্যাগেইনস্ট পাবলিক পার্টিসিপেশন) নামে পরিচিত এই মামলাগুলো সাজানো হয় সাংবাদিক বা সেই সব ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানোর জন্য, যাঁরা ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আচরণ নিয়ে সমালোচনা করেন। প্রায় ক্ষেত্রে, এসব মামলার অভিযোগগুলো হয় ভিত্তিহীন, অসার বা অতিরঞ্জিত; এগুলো দায়ের করা হয় কোনো সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মীকে চাপে ফেলার জন্য এবং এঁদের সঙ্গে কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় থাকে না। 

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য সমস্যার আরেকটি বড় উৎস হলো অনলাইনে তথ্য নিয়ন্ত্রণের রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা। অনেক দেশেই গণমাধ্যমগুলোকে কাজ করতে হয় কঠোর ও দমনমূলক পরিবেশে। তাই এসব জায়গায় ইন্টারনেট হয়ে ওঠে মুক্ত ও স্বাধীন মতপ্রকাশের শেষ জায়গা। কিন্তু এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ওপরও দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে নানান কৌশলে। বেশ কিছু দেশে শক্ত হাতে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করা হয়—কখনো ওয়েবসাইট সাময়িকভাবে ব্লক করে দিয়ে, কখনোবা ক্রমাগত ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে।

স্বাধীন সাংবাদিকতার চর্চা এখন বিশাল এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কোথাও  কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা এমন আইন প্রণয়ন করছেন, যা কথা বলার অধিকার ক্ষুণ্ন করছে; কোথাও এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে যে, সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজ চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হলে সাংবাদিকদের জানা দরকার, আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে তাঁদের জন্য কী ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। 

এই গাইডে আন্তর্জাতিক আইনি মানদণ্ড এবং সাংবাদিকদের জন্য বিদ্যমান সাধারণ হুমকিগুলো সম্পর্কে ধারণা পাবেন। সাংবাদিক হিসেবে নিত্যদিনের কাজ করতে গিয়ে কীভাবে এসব আইনি হুমকি এড়াতে বা কমাতে পারেন এবং নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন, সেসব পরামর্শও এখানে পাওয়া যাবে।  

 

মানহানি

মানহানি একটি সাধারণ আইনি পরিভাষা, যা দিয়ে বিস্তৃতভাবে বোঝানো হয়: এমন কোনো মিথ্যা বার্তা ছড়ানো, যা অন্যায্যভাবে কোনো ব্যক্তির ক্ষতি সাধন করে বা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে মানহানি বলতে বোঝানো হয়, কোনো ব্যক্তির “সুনাম ও মর্যাদার” বিরুদ্ধে “আইনবহির্ভূত আক্রমণ”। 

একেক দেশে মানহানি-সংক্রান্ত আইন একেক রকম হতে পারে। তাই, মানহানি সংক্রান্ত অভিযোগ মোকাবিলার প্রথম পদক্ষেপ হলো: সংশ্লিষ্ট দেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে জানা এবং স্থানীয় আইনি পরামর্শকদের সাহায্য নেওয়া।  

মানহানির মামলার ঝুঁকি এড়াতে বা কমাতে কী করবেন

সাংবাদিকেরা আইনি ঝুঁকি পুরোপুরি এড়াতে পারেন না, তবে মানহানির জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে নিচের পরামর্শগুলো আপনার উপকারে আসতে পারে। 

শুধু সেটুকুই বলুন, যা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন। রেকর্ড রাখুন, সম্মতি নিন, তথ্য যাচাই করুন, বিশ্বস্ত সূত্র ব্যবহার করুন। 

  • ভালো সাংবাদিকতার আদর্শ নীতিগুলো মেনে চলুন। যা প্রকাশ করছেন, সে ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ, যথার্থ ও নির্ভুল থাকার চেষ্টা করুন। সোর্স ও উদ্ধৃতি প্রকাশে সতর্ক থাকুন। যেখানে সম্ভব, সম্মতি নিয়ে সাক্ষাৎকার বা আলাপচারিতা রেকর্ড করুন। এমনভাবে কোনো বিবৃতি বা ভাষ্য দেবেন না, যা আপনার উদ্দেশ্যর বাইরে ভিন্ন পরিণতি তৈরি করবে, বা যেটি সমর্থনের মতো পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ আপনার কাছে নেই। এ ছাড়া কারও বক্তব্যের খণ্ডিত বা বাছাই করা অংশ কিংবা সারসংক্ষেপ উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখে প্রকাশ করে দেবেন না। এখানে রইল,ফোন কল ও আলাপচারিতা রেকর্ডিং এবং সাংবাদিকতার কৌশল ও নীতিমালা সম্পর্কে আরও কিছু উপকারী টিপস। 
  • আপনি কী বলছেন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। শুধু সেটুকুই বলুন, যা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন। বিভিন্ন বক্তব্যের যথার্থতা নিশ্চিত করুন এবং অস্পষ্টতা পরিহার করুন।
  • গবেষণা ও অন্যান্য নথিপত্র ভালোভাবে সংরক্ষণ করুন। আপনি যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কেলেঙ্কারি প্রকাশ করেন, তাহলে আপনাকে অবশ্যই সেই বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ হাজির করতে হবে। দেখাতে হবে যে, আপনার বক্তব্য সঠিক এবং তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বলা হয়েছে। তাইযত বেশি সম্ভব প্রমাণ সংগ্রহ করুন। 
  • তথ্য সংরক্ষণের কাজে যদি কোনো বিষয়ের অডিও বা ভিডিও করতে হয়, তাহলে সেটির লিখিত সম্মতি নিয়ে রাখা ভালো।
  • সব সময় তথ্য যাচাই করুন এবং বিশ্বস্ত সূত্র ব্যবহার করুন। কোথাও কোনো কিছু লেখা আছে বলেই তা সত্য বলে ধরে নেবেন না।
  • মনে রাখুন: মানহানিকর বার্তা পুনঃপ্রকাশ করার জন্যও আপনি মামলার শিকার হতে পারেন। ফলে কোনো অভিযোগ নতুন করে তোলার সময়ও সতর্ক থাকুন। এমনকি সম্ভাব্য কোনো মানহানিকর টুইট নির্দোষভাবে রি-টুইট করার জন্যও আপনি মামলার ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।
  • কোনো বিষয়ে যদি মতামত দিতে হয়, তাহলে স্পষ্টভাবে বলে দিন যে, এটি আপনার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন এবং এটি সরল বিশ্বাসে দেওয়া হয়েছে।
  • যদি আপনি জানেন যে আপনি যা লিখছেন তা মানহানিকর, তাহলে আগে যাচাই করে নিন, আপনার এটি সম্পর্কে রিপোর্ট করার অধিকার আছে কি না। মানহানিকর হোক বা না হোক, কিছু বিষয় নিয়ে রিপোর্টিং করার অধিকার আপনার সব সময়ই থাকে। তবে সতর্ক থাকুন; কারণ, একেক দেশের মানহানি আইন একেক রকম হতে পারে। যেমন, যুক্তরাজ্যের আইনি ব্যবস্থা বিশেষভাবে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে করা মানহানি মামলার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে।
  • মানহানির মামলাগুলো বেশ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হয়। এমনকি যদি কোনো মামলা জিতেও যান, তবু নিজেকে রক্ষার লড়াইয়ে অনেক টাকা খরচ হবে। আপনারলায়াবিলিটি কাভারেজ কেমন, তা দেখে নিন। পেশাগত ইনডেমনিটি বা লায়াবিলিটি ইনস্যুরেন্স দিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বিবেচনা করুন, বিশেষভাবে আপনি যদি ফ্রিল্যান্সার হন। 

