প্রতিবেদনের শুরুতেই পাঠককে বেঁধে ফেলার উপায়


প্রতিবেদনের শুরুতেই পাঠককে বেঁধে ফেলার উপায়

ছবি : সংগৃহীত

ভালো একটা শুরু, যে কোনো লেখকের জন্য বেশ কঠিন। রিপোর্টারদের জন্য অবশ্য সহজ একটি পথ আছে: “নতুন” কিছু দিয়ে প্রতিবেদন শুরু করা, এবং সেখানে একটি ক্রিয়াপদ রাখা। যেমন: কোনো ব্যক্তি কিছু বলেছেন; একটি প্রতিবেদন থেকে কোনো কিছু উন্মোচিত হয়েছে; কর্তৃপক্ষ কারো খোঁজ করছে, কোনো বিষয়ে সতর্ক করছে, নতুন কোনো পরিকল্পনা করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু দীর্ঘ প্রতিবেদন বা ফিচারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এতো সহজ হয় না। কোনো কিছু “উন্মোচিত” হয়েছে – শুরুতেই এমন কিছু লিখে ফেললে, প্রতিবেদনের ভেতরের টানটান ব্যাপারটি “নাই” হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। শুরুতেই মূল বিষয়টি জেনে ফেলার পর পাঠক পুরো প্রতিবেদন নাও পড়তে পারেন। ফলে তিনি হয়তো বিষয়টি ভালোমতো জানতেই পারবেন না। 

এই ঝুঁকি এড়াতে সাংবাদিকরা গল্প বলার সময় কিছু কৌশলের আশ্রয় নিতে পারেন, যাতে পাঠকরা বড় প্রতিবেদনও সময় নিয়ে পড়েন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিবেদনটি যেন সত্যিই তার যোগ্য হয়; এবং যে সুপ্ত প্রতিশ্রুতি পাঠককে দেওয়া হবে, তা যেন পূরণ হয়। 

দীর্ঘ প্রতিবেদনের শুরুটা কিভাবে করবেন, তা নিয়ে যাঁরা চিন্তায় আছেন বা লেখার ধরণ আরো উন্নত করতে চাইছেন; তাদের জন্য এখানে থাকছে দীর্ঘ প্রতিবেদন ও ফিচার লেখা শুরু করার সাতটি কৌশল। থাকছে বেশ কিছু উদাহরণও।

ব্যক্তি দিয়ে শুরু

 

 

দীর্ঘ প্রতিবেদন শুরু করার একটি বহুল প্রচলিত কৌশল হলো কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে শুরু করা। সাধারণত ঘটনার গোড়াপত্তন হয় এই ব্যক্তির হাত ধরে, আর সেখান থেকে কাহিনী ঢুকে পড়ে বড় কোনো ইস্যু বা প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুতে। কয়েক অনুচ্ছেদ পরে গিয়ে বলা হয় যে, কেন এই মানুষটিকে নিয়ে এতো কথা বলা হচ্ছে। 

দেখে নিন কিছু উদাহরণ: 

দ্য গার্ডিয়ান / অ্যামেলিয়া জেন্টলম্যান

‘নো ওয়ান শুড ডাই পেনিলেস অ্যান্ড অ্যালোন’: দ্য ভিকটিমস অব ব্রিটেন’স হার্শ ওয়েলফেয়ার স্যাংশনস

“আমরা জানি, মারা যাওয়ার আগে ডেভিড ক্ল্যাপসন মরিয়া হয়ে কাজ খুঁজছিলেন। কারণ যেখানে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তার পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বেশ কিছু জীবনবৃত্তান্তের কপি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে যখন বোনের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয়, তখনও তিনি একটি সুপারমার্কেটে চাকরি হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছিলেন।”