 

সোর্সের সুরক্ষা

অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাই গোপন সূত্র বা হুইসেলব্লোয়ার ছাড়া সম্ভব হতো না। জনস্বার্থের কথা ভেবে আপনাকে তথ্য দেওয়ার জন্য এসব সোর্সরা শারীরিক, অর্থনৈতিক বা পেশাগত প্রতিশোধের শিকার হতে পারেন। সুরক্ষার জন্য, এ ধরনের সোর্সের পরিচয় গোপন রাখা জরুরি। বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকদের একটি নৈতিক দায়বদ্ধতা হলো, কোনোভাবেই গোপন সোর্সের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করা। আন্তর্জাতিকভাবে, সোর্সকে সুরক্ষা দেওয়ার একটি শক্তিশালী আইনি ঐতিহ্য রয়েছে। “ওয়াচডগ” বা “জবাবদিহিমূলক” সাংবাদিকতার চর্চায় তাঁরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, এটি তার স্বীকৃতি। সোর্সের পরিচয় প্রকাশে বাধ্য করার প্রবণতা মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলছে। এটি তথ্যের মুক্ত প্রবাহকেও বাধাগ্রস্ত করছে।  

 

গোপন সোর্সকে বিপদে ফেলার ঝুঁকি এড়াবেন/কমাবেন যেভাবে

স্বাধীন সাংবাদিকদের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা একটি মৌলিক উদ্বেগ। ডিজিটাল নজরদারির পরিবেশে গোপনীয় সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগের আদর্শ চর্চা হিসেবে কিছু নীতি সংকলন করা হয়েছে পেরুজিয়া নীতিমালায়। ডিজিটাল যুগে যেসব সাংবাদিক হুইসেলব্লোয়ারদের সঙ্গে কাজ করেন, তাঁদের জন্য এই নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এটি  আপনারও কাজে আসতে পারে। 

  • সোর্সকে নিরাপদ রাখুন। তিনি অনুরোধ করলে, তাঁর নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকুন।
  • সোর্স যাতে আপনার সঙ্গে নিজ থেকে যোগাযোগ করতে পারেন, সে জন্য নিরাপদ ব্যবস্থা রাখুন।
  • আপনার সঙ্গে নিরাপদে যোগাযোগের পদ্ধতি এমনভাবে প্রচার করুন, যাতে হুইসেলব্লোয়াররা পরিচয় লুকিয়ে এবং এনক্রিপ্টেড চ্যানেলের মাধ্যমে তথ্য দিতে পারে।
  • গোপন তথ্য ফাঁসের কারণে হুইসেলব্লোয়ারের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, তা চিহ্নিত করুন। এবং ডিজিটালি সেটি উন্মুক্ত হওয়ার পরিণতি কী হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করে বলুন।
  • নিজেই নিজের ডিজিটাল সুরক্ষা নিশ্চিত করুন এবং এনক্রিপশন ব্যবহার করুন।

 

এনক্রিপশন ব্যবহার করুন, হুইসেলব্লোয়িংয়ের ঝুঁকিকে স্বীকৃতি দিন, সোর্সদের রক্ষা করুন, আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোগুলো জানুন-বুঝুন। 

  • আপনি এবং আপনার সোর্সের জন্য সম্ভাব্য বড় হুমকিগুলো কী এবং দুজনই নিরাপদ থাকার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেগুলো খুঁজে বের করুন।
  • অনেক সময় স্টোরির স্বার্থেই ডেটাসেট প্রকাশ জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। তাই সম্ভব হলে কিংবা নিরাপদ মনে করলে প্রতিবেদনের প্রয়োজন বুঝে মূল ডকুমেন্ট ও ডেটাসেট প্রকাশ করুন।
  • সোর্স চাইলে, গোপনীয়তার স্বার্থে তাঁর দেওয়া ডেটা নিরাপদ উপায়ে মুছে ফেলুন। তবে সেটি যেন নৈতিকতা, আইন ও নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
  • ঝুঁকিপূর্ণ তথ্য এবং সোর্স বা হুইসেলব্লোয়ারের নাম পরিচয় গোপন রাখতে চাইলে ড্রপবক্স ব্যবহার করুন। এটি নিরাপত্তার দিক থেকে বেশ কার্যকর।
  • গোপন সোর্স ও হুইসেলব্লোয়ারের নিরাপত্তায় রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে জানুন।

 

নিচে থাকছে ডিজিটাল মিডিয়া ল প্রজেক্টের আরও কিছু পরামর্শ: 

  • গোপনীয়তার প্রতিশ্রুতি দিন বিচক্ষণভাবে: সোর্সকে গোপনীয়তা বজায় রাখার অঙ্গীকার করলে তা আপনি এবং সোর্স—দুজনের জন্যই সুবিধাজনক হতে পারে। কিন্তু সুবিধা ও ঝুঁকির বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করেই এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত।
  • সোর্স ও অপ্রকাশিত তথ্যের সুরক্ষার জন্য “সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট কোনো বিশেষাধিকার” প্রয়োগ করতে পারেন কি না, গবেষণা করুন: কোনো কোনো বিচারব্যবস্থায় সেসব “সাংবাদিককে” সুরক্ষা দেওয়া হয়, যাঁরা তথ্য প্রকাশের জন্য আদালতের সমন বা নির্দেশ পেয়েছেন।
  • কোথায় আপনার কাজটি প্রকাশ করবেন, তা বিবেচনা করুন: কাজটি কোথায় প্রকাশিত হবে, সেটি সংবাদ সংগ্রহের প্রক্রিয়া এবং সোর্সকে সুরক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা—দুটি ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলে।

 

যখন সাইবার অপরাধ ও হয়রানির শিকার 

সাংবাদিকেরা এখন যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন, সেগুলোর বেশির ভাগই আসছে নতুন নতুন সব প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে। এ ছাড়া আছে ডেটার অপপ্রয়োগ এবং ডিজিটাল পরিবেশে নজরদারি। সাংবাদিকেরা প্রতিনিয়ত নানা রকম ডিজিটাল হয়রানির মুখে পড়ছেন। যেমন অনলাইনে হয়রানি, অনলাইনে জোট বেঁধে মানহানিকর প্রচারণা, ফিশিং হামলা, ম্যান-ইন-দ্য-মিডল (এমআইটিএম) অ্যাটাক এবং ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনায়াল-অব-সার্ভিস (ডি-ডস) হামলা। যে সাংবাদিকেরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, তাঁদের চুপ করাতে, ভয় দেখাতে, হুমকি দিতে এবং বদনাম করতে “ট্রল বাহিনী” ব্যবহার করা হচ্ছে। দুর্বল বিচারব্যবস্থার কারণে, গণমাধ্যমের ওপর এমন সহিংসতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আইনি কাঠামো কাজ করে ধীরগতিতে এবং তাদের ভালো প্রস্তুতিও থাকে না। অথবা ক্ষমতাবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বা খোদ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছারও অভাব থাকে। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন না হওয়ায় নিম্ন আদালতে জবাবদিহি নিশ্চিত করার কাজটি খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। 

 

সাইবার অপরাধ কী?

সাইবার অপরাধের সুনির্দিষ্ট, সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে করা আগ্রাসী কর্মকাণ্ড বোঝাতে সাধারণত পরিভাষাটি ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো। এর মধ্যে অনেক ধরনের কর্মকাণ্ড থাকতে পারে। যেমন সন্ত্রাস, ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি, অবৈধভাবে কোনো কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাকিং, কন্টেন্ট-সম্পর্কিত অপরাধ, ডেটা চুরি ও কারসাজি এবং সাইবার নজরদারি।

 

সাইবার অপরাধের ধরন

  • ডেটা প্রাইভেসি লঙ্ঘন

ডেটার (এর মধ্যে বিপুল পরিমাণ আন্তসীমান্ত ডেটা চলাচলও আছে) ব্যবহার প্রতিবছর বাড়ছে; বিশেষভাবে ব্যক্তিগত ডেটা। তবে এসব ব্যক্তিগত তথ্য কীভাবে সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করা হবে, তা নিয়ে পর্যাপ্ত নিয়মনীতির অভাব রয়েছে। এর সূদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণে ডেটা সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়নও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর) অনুযায়ী, ব্যক্তিগত ডেটা লঙ্ঘন হলো “নিরাপত্তা ভঙ্গ করা, যার কারণে দুর্ঘটনাবশত বা বেআইনিভাবে (ডেটার) ধ্বংসসাধন, ক্ষতি, পরিবর্তন, অননুমোদিত প্রকাশ, প্রাপ্তি, ব্যক্তিগত তথ্য প্রেরণ, সংরক্ষণ বা অন্য কোনো উপায়ে প্রক্রিয়াকরণ হতে পারে।”

  • অনলাইনে মতপ্রকাশের অপরাধীকরণ

সাইবার অপরাধ-সংক্রান্ত বিচারব্যবস্থা সাধারণত কাজ করে অনলাইনে পোস্ট করা বিস্তৃত পরিসরের অবৈধ বা ক্ষতিকর কন্টেন্ট নিয়ে। এর মধ্যে থাকতে পারে: সন্ত্রাসী প্রোপাগান্ডা, বর্ণবাদ, ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য, যৌনতা (যেমন, শিশু পর্নোগ্রাফি), ধর্মের অবমাননা, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা এবং মেধাস্বত্বধারীর অনুমোদন ছাড়া প্রকাশিত কন্টেন্ট।

  • অনলাইন নিপীড়ন, সাইবারস্টকিং এবং সাইবারবুলিং

অনলাইন হয়রানির বেশ কিছু ধরন আছে। সাইবারস্টকিং, ডি-ডস অ্যাটাক থেকে শুরু করে ডক্সিং এবং অনলাইনে যৌন হয়রানি পর্যন্ত, অনেক কিছু্ই এর আওতায় পড়ে। সাইবারস্টকিংয়ে অনলাইন থেকে কারও ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে টেক্সট মেসেজ, ফোন কল বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। এতে মানুষের অনলাইন অধিকারগুলো সংকুচিত হয়ে যায় ভীষণভাবে। গবেষণা থেকে দেখা গেছে: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনলাইনে হয়রানি করা হয় কারও ব্যক্তিগত বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের জায়গা থেকে। পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিরা এর শিকার হন বেশি। এঁদের মধ্যে যৌন সংখ্যালঘু এবং নারীরাও আছেন। পুরুষদের তুলনায় তাঁরাই অনলাইনে বেশি যৌন হয়রানি ও হামলার শিকার হন। হয়রানির আরেকটি প্রবণতাকে ডাকা হয় সাইবারবুলিং নামে। এখানেও, ভুক্তভোগীদের কাছে  বিদ্বেষপূর্ণ, ভীতিকর বা হুমকিমূলক বার্তা পাঠানো হয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে।  

 

সাইবার অপরাধের ঝুঁকি এড়াতে/কমাতে কী করবেন

নারী সাংবাদিকেরা যেন অনলাইনে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারেন, সে জন্য কিছু বাস্তবধর্মী পরামর্শ দিয়েছে মিডিয়া ডিফেন্স:

  • পরিকল্পিত ট্রল হামলা এড়াতে কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় কী ধরনের হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছেন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
  • সোশ্যাল মিডিয়ায় কখনো লাইভ লোকেশন ডেটা শেয়ার করবেন না। রিপোর্টিংয়ের কাজ শেষ হওয়ার পর, বা সেই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বলা নিরাপদ যে, আপনি কোথায় ছিলেন।
  • কোনো হুমকি গায়ের ওপর চলে এলে, সেটি আপনার সহকর্মী, সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা দলের সঙ্গে শেয়ার করুন। আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে আলাপ করুন।
  • এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আপনার ওপর যে মানসিক প্রভাব পড়ছে, সেটি প্রকাশেরও জায়গা তৈরি করুন। বন্ধু, সহকর্মী বা পেশাদার কারও সঙ্গে কথা বলুন, যিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।
  • যে প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে হুমকি বা হামলাটি এসেছে, সেখানে রিপোর্ট করার কথা বিবেচনা করুন, বিশেষ করে যদি তা প্ল্যাটফর্মটির শর্ত ও নিয়ম ভঙ্গ করে।
  • অনলাইন হয়রানির বিষয়ে কর্মীদের সচেতন করতে একটি প্রটোকল তৈরির জন্য আপনার সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে উদ্যোগ নিতে বলুন।
  • আরও তথ্যের জন্য দেখুনআইডব্লিউএমএফ ও ট্রোলবাস্টারের রিসোর্স। 

 

অনুমতি ছাড়া কারও অন্তরঙ্গ কোনো ছবি অনলাইনে পোস্ট করা হলে, এই পদক্ষেপগুলো নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে মিডিয়া ডিফেন্স