এই গল্পের মূল বিষয়বস্তু উন্মোচিত হয়, অনুচ্ছেদ চারে: “ঠিক কোন পরিস্থিতির কারণে ক্ল্যাপসন মারা গিয়েছিলেন, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে বেশ কিছু সংগঠন, যারা সরকারের নিপীড়নমূলক (অথবা কঠোর, নির্ভর করবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর) স্যাংশন কাঠামো সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন…” 

(ব্রিটেনে কেউ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা নিয়ে তার শর্ত লংঘন করলে, তাকে জরিমানা করা বা শাস্তি দেয়ার যে ব্যবস্থা, সেটিই ওয়েলফেয়ার স্যাংশন সিস্টেম নামে পরিচিত।) 

শর্টহ্যান্ড সোশ্যাল / জনি জ্যাকবসন

দ্য বিগ ইস্যু: এ হ্যান্ড আপ ফ্রম দ্য স্ট্রিটস

“৫০ বছর বয়সী নোয়েল কালিনানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, দুটোই বার্মিংহামে।

‘দ্য বিগ ইস্যুতে  (বিগ ইস্যু একটি সাময়িকী, যা বিক্রি করা হয় গৃহহীনদের মাধ্যমে; এভাবে তারা দরিদ্রদের আয়ের সুযোগ করে দেয়) আসার আগে, আমি সৈনিক ছিলাম, থাকতাম ক্যানালে।’ 

গত পাঁচ বছর ধরে তিনি এই ম্যাগাজিন বিক্রি করছেন এবং এখন রাতে একটি হোস্টেলে ঘুমাতে পারেন।

তার আগে তিনি রাস্তায় রাত কাটাতেন।” 

আসল ঘটনা উন্মোচিত হয় অষ্টম অনুচ্ছেদে (অবশ্য এই রিপোর্টের অনুচ্ছেদগুলো ছোট ছোট!): “নোয়েল ও তাঁর মতো আরো অনেকের জন্য, দ্য বিগ ইস্যু-ই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।” 

আইকিউফোর নিউজ/ ইমিসি আকিনবোবোলা,  পল ব্র্যাডশ, এবং ওগেচি একিয়ানিয়াউ

ফলো দ্য মানি

“২০১৪ সালের জানুয়ারি।

অল্পবয়েসী ৩০ জন বালকের একটি দল দক্ষিণপূর্ব নাইজেরিয়ার কালাবার সমুদ্রবন্দর থেকে একটি নৌকায় উঠতে যাচ্ছে। এই দলে আছে লাগোস থেকে আসা ইবুকা ওবুয়েহি ও জোয়েল ইজেহ। তাদের গন্তব্য পাশের দেশ ক্যামেরুন। সঙ্গে আছেন দুজন ফুটবল কোচ। একজনকে সবাই চেনে। তাদের কোচ ইমা। এই দলে আরো আছেন একজন নার্স, ড্রাই ক্লিনার, এবং এরিক ফ্রেড টোউমি নামের এক ফুটবল এজেন্ট।”

এই প্রতিবেদনে মূল ঘটনা জানানো হয়েছে দ্বিতীয় অধ্যায়ে গিয়ে। “খেলোয়াড় পাচার” নামের এই অধ্যায় শুরু হয়েছে এভাবে:

“প্যারিস ভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ফুট সোলজারের ২০১৩ সালে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর ১৫ হাজার কিশোর পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ইউরোপ বা অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়।”

অল্পবয়সী এই ছেলেদের একেকজনের অভিজ্ঞতা এতোই আকর্ষণীয় ছিল যে, মূল ঘটনা অনেক পরে জানানোর পরও তা পাঠককে আটকে রেখেছে। কিন্তু বিকল্প উপায় হতে পারত, তাদের জীবনের গল্প থেকে আরো আগে বেরিয়ে ‍গিয়ে, আসল ঘটনায় প্রবেশ করা এবং পরে আবার সেখানে ফিরে আসা। এভাবে পাঠক ইস্যুটির অনেক ছোটখাট ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারত এবং সেইসব কিশোর বা তাদের এজেন্টের কী হলো, তা জানার জন্যও অপেক্ষা করত।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস / জেমস কিঞ্জ, লীলা হাডু এবং মাইকেল পিল 