  • অপরাধটির যেন একটি স্থায়ী প্রমাণ থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্য অনলাইনে পোস্ট করা কন্টেন্টটির রেকর্ড (ও কপি) রাখুন। এখানে থাকবে: কোন দিন কন্টেন্টটি পোস্ট করা হয়েছে, কোথায় পোস্ট করা হয়েছে এবং কে এটি পোস্ট করেছে। স্ক্রিনশট নেওয়া এই কাজের জন্য একটি উপকারী পন্থা হতে পারে।
  • মনোসামাজিক ও আইনি সহায়তা নিন।
  • পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করুন। এমনকি আপনার দেশে যদি বিনা অনুমতিতে এ ধরনের অন্তরঙ্গ ছবি ছড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট আইনি ধারা না-ও থাকে, তবু এ ধরনের অপরাধের জন্য বিদ্যমান ফৌজদারি আইনেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
  • যে প্ল্যাটফর্মে কন্টেন্টটি পোস্ট করা হয়েছে, সেখানেরিপোর্ট করুন। প্ল্যাটফর্মে রিপোর্ট করার সময় পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগের কপিটি সংযুক্ত করা কাজের হতে পারে।

 

স্পাইওয়্যার ও ডিজিটাল নজরদারি

সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ বাড়ছে। বিভিন্ন ম্যালওয়্যার, স্পাইওয়্যার (যেমনটি সম্প্রতি দেখা গেছে পেগাসাস কেলেঙ্কারির মাধ্যমে), ফেশিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার, এবং সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিংয়ের মতো অন্যান্য টুল দিয়ে এই নজরদারি করা হয়। এর উদ্দেশ্য মূলত ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের চুপ করিয়ে দেওয়া। নজরদারির শিকার হওয়ার যে ভীতি, তা মুক্ত মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে এবং এর অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় সেলফ-সেন্সরশিপ। এনক্রিপশন ও গোপনীয়তার সুবিধা থাকা প্রাইভেসি টুল ব্যবহার করে সাংবাদিকেরা সেন্সরশিপের বাধা কিছুটা এড়াতে পারেন। এনক্রিপশন ও অ্যানোনিমিটির মতো প্রাইভেসি টুলগুলো বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন দেশ এবং সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে সুরক্ষিত উপায়ে এবং অবাধে সাংবাদিকতা করার ক্ষমতাও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কারণ, এই টুলগুলো সাংবাদিকদের সেন্সরশিপ ও নজরদারি এড়িয়ে তথ্য পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। 

নজরদারির ঝুঁকি এড়াতে/কমাতে কী করবেন

নজরদারির বিরুদ্ধে সুরক্ষা

নজরদারিমূলক শাসনব্যবস্থায় থাকা ব্যক্তিদের ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনালের ১০টি সর্ব স্বীকৃত নীতিমালা আছে। তার একটি সারাংশ তৈরি করেছে মিডিয়া ডিফেন্স। এই নীতিমালা থেকে একটি কাঠামো পাওয়া যায়, যা মৌলিক অধিকারের সুরক্ষায় কাজে আসে। আদর্শ পরিস্থিতিতে, এটির কাজ করার কথা স্থানীয় বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জোট বেঁধে, যেন ডিজিটাল বাধাগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা যায়। এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত রেফারেন্স হলো আর্টিকেল ১৯-এর এই প্রতিবেদন: “গ্লোবাল প্রিন্সিপালস অন প্রোটেকশন অব ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন অ্যান্ড প্রাইভেসি”।

 

ডিজিটাল নিরাপত্তাসংক্রান্ত সাধারণ কিছু পরামর্শ

যে সাংবাদিকেরা বেশি নজরদারির ঝুঁকিতে থাকেন, তাঁদের উচিত আদর্শ কিছু চর্চা অনুসরণ করা এবং সাধারণ কিছু তথ্য নিরাপত্তার প্রটোকল তৈরি করা, যেগুলো তাঁকে ব্যক্তিগত যোগাযোগে অবৈধ অনুপ্রবেশ থেকে সুরক্ষা দেবে। 

  • অনলাইনে নিজের ইচ্ছায় আপনি যেসব তথ্য শেয়ার করছেন, সেগুলোর ব্যাপারে আরও চিন্তাশীল হোন এবং যাচাই-বাছাই করুন। আপনার নিজস্ব লগইন, পাসওয়ার্ড ও কন্ট্যাক্ট-সংক্রান্ত তথ্য সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করুন। অসুরক্ষিত পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
  • অপরিচিত বা অনিরাপদ ওয়েবসাইটে ভিজিট করবেন না। বিশেষভাবে সেসব সাইটে, যেখানে সুরক্ষিত “https://” প্রটোকল ব্যবহার করা হয় না। (ব্রাউজারের ওয়েব অ্যাডড্রেস বারে তালার চিহ্ন খেয়াল করুন।)
  • যতটা সম্ভব, এনক্রিপ্টেড চ্যানেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করুন। যেমন সিগন্যাল বা টেলিগ্রাম।
  • ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর জন্য শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। একই পাসওয়ার্ড একটির বেশি অ্যাকাউন্টের জন্য ব্যবহার করবেন না। মাঝেমধ্যেই পাসওয়ার্ড হালনাগাদ করুন।
  • যখনই সম্ভব, আপনার ডিভাইসটি সুরক্ষিত রাখুন এবং লোকেশন সার্ভিস বন্ধ করে দিন।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) কয়েকটি বাড়তি পরামর্শ দিয়েছে: 

  • আপনার ডিভাইস, অ্যাপ ও ব্রাউজার নিয়মিত হালনাগাদ করুন।
  • ফিশিং বা স্পুফিং অ্যাটাকের বিষয়ে সতর্ক থাকুন। এ ক্ষেত্রে এমনভাবে বার্তা পাঠানো হয়, যা দেখে মনে হবে এটি কোনো বিশ্বস্ত সূত্রের কাছ থেকে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে আপনাকে ফাঁদে ফেলা হচ্ছে কোনো লিংকে ক্লিক করানোর জন্য, যেখানে ক্লিক করলে একটি ম্যালওয়্যার ইনস্টল হয়ে যাবে। এগুলো সাধারণত পাঠানো হয় হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপ, সোশ্যাল মিডিয়া মেসেজ, ইমেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে। এসব সংযুক্ত লিংকে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন। তার বদলে সেই তথ্যটি যাচাই করে নিন সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে, বা এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলে নিন বার্তা পাঠানো ব্যক্তিটির সঙ্গে।
  • নিউজরুমের আইটি দলের উচিত ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা বাড়ানো, যেন ডি-ডস হামলা থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। তাঁরা একই সঙ্গে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ফায়ারওয়াল ও বাড়তি সার্ভার সক্ষমতাও নিশ্চিত করতে পারেন।
  • আপনার ফোন, ল্যাপটপ বা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে কী ধরনের তথ্য আছে, তা পর্যালোচনা করুন। সবকিছুর ব্যাকআপ নিন। তারপর সেসব ছবি, ভিডিও, ডকুমেন্ট বা জিনিস মুছে দিন, যেগুলোতে আপনার, আপনার পরিবার ও সোর্স সম্পর্কে ব্যক্তিগত তথ্য আছে।
  • সেলফোন আনলক করার জন্য টাচ আইডি বা ফেশিয়াল রিকগনিশনের মতো বায়োমেট্রিক ডেটা ব্যবহার করবেন কি না, তা সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করুন। কারণ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এসব ডেটায় অবৈধভাবে প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
  • অ্যাকাউন্ট থেকে লগ আউট করুন এবং আপনার ব্রাউজিং ইতিহাস ডিলিট করুন।
  • বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে নিজের নাম লিখে সার্চ করুন। পাবলিক ডোমেইনে প্রকাশ করতে চান না, এমন কিছু খুঁজে পেলে ডিলিট করে দিন।
  • অ্যাকাউন্টগুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করে দেখুন যে, সেখানে ট্রলিং কর্মকাণ্ড বাড়ার কোনো লক্ষণ আছে কি না
  • অনলাইন হয়রানির প্রভাব এবং ঝুঁকি নিয়ে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলুন। অনলাইনে হয়রানিকারীরা প্রায়ই সাংবাদিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে, তাঁদের আত্মীয় ও বন্ধু মহলের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে।
  • ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীরা আপনার অনলাইন কর্মকাণ্ড ট্র্যাক করছে—এমন সংশয় থাকলে ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করুন, বিশেষ করে যখন আপনি সংবেদনশীল কোনো বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। ভিপিএন সেবাগুলোও আপনার ইন্টারনেট কর্মকাণ্ড রেকর্ড করতে পারে। ফলে কোন ভিপিএন সেবা ব্যবহার আপনার জন্য ভালো হবে, তা ভালোমতো দেখে নিন।

 

সাজানো বা মিথ্যা অভিযোগে আটক/গ্রেপ্তারের ঝুঁকি

সাংবাদিকদের মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে, অবৈধ কর্মকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত করা হতে পারে। কাউকে অপরাধীও বানানো হতে পারে। ওএসসিই সেফটি অব জার্নালিস্ট গাইডবুকের মতে, এই কৌশল ব্যবহার করা হয় জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট রিপোর্টিংকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য। বিশেষভাবে সেই রিপোর্টিং যদি রাষ্ট্র, জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, বা কোনো প্রভাবশালী সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীকে নিয়ে হয়। কিছু সাংবাদিককে বেআইনিভাবে কারারুদ্ধ করা হয় সাজানো ও মিথ্যা অভিযোগে। আরও অনেক সাংবাদিককে আটক রাখা হয়। কখনো কখনো তাঁদের লম্বা সময়ের জন্য আটক রাখা হয় কোনো অভিযোগ গঠন করা ছাড়াই।

 

মিথ্যা অভিযোগ বা গ্রেপ্তারের ঝুঁকি এড়াতে/কমাতে কী করবেন

সাজানো অভিযোগে অবৈধভাবে আটক বা অভিযুক্ত হওয়ার ধারণাটি চলমান একটি বিষয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটির স্বরূপ, সক্ষমতা, দুর্বলতা ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়। এর অর্থ, আপনাকে নির্দিষ্ট সময় পরপরই ঝুঁকি যাচাই করতে হবে, বিশেষভাবে যদি আপনার কাজের পরিবেশ বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। এই ঝুঁকি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সাংবাদিকদের নিচের পরামর্শগুলো দিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস

  • দুর্বলতাজনিত/ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো কমিয়ে ফেলুন। আপনার অবস্থান, কাছে ফোন না থাকা ইত্যাদি ঝুঁকির বিষয় হতে পারে। পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক বা কাজ ভাগ করে নেওয়ার মতো সুযোগ না থাকাও ‍দুর্বলতা বা ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
  • সুরক্ষা সক্ষমতা বাড়ান। যুক্তিযুক্ত পর্যায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কোনো গ্রুপ বা ব্যক্তির কাছে কী পরিমাণ শক্তিমত্তা ও রিসোর্স আছে, সেটিই বিবেচিত হবে সক্ষমতা হিসেবে। নিরাপত্তা বা আইনি ইস্যুতে প্রশিক্ষণ, কোনো গ্রুপের একসঙ্গে কাজ করা, ফোন ও নিরাপদ যাতায়াতের নিশ্চয়তা, সমর্থনকারীদের একটি শক্ত নেটওয়ার্ক, হুমকি মোকাবিলার জন্য একটি যথার্থ স্ট্র্যাটেজি/পরিকল্পনা ইত্যাদি হতে পারে সক্ষমতার উদাহরণ।

 

আরও কিছু পরামর্শ পাওয়া যায় সিমো সেফটি নেট ম্যানুয়ালে

  • কখনো হুমকি পেলে, হয়তো সবার কাছে  সেটি প্রমাণ করতে পারবেন না। তবু ব্যাপারটি সাংবাদিক মহলে জানিয়ে রাখুন। 
  • ভয় দেখানো বা হয়রানির প্রমাণ (এসএমএস বা ইমেইল, কোনো নথি, অডিও বা ভিডিও ক্লিপ) একটি নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করুন এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে শেয়ার করুন।
  • সরাসরি চাপ প্রয়োগ করা বা প্রমাণ করা সম্ভব—এমন কোনো বিপদের কথা সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিকদের সংগঠন এবং জনগণকে জানান।
  • সাংবাদিক বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর প্রতিটি হুমকি ও শারীরিক আক্রমণের কথা পুলিশে রিপোর্ট করা উচিত এবং সে বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া উচিত।
  • এ ধরনের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সংহতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি গুরুতর হুমকি বা শারীরিক আক্রমণের কথা প্রচারিত হওয়া উচিত আন্তর্জাতিকভাবে।

যে রিপোর্টাররা গ্রেপ্তার ও আটকের ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের জন্য একটি ফিজিক্যাল অ্যান্ড ডিজিটাল সেফটি কিটও তৈরি করেছে সিপিজে। 

 