হাউ চায়না ব্রট ইটস ওয়ে ইনটু কম্বোডিয়া

“কম্বোডিয়ার চীনা ব্যবসায়িক কমিউনিটিতে, বিগ ব্রাদার ফু-কে সবাই বেশ সমীহ করে চলে। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সাবেক এই কর্মকর্তার পেটানো শরীর আর ভারি গলা – তাঁর নামের সঙ্গে বেশ মানানসই। তবে শারিরীক কাঠামোর চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী তাঁর রাজনৈতিক যোগাযোগ। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ছোট এই দেশে খুব কম বিদেশী বিনিয়োগকারীই ফু জিয়াংতিংয়ের মতো সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন।”

কর্মকাণ্ড দিয়ে শুরু

প্রতিবেদন দ্রুত এগোয়, যখন তা শুরু হয় একজন ব্যক্তির কোনো কর্মকাণ্ড দিয়ে। সেটি হতে পারে কথোপকথন (আপনার সঙ্গে বা তার কোনো বন্ধু-সহকর্মীর সঙ্গে); হতে পারে কোনো কিছু স্মরণ করা, বা তাদের পেশা সংশ্লিষ্ট কোনো কাজ। 

একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে: দ্য লইয়ার হু টেকস দ্য কেস নো ওয়ান ওয়ান্টস শিরোনামের প্রতিবেদনটি। এখানে শুরুটা হয়েছে এভাবে: 

“প্রতি মাসে দুই থেকে তিনবার, স্ত্রী ও তিন সন্তানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবিংডনের বাড়ি থেকে উত্তর দিকে রওনা দেন টম জাইলস। গাড়ি চালিয়ে অক্সফোর্ডশায়ার হয়ে, তিনি চলে যান  ক্যাম্পসফিল্ড হাউজ ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টারে।”

গাড়ি চালানোর এই কর্মকাণ্ড বর্ণনা দেওয়ার মাধ্যমে চারপাশের পরিবেশের একটি চিত্রও ফুটিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছেন প্রতিবেদক: 

“এটি টোরিদের স্বর্গরাজ্য। গ্রামীণ এলাকা, অনেক ফসলী জমি। ক্যাম্পসফিল্ডের অবস্থান লম্বা এই মেঠো পথের একেবারে শেষমাথায়। এর উল্টোদিকে অক্সফোর্ড বিমানবন্দরের সেই জায়গা, যেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও প্রশিক্ষণ বিমান রাখা হয়। ভোটের মানচিত্রে এটি পড়েছে টোরি অধ্যুষিত এলাকার শেষ প্রান্তে। তার এক দিকে ডেভিড ক্যামেরনের নির্বাচনী এলাকা উইটনি, আর অন্য দিকে বরিস জনসনের সাবেক সাম্রাজ্য, হেনলি।”

জায়গা দিয়ে শুরু

এখানেও প্রতিবেদন সাধারণত শুরু হয় ব্যক্তি দিয়ে, কিন্তু বর্ণনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে চারপাশের পরিবেশ বা পরিস্থিতি। 

বিবিসি / রুস্তম কোবিল

ওয়েটিং ফর দ্য সি

“কোজাবে এমন এক জেলে, যিনি বাস করেন মরুভূমিতে। 

শুধু তিনি না, তাঁর গ্রামের প্রায় সবাই মাছ ধরাকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭০-এর দশক থেকে সাগর শুকাতে থাকে, মরতে শুরু করে মাছ।

ধীরে ধীরে, গত ৪০ বছরে, প্রায় ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার বিপুল জলরাশি বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেছে বাতাসে।

মধ্য এশিয়ার আরল সাগর, আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে চতুর্থ। কাস্পিয়ান, সুপিরিয়র এবং ভিক্টোরিয়া হ্রদের পরেই তার অবস্থান। কিন্তু এখন সেই হ্রদের ১০ ভাগও অবশিষ্ট আছে কিনা, সন্দেহ।”