ডিজিটাল নিরাপত্তাসংক্রান্ত পরামর্শ

  • আটক বা গ্রেপ্তারের মতো পরিস্থিতির মধ্যে পড়লে, আগেভাগেই আপনার ডিভাইস ও ডেটা সুরক্ষিত করার জন্য পদক্ষেপ নিন। এতে আপনার বা আপনার সোর্সের তথ্য অন্য কারও হাতে পড়ার আশঙ্কা কমবে। আপনার ডিভাইসের কোথায় কোন ডেটা, নথি ও ছবি রাখা আছে, তা মাথায় রাখুন।
  • ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, এমন ডেটা মুছে দিন। এটিও মাথায় রাখুন যে, সরকারি কর্তৃপক্ষ বা অপরাধী গোষ্ঠী আধুনিক অনেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব মুছে দেওয়া তথ্যও ফিরিয়ে আনতে পারে। ফলে নিয়মিত আপনার ব্রাউজিং হিস্টরি মুছে ফেলুন, এবং সব অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত লগআউট করুন।
  • সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোতে মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিন। সব কটি অ্যাকাউন্টে (বিশেষ করে ইমেইল ও সোশ্যাল মিডিয়া) কী কী কন্টেন্ট আছে, সেগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করুন। জেনে নিন: কোন ধরনের তথ্য প্রকাশ করলে আপনি বা অন্যরা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।

 

শারীরিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত পরামর্শ

  • আপনি যে জায়গা থেকে রিপোর্টিং করছেন, সেখানে সাংবাদিক হিসেবে আপনার কী কী আইনগত অধিকার আছে, তা ভালোমতো বুঝে নিন, গবেষণা করুন। খুঁজে দেখুন যে: কোন জিনিসের জন্য আপনি গ্রেপ্তার হতে পারেন বা পারেন না; এর আগে যে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছে; কোন সরকারি বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারে; গ্রেপ্তারের পর আপনাকে কোথায় নেওয়া হতে পারে; এবং আপনি আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাবেন কি না।

 

আটক/গ্রেপ্তার হলে

  • গ্রেপ্তারের আগে পুলিশ কর্মকর্তাকে অবশ্যই জানাতে হবে যে, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং কী কারণে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কোন জায়গা, সময় ও পরিস্থিতিতে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে; তা ভালোমতো খেয়াল করুন।
  • গ্রেপ্তারের মুহূর্তে ছবি তোলা বা ভিডিও করতে যাবেন না। কারণ, এতে পুলিশ উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে এবং আপনার সরঞ্জামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বা জব্দ করে নিতে পারে। এমনকি আপনি শারীরিক ক্ষতির মুখেও পড়তে পারেন।
  • গ্রেপ্তারের সঙ্গে যে পুলিশ কর্মকর্তারা জড়িত, তাঁদের সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করুন। যেমন: তাঁদের নাম, ব্যাজ বা ইউনিট নম্বর, বিভাগ ও অন্যান্য শনাক্ত করার মতো বৈশিষ্ট্য।
  • গ্রেপ্তারের সময় আশপাশে লোকজন থাকলে খেয়াল করুন। দেখুন, পরবর্তীকালে কাউকে সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না।
  • পুলিশ কর্মকর্তা যদি আপনাকে আঘাতের চেষ্টা করে, তাহলে সেটির রেকর্ড রাখুন। মনে রাখুন, কী ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে, হাসপাতালে যেতে হয়েছে কি না ইত্যাদি বিষয়ও। এই কাজে যারা জড়িত, তাদের নাম এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যও টুকে রাখার চেষ্টা করুন।

 

ভুয়া খবর ও প্রপাগান্ডা

“প্রপাগান্ডা,” “মিসইনফরমেশন,” ও “ফেক নিউজ”; পরিভাষাগুলো দিয়ে প্রায়ই সমজাতীয় অর্থ প্রকাশ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, তথ্য শেয়ারের মাধ্যমে ক্ষতিসাধন করা। কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে, কখনো অনিচ্ছাকৃত। সাধারণত এটি করা হয় কোনো নির্দিষ্ট নৈতিক/রাজনৈতিক মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের জন্য। 

এই ধরনের তৎপরতার তিনটি স্বতন্ত্র ব্যবহার শনাক্ত করেছে কাউন্সিল অব ইউরোপ:

মিস-ইনফরমেশন: মিথ্যা বা ভুল তথ্য, যেটি না জেনে বা অনিচ্ছায় তৈরি ও প্রচার করা হয়। 

ডিস-ইনফরমেশন: জনমত প্রভাবিত করা বা সত্যকে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে তোলার লক্ষ্যে যেসব মিথ্যা তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি ও প্রচার করা হয়। 

ম্যাল-ইনফরমেশন: যেসব সত্য তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে শেয়ার করা হয় ক্ষতিসাধনের লক্ষ্যে। 

মিথ্যা সংবাদ ও প্রপাগান্ডার আরও কিছু সাধারণ উপাদান শনাক্ত করেছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট

  • বিভ্রান্তি তৈরি:কন্টেন্ট তৈরি করা হয় মিথ্যা, ধোঁকা বা বিভ্রান্তিকর (ডিস-ইনফরমেশন) হিসেবে, অথবা কন্টেন্টে অনৈতিকভাবে সহমত তৈরির কৌশল (প্রপাগান্ডা) ব্যবহার করা হয়েছে।  
  • উদ্দেশ্য:কন্টেন্টের উদ্দেশ্য থাকে অনিরাপত্তা তৈরি করা, সংহতি ভেঙে ফেলা, শত্রুতা উসকে দেওয়া বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরাসরি বিঘ্ন ঘটানো।  
  • জনস্বার্থ:কন্টেন্ট হয় জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে। 
  • ছড়িয়ে দেওয়া:কন্টেন্ট বেশি ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রায়ই স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেড) নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

 

সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিস-ইনফরমেশন/প্রপাগান্ডা

তথাকথিত ভুয়া খবর বা ফেক নিউজ নতুন বিষয় নয়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার মতো আধুনিক তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে ভুয়া তথ্য এখন অনেক দ্রুত ছড়ায়। তাই বিষয়টি নতুনভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনলাইনে কোনো টেক্সট, ছবি, ভিডিও বা লিংক কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভাইরাল হয়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে এটি অনেক নিরাপত্তা-উদ্বেগও সামনে আনে। অবশ্য এত কিছুর পরও, সোশ্যাল মিডিয়া এবং নাগরিক সাংবাদিকদের সংগ্রহ করা কন্টেন্ট ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ সোর্স হয়ে উঠছে সংঘাত বা বিক্ষোভ নিয়ে রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে। 

 

মিস/ডিস-ইনফরমেশনের ঝুঁকি এড়াতে/কমাতে কী করবেন

ভুয়া তথ্য মোকাবিলার জন্য এই পদক্ষেপগুলো নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে পেন আমেরিকা