প্রতিবেদনটি এভাবে শুরু করা গেছে, কারণ এখানে পরিবেশ এবং তার পরিবর্তনটাই ছিল মূল বিষয়। এটিই প্রতিবেদনের মূল চরিত্র।

ওয়েট বাট হোয়াই / টিম আরবান

ফ্রম মোহাম্মদ টু আইসিস: ইরাক’স ফুল স্টোরি

“২ আগস্ট, শনিবার সকালে, কুর্দিশ ইরাকের আঞ্চলিক রাজধানী ইরবিল থেকে আমি একটি ট্যাক্সিতে উঠি; ড্রাইভারকে বলি খাজির রিফিউজি ক্যাম্পে নিয়ে যেতে। 

কাজটা একটু ভয়েরই বটে।

ভয়ের বিষয় হলো – খাজির ক্যাম্পের অবস্থান, স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিশ অঞ্চলের সীমানার বাইরে, যা কিনা গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচিত।”

এখানে, কেন্দ্রীয় চরিত্র রিপোর্টার নিজে, সেই সঙ্গে ড্রাইভারও। কিন্তু চারপাশের পরিবেশটাই আমাদের মনে থাকবে। এই প্রদিবেদনের শুরুতে একটা ভয়ের ব্যাপার আছে, যা মনে প্রশ্ন তৈরি করবে: গল্পের চরিত্রগুলো নিরাপদে থাকবে তো? 

১০০ রিপোর্টার্স / খাদিজা শরিফ

ট্রেড সিক্রেটস: কোকা-কোলা’স হিডেন ফর্মুলা ফর অ্যাভোয়েডিং ট্যাক্স

“হোটেলের দরজাটিই ছিল বিভাজক রেখা: ভেতরে, উন্নত বিশ্বের ধোপদুরস্ত ফ্যান্টাসির জগত,সবাই নিচুস্বরে কথা বলছে, ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে; আর দরজার বাইরে কালো রং, সাথে উত্তাপ, আর হরেক রকম বিক্রেতা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বেচাবিক্রি করছে। বাবার কাঁধে চেপে, শক্ত করে তার কান দুটো ধরে রেখে ঘুরতে ঘুরতে, আশির দশকে লুসাকা শহরের এমন দৃশ্যই আমার মনে গেঁথে গেছে। সরকারি বাজেট ভীষণভাবে কাটছাঁট করার কারণে জাম্বিয়ায় তখন ক্ষুধার্ত মানুষের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। ‘হারিয়ে যাওয়া দশক’ নামে পরিচিত এই সময়ে আফ্রিকার অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রতিক্রিয়া। ওয়াশিংটন কনসেনসাসের (যেখান থেকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের জন্ম) জের ধরে একের পর এক দেশ ভেঙ্গে পড়ছিল তাসের ঘরের মতো। আমার বাবা ছিলেন গাল্ফ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের পরিচালনা পর্যদে। তিনি কাজ করতেন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দারিদ্র দূরীকরণ নিয়ে, হোক বা না হোক অন্তত এমনটাই তারা দেখাতে চাইতেন। আপাতদৃষ্টিতে, লুসাকা হোটেলের (যেখানে আমরা থাকতাম) দরজার ভেতর আর বাইরের আলাদা জগতটাকে প্রতীকী মনে হলেও, সেটাই ছিল বাস্তবতা। এই বিভাজন তৈরি হয়েছিল – টাকা, গায়ের রং ও সামাজিক অবস্থানে পার্থক্য থেকে। কিন্তু ভেতর-বাহির, দুই জায়গাতেই একটি জিনিস ছিল অভিন্ন: কোকা-কোলা; তা সে রাস্তায় ছোট গাড়িতে করেই বিক্রি হোক, বা অভিজাত কোনো রেস্তোরাঁর দামী গ্লাসে ঢেলে।”

এখানে প্রথম কয়েকটি শব্দই অনেক কিছু বলে দেয়। “হোটেলের দরজাটিই ছিল বিভাজক রেখা”; বাক্যটি একই সঙ্গে একটি পরিস্থিতির কথা বলে এবং একটি সমস্যার কথাও বলে। বিভাজক রেখা কিসের মধ্যে?

পারিপার্শ্বিক অবস্থার বর্ণনাকে রূপকের মাধ্যমে তুলে আনতে এই কৌশল বেশ কার্যকর। সামাজিক বৈষম্য অথবা সমাজ কাঠামোয় লুকোনো জটিল বিভাজন নিয়ে প্রতিবেদনে, এর ব্যবহার চোখে পড়ে বেশি।

রূপক দিয়ে শুরু

আপনার প্রতিবেদনে যদি নাড়া দেয়ার মতো কোন উপাদান থাকে, তার বিশদ বিবরণ দিয়েও লেখা শুরু করতে পারেন। উদাহরণ হতে পারে – দ্য চিলড্রেন, দ্য হিডেন হোমলেস অ্যান্ড দ্য ওমেন হু হ্যাভ সাফারড ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স – দিজ আর দ্য স্টোরিজ ফ্রম ইনসাইড এ ম্যানচেস্টার ফুডব্যাঙ্ক ইন ২০১৮ নামের এই প্রতিবেদন:

“ম্যানচেস্টার সেন্ট্রাল ফুডব্যাঙ্কের স্টোররুমের তাকে রাখা – ছোট পায়ের একজোড়া জুতো, নবজাতকের তোয়ালে।

আলমারিটি খুবই গোছানো। গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত নানারকম জিনিস সেখানে সাজানো। ” 

এই কৌশলে একটি উপমা দিয়ে সামগ্রিক চিত্র বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। যেমন, একটি জটিল খেলনার রূপক ব্যবহার করে আপনি কোনো কাঠামোগত জটিলতাকে তুলে ধরতে পারেন, যা নিয়ে অনুসন্ধান করছেন। 

এভাবে শুরু করলে, কিছুদূর গিয়ে আপনাকে সেই তথ্যের অর্থ পরিস্কার করতে হবে। যেমন উপরের প্রতিবেদনটির ক্ষেত্রে পরবর্তী লাইন ছিল: “বিষয়টি শুধু ম্যানচেস্টারের সাধারণ বাসিন্দাদের উদারতাই বোঝায় না, এখান থেকে বোঝা যায় জরুরি সহায়তার চাহিদাও কতটা বেড়েছে।” এভাবে তারা পাঠকের কৌতুহল দ্রুতই প্রশমন করতে পেরেছে। খুব বেশি দেরি করলে পাঠক অধৈর্য্য হয়ে পড়তে পারে; বা ধারণা করতে পারে, আপনি শুধু ঐ একটি তথ্যের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছেন।

এই ঘরানার একটি চটুল উদাহরণ হতে পারে, ড্রপ দ্য ডেড ডাংকি নামের এই রম্য সিটকম (সিচুয়েশনাল কমেডি), যার একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে একজন রিপোর্টার লেবানন যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝাতে ধ্বংসস্তুপ থেকে একটি শিশুর টেডি বিয়ার পুতুল তুলে ধরছেন।  

প্রশ্ন দিয়ে শুরু

 

 

বেশিরভাগ দীর্ঘ প্রতিবেদনই পাঠকের মনে একটি প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন তৈরি করে – তা সে ব্যক্তি, জায়গা বা কর্মকাণ্ড – যা দিয়েই শুরু করেন না কেন। পাঠক জানতে চায়, “কেন এই ব্যক্তি/জায়গা/দৃশ্য গুরুত্বপূর্ণ?” কিন্তু কখনো কখনো সরাসরি প্রশ্ন দিয়েও শুরু করা যায়।