  • কোনো কন্টেন্টই যথার্থ, সঠিক বলে ধরে নেবেন না; সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাওয়া প্রতিটি কন্টেন্টই সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করুন। কীভাবে কাজটি করবেন, সে ব্যাপারে আরও তথ্য পেতে, দেখুন জিআইজেএন-এর এইঅ্যাডভান্সড গাইড, এবং ভিডিও যাচাইয়ের জন্য ফার্স্ট ড্রাফট-এর পকেট গাইড। 
  • বিভিন্ন অনলাইন অ্যাকাউন্ট বা বিক্ষোভ সংশ্লিষ্ট ইমেইল থেকে আসা যেকোনো তথ্য সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করুন।
  • সেসব ভুয়া সংবাদের সাইট সম্পর্কে সচেতন থাকুন, যেগুলো প্রায়ই নির্ভরযোগ্য সংবাদসূত্রগুলোকে নকল করে। এটি বিশেষভাবে দেখা যায় স্থানীয় সংবাদের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে সাহায্যের জন্য দেখুন পয়েন্টারেরপলিটিফ্যাক্টনিউজগার্ডের ট্র্যাকিং সেন্টার বা ফ্যাক্টচেক ডট অর্গ

 

আর ইউনেসকো পরামর্শ দেয় নিচের চেকলিস্টটি অনুসরণের: 

    • লেখক/রিপোর্টার, তাঁদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ইত্যাদি খেয়াল করুন:কন্টেন্টটি কে বানিয়েছেন? সেই সাংবাদিক সম্পর্কে কী তথ্য পাওয়া যায়? তাঁর বিশেষ কী দক্ষতা আছে এবং আগে তিনি কোন ধরনের প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করেছেন? 
    • কী ধরনের কাজ, তা শনাক্ত করুন:কন্টেন্টটি কী ধরনের? এটি কী মতামত, বিশ্লেষণ, নাকি বিজ্ঞাপনদাতার (স্পন্সরড/“ন্যাটিভ”) কাছ থেকে এসেছে? বিভিন্ন লেবেল দেখে এটি শনাক্ত করুন।
    • সাইটেশন ও রেফারেন্সে মনোযোগ দিন:অনুসন্ধানী বা ইন-ডেপথ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে দেখুন যে, এসব তথ্য ও দাবির পেছনে থাকা সোর্সদের কীভাবে পাওয়া গেছে।  
  • স্থানীয় কমিউনিটি বা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করুন।
  • বৈচিত্র্য শনাক্ত করুন:বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা ‍দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিউজরুমের চেষ্টা ও অঙ্গীকার কেমন ছিল?

 

স্যাটায়ার

মতপ্রকাশ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ধারায় স্যাটায়ারকে সুস্পষ্টভাবে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে ভেরাইনিগুং বিলডেন্ডার কুন্সটলার (শিল্পীদের সমিতি) বনাম অস্ট্রিয়া মামলায়, মানবাধিকার-সংক্রান্ত ইউরোপিয়ান আদালতে স্যাটায়ারকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে: এটি “শৈল্পিক অভিব্যক্তি এবং সামাজিক ভাষ্যের একটি ধরন এবং তার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তবতাকে অতিরঞ্জিত এবং বিকৃত করা, স্বাভাবিকভাবেই এর লক্ষ্য হলো (পাঠককে) উদ্দীপিত এবং উত্তেজিত করা। তাই, একজন শিল্পীর এই ধরনের অভিব্যক্তির অধিকারে কোনো হস্তক্ষেপ অবশ্যই বিশেষ যত্ন নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”

তা সত্ত্বেও, স্যাটায়ার প্রায়ই আইনি আক্রমণের শিকার হয়। এগুলো প্রধানত লুকিয়ে থাকে মানহানি বা মেধাস্বত্ব আইনের আড়ালে। স্যাটায়ার ও মানহানি করার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো: মানুষ বিশ্বাস করবে—এমন কোনো চিন্তা স্যাটায়ারের থাকে না। স্যাটায়ার হলো ব্যঙ্গাত্মক, সমালোচনামূলক এবং এগুলো তৈরিই করা হয় আক্রমণের উদ্দেশ্যে। 

স্যাটায়ারের আইনি ঝুঁকি এড়াতে/কমাতে কী করণীয়

স্যাটায়ার করতে গিয়ে মানহানির মামলা এড়ানোর জন্য নিচের পরামর্শগুলো দিয়ে থাকে রিপোর্টার্স কমিটি ফর ফ্রিডম অব দ্য প্রেস। 

  • হালকা ধাঁচের টোন ব্যবহার করুন, যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাবে যে, আপনার প্রতিবেদনটি সাধারণ সংবাদ (স্ট্রেট নিউজ) নয়।
  • কোন প্রকাশনায় প্রতিবেদনটি প্রকাশের জন্য দিচ্ছেন, সেটি বিবেচনা করুন। দেখুন যে, প্রকাশনাটির এমন স্যাটায়ার বা প্যারোডি প্রকাশের ইতিহাস আছে কি না।
  • কী ধরনের প্রকাশনা বা সম্প্রচার মাধ্যমে এটি প্রচারিত হবে, তা বিবেচনা করুন। এটি কি কোনো মুদ্রিত ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, ব্লগ, টিভি, রেডিও নাকি ম্যাগাজিন? প্রকাশনাটির কোন জায়গায় এটি প্রকাশিত হচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতটিও চিন্তা করুন। এটি কি বই সমালোচনা অংশের পেছনে প্রকাশিত হচ্ছে, নাকি সম্পাদকীয় বা সংবাদের পাতায়, নাকি কোনো রম্য ওয়েবসাইট বা সম্প্রচার মাধ্যমে? এবং প্রধানত কোন জায়গার মানুষ কন্টেন্টটির পাঠক, তা বিবেচনা করুন।
  • এমন একটি অপ্রচলিত শিরোনাম ব্যবহার করুন, যা শুরুতেই পাঠককে সতর্ক করে দেবে এই বলে যে, এটি সাধারণ কোনো সংবাদ নয়।
  • স্টোরিতে অবিশ্বাস্য বা নাটকীয় সব উপাদান ব্যবহার করুন। বিশেষজ্ঞ বা কোনো গোষ্ঠীর নাম দিন কিম্ভুতভাবে, বা খেলো একটি সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়ে। এমন বক্তব্য উদ্ধৃত করুন যা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয় বা অযৌক্তিক। এই সবকিছু থেকে বোঝা যাবে: এটি সত্যিকারের কোনো কিছুর কথা বলছে না।  
  • সত্যিকারের মানুষদের নাম ব্যবহারের পরিবর্তে, তাঁদের নামের সঙ্গে মেলে—এমন কাছাকাছি ধরনের অন্য কাল্পনিক নাম ব্যবহার করুন।
  • স্যাটায়ারটির মাধ্যমে সত্যি যে ঘটনার দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, তা স্টোরিতে উল্লেখ করে দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন। সত্যিকারের কোনো ঘটনার স্মৃতি মানুষের মাথায় সজীব থাকতে থাকতেই যদি প্যারোডি প্রকাশিত হয়, তাহলে একটি ধারণা পাওয়া যায় যে, স্টোরিটি কোনো সত্যিকার ঘটনার কথা বলছে।
  • ডিসক্লেইমারের ব্যবহার সাহায্য করতে পারে। কিন্তু শুধু এটির মাধ্যমে আপনি দায়বদ্ধতা এড়াতে পারবেন না; বিশেষ করে যদি বিশ্বাসযোগ্যভাবে লেখা কোনো স্যাটায়ারধর্মী স্টোরির নিচে ছোট অক্ষরে সেই ডিসক্লেইমার লেখা থাকে।