ডেভিড কক্স-এর আফটার দ্য আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ: দে রেইজড ১১৫ মিলিয়ন ডলার ফর দ্য ফাইট এগেইনস্ট এএলএস। সো হাও দে স্পেন্ড ইট? শিরোনামের প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছিল এভাবে: 

“অজানা একটি রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে, ঘটা করে মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে, যখন একটি দাতব্য সংস্থার হাতে তুলে দেয়া হলো, তখন তারা রীতিমত অভিভূত হয়ে পড়ে। সেই টাকা কিভাবে খরচ হচ্ছে তার একটি প্রাথমিক হিসাব বেরুনোর পর ডেভিড কক্সের মনে প্রশ্ন জাগে, এর পরে কি হবে – আর এতে রোগীদেরই বা কী লাভ হচ্ছে?

প্রতিবেদনটি আসলে শুরুই হয়েছিল এভাবে। এখানে মূল সমস্যাটির কথা বলা হয়েছে; আর এসেছে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র, যিনি মূল রহস্যের অনুসন্ধানে নামবেন। 

প্রথম অনুচ্ছেদে কাজে লাগানো হয়েছে চরিত্র, পরিস্থিতি ও সমস্যা ঘিরে আরো কিছু কৌশল।

“ওয়াশিংটন ডিসিতে এএলএস অ্যাসোসিয়েশনের (এএলএসএ) প্রধান কার্যালয়ে প্রথম কখন আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফোন কল পেয়েছিলেন, তা খুবই স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন ক্যারি মাঙ্ক। এএলএসএ-র প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মাঙ্ক বলেছেন, ‘এটি ছিল আগস্টের প্রথম সপ্তাহ। আমি একটি মিটিং-এ ছিলাম। ফোন বাজতেই সেটি ধরি। ওপার থেকে কথা বলছিলেন ম্যাসাচুসেটসে আমাদের সেন্টারের একজন নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বলছিলেন, ‘খুব বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সবাই প্রস্তুত থাকুন।’ ফলে আমরা দ্রুতই দেখতে শুরু করি কী পরিমান অর্থ এসেছে। আর দেখতে পাই আগের বছরের তুলনায় হুট করে সেখানে বেড়ে গেছে ৫০ হাজার ডলার। ’”

সমস্যা দিয়ে শুরু

 

 

এই পদ্ধতিও প্রশ্ন দিয়ে শুরুর মতোই। তবে সরাসরি কোনো প্রশ্ন তোলার বদলে, এখানে সমস্যার কথাটি আসে প্রচ্ছন্নভাবে।

প্রোপাবলিকা / লেনা গ্রোগার

ক্রুজ কন্ট্রোল

“প্রতি বছর ২২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বিলাসবহুল প্রমোদতরীতে তাদের স্বপ্নের ভ্রমণে যান, উপভোগ করেন আনন্দ ও বিলাসিতার সব রকম আয়োজন, আর কাটান কাঙ্ক্ষিত অবসর। 

কিন্তু তাদের মধ্যে এমনও শত শত মানুষ আছেন, যাদের জন্য বাস্তবতাটা স্বপ্ন থেকে অনেক দূরে। গত বছর, ১৭০০ জনেরও বেশি যাত্রী এবং নাবিক ক্রুজ থেকে নোরো ভাইরাসের মতো পেটের অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন। ২০১২ সাল থেকে অন্তত সাতজন শিশু এসব প্রমোদতরীর সুইমিং পুলে ডুবে গেছে বা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ সেইসব জাহাজে সার্বক্ষণিক লাইফগার্ড নেই। এবছর, কুড়ি পেরুনো এক কলেজ শিক্ষার্থী জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে গেছে, এবং তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে জাহাজ থেকে যাত্রী বা ক্রুদের পানিতে পড়ে যাওয়ার এমন ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২৪ বার।”