 

কপিরাইট ইস্যু

কপিরাইট একধরনের মেধাস্বত্ব আইন, যেটি মার্কিন কপিরাইট অফিস অনুযায়ী “সাহিত্য, নাটক, সংগীত এবং কবিতা, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, গান, কম্পিউটার সফটওয়্যার ও স্থাপত্যকলার মতো মূল শৈল্পিক কাজগুলোকে” সুরক্ষা দেয়। কপিরাইট কোনো তথ্য, ধারণা, ব্যবস্থা বা কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনার পদ্ধতিকে সুরক্ষা দেয় না। যদিও যেভাবে এসব বিষয় প্রকাশ করা হয়, সেগুলো কপিরাইট সুরক্ষা পেতে পারে।  

“ফেয়ার ইউজ” একটি পরিভাষা যা দিয়ে কপিরাইট করা কন্টেন্ট ব্যবহারের সক্ষমতা বোঝানো হয়, যেগুলো ব্যবহারের জন্য অনুমতি নেওয়া বা মূল্য পরিশোধের প্রয়োজন পড়ে না; বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে এসব কন্টেন্ট ব্যবহারের সাংস্কৃতিক বা সামাজিক সুবিধা এর মূল্যকে ছাপিয়ে যায়। এটি একটি সাধারণ অধিকার। আইন যেখানে কোনো নির্দিষ্ট ধরনের ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্ট অনুমোদন দেয়নি, এমন ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ করা যায়।  স্বাধীন মতপ্রকাশের অতি পরিচিত অধিকারের মতো, কোনো আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি বা নিবন্ধন ছাড়াই মানুষ এই অধিকার ব্যবহার করে।

কপিরাইট লঙ্ঘনের ঝুঁকি এড়াতে/কমাতে কী করবেন

কপিরাইট-সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি কমানোর জন্য কয়েকটি মৌলিক বিষয় খেয়াল করার পরামর্শ দিয়েছে আ জার্নালিস্ট’স গাইড টু কপিরাইট ল অ্যান্ড আইউইটনেস মিডিয়া

    • কন্টেন্টটি কে তৈরি করেছে, যাচাই করুন—কোনো কন্টেন্টের মেধাস্বত্ব তাঁর কাছে থাকে, যিনি পাবলিশ বাটনটি চাপ দেন।
    • স্পষ্ট, সহজ ভাষায় কন্টেন্ট ব্যবহারেরঅনুমতি চান এবং ব্যাখ্যা করুন যে কোথায় ও কীভাবে কন্টেন্টটি ব্যবহৃত হবে।  
    • মেধাস্বত্ব-সংশ্লিষ্ট স্থানীয় আইনকানুনগুলো দেখে নিন। কপিরাইটের ফেয়ার ইউজের ব্যাখ্যা একেক দেশে একেক রকম।
    • ক্রেডিট বা অ্যাট্রিবিউশন ছাড়া কোনো কন্টেন্ট বা ছবি ব্যবহার করবেন না।পাশাপাশি এটিও মাথায় রাখুন যে, সম্মতি ছাড়া কারও নাম প্রকাশ করার নৈতিক ও প্রাইভেসি-সংশ্লিষ্ট আইনি পরিণতি কী হতে পারে। 
  • সোর্স ও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা সব সময় যাচাই করুন।
  • অন্যের কপিরাইট করা নথিপত্র বা ছবি পুরোপুরি পুনঃপ্রকাশ করবেন না।ইন্টারনেটে পাওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্রও বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যায় না। এবং এগুলোও কপিরাইট আইন দিয়ে সুরক্ষিত থাকে। যদি না সেই কন্টেন্টটি অনেক পুরোনো হয় বা ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের আওতায় থাকে। কমেন্ট, ক্রিটিক, স্যাটায়ার বা অন্যান্য ফেয়ার ইউজ নীতির আওতায় কোনো কন্টেন্ট ব্যবহারের পক্ষে আপনার শক্ত যুক্তি থাকলেও কোনো পেশাদার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়াই আদর্শ চর্চা। কখনোই অন্যের ওপর ভরসা করবেন না, “ফেয়ার ইউজের” দ্বিধাযুক্ত ব্যবহারের উদাহরণ দেবেন না, বা তথাকথিত স্ট্রিট নলেজের ওপর ভরসা করবেন না। 

গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া

গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া এখন একটি বৈশ্বিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকেরা ক্রমাগত নানা ধরনের দমনমূলক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, যেগুলো বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করছে। বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। 

গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমাতে/এড়াতে কী করবেন

  • রাষ্ট্রীয় নজরদারির ঝুঁকি কমানোর জন্য ডিজিটাল সুরক্ষা-সংক্রান্ত নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলুন।
  • স্থানীয় পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ-সংক্রান্ত আইনগুলো দেখে নিন।
  • সংবেদনশীল কন্টেন্টগুলো লুকিয়ে রাখুন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এমন কন্টেন্ট শেয়ার করুন, যেগুলো সেন্সর হওয়ার আশঙ্কা কম।
  • দমনমূলক পরিবেশে হুমকির মুখে পড়লে, যদি সম্ভব হয়,দেশের বাইরে থেকে কাজ করুন।

ডিসক্লেইমার: এই লেখার তথ্যগুলো কোনোভাবেই আইনি পরামর্শ নয়। এগুলো আইনি পরামর্শ হিসেবে ধরে নেওয়াও ঠিক হবে না। তথ্যগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে শুধু দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য।  

মিডিয়া ডিফেন্স বিশ্বের একমাত্র আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, যারা  কাজ করে রিপোর্টিংয়ের জন্য বিশ্বজুড়ে হুমকির মুখে থাকা সাংবাদিক, নাগরিক সাংবাদিক ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য আইনি সহায়তা নিয়ে। এখন পর্যন্ত, মিডিয়া ডিফেন্স থেকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে ৯০০টি কেসে। সহায়তা পেয়েছেন ১১০টিরও বেশি দেশের শত শত সাংবাদিক। তাদের কাজের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা এড়াতে পেরেছেন ২৯০ বছরের সাজা, ৬৪৬ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ। এবং মিডিয়া ডিফেন্স প্রশিক্ষণ দিয়েছে ৯০ জনেরও বেশি আইনজীবীকে। 

জিআইজেএন-এর জন্য গাইডটি সম্পাদনা করেছেন নিকোলিয়া আপোস্টোলু ও রিড রিচার্ডসন। উপরের ইলাস্ট্রেশনটি করেছেন মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট জুনার (জুলিকিফ্লে আনোয়ার উলাক)। লেখাটি বিজেসি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।