এই প্রতিবেদনে পাঠক ধরে রাখা এবং পরক্ষণেই অন্য এক দিকে নিয়ে যাওয়ার কৌশলটি খেয়াল করুন। প্রথম অনুচ্ছেদে ‘ভালো’ কিছুর কথা বলা হয়েছে। এবং পাঠক হিসেবে আমরা জানি এবং আশাও করি যে এই শান্ত দৃশ্যপট দ্রুতই বদলে যাবে।

এই প্রত্যাশা পূর্ণ হয় দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফের শুরুতেই: “কিন্তু…” দিয়ে।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো: এখানে এই “কিন্তু” খুবই তথ্যবহুল ও যথার্থ। এখানে সুনির্দিষ্ট সংখ্যার কথা বলা হয়েছে। ১৭০০ মানুষ। শুধুই “অনেক মানুষ” বলা হয়নি। এরপর আরো সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে “সাতজন শিশু” এবং “একজন ২১ বছর বয়সী কলেজ শিক্ষার্থীর” কথা।

এমন নির্ভুল তথ্য উল্লেখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে বোঝা যায়, রিপোর্টার সত্যিই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন। যদি এখানে কোনো অস্পষ্টতা থাকত, তাহলে আমাদের মনে সঙ্গে সঙ্গেই সন্দেহ তৈরি হতো, শুধু শুধুই কি বিষয়টি নিয়ে লেখা হচ্ছে? এনিয়ে কি আদৌ কোনো অনুসন্ধান হয়েছে?

এ জাতীয় প্রতিবেদনে পাঠকের জন্য আশ্বাস থাকে: এই হচ্ছে আসল ঘটনা, শীগগিরই আমরা আরো সুনির্দিষ্ট করে সেগুলো বলব।

উন্মোচন দিয়ে শুরু

 

 

এই কৌশলটি দীর্ঘ প্রতিবেদনের চেয়ে প্রাত্যহিক সংবাদের ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহৃত হয়। এখানে শুরু করা হয় অনুসন্ধানের সবচে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দিয়ে। বলা হয়: “অনুসন্ধান থেকে বের হয়ে এসেছে”, “কোনো ব্যক্তি এটি উন্মোচন করেছেন” বা “নথিপত্র থেকে উন্মোচিত হয়েছে”। যেমন: 

বিবিসি / সামান্থা পোলিং

ব্যাঙ্করাপ্টস এনজয় ‘ল্যাভিশ লাইফস্টাইল’

“অপরাধী ও অসৎ ঋণখেলাপীরা তাদের সম্পদ-সম্পত্তির দখল ধরে রাখতে চাইছে অকার্যকর ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। বিবিসির অনুসন্ধানে এটি উন্মোচিত হয়েছে।”

এরপর পাঠকের আকর্ষণ ধরে রাখার জন্য দেওয়া হয় আরো কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য। তারপর আসে বেশ কিছু উদাহরণ, এবং তারও পরে দেওয়া হয় কোনো ব্যক্তি বা কেস নিয়ে আরো সুনির্দিষ্ট বর্ণনা। 

এই কৌশলের ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগ থাকে, অনুসন্ধান থেকে বেরিয়ে আসা প্রধান তথ্যগুলোর দিকে। ঘটনার পারিপার্শ্বিক জটিলতার দিকে ততটা জোর দেওয়া হয় না। এই ধরণের প্রতিবেদন লেখা হয় উল্টো পিরামিড কাঠামো মেনে; যেখানে ধরে নেওয়া হয় পুরো প্রতিবেদন পড়ার মতো সময় বা ধৈর্য্য হয়তো পাঠকের নেই। ফলে শুরুতেই দেওয়া হতে থাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো। পাঠকও ভাবেন না, কিছু জানা বাকি রয়ে গেল কিনা।

এই কৌশলের সুবিধা হচ্ছে: পাঠক শুরুতেই সবচে ‍গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো পেয়ে যাবে। আবার এটি এই কৌশলের দুর্বলতাও বটে। কারণ পাঠক হয়তো জিনিসটি পড়বে, তবে জানবে ভাসাভাসাভাবে।

অন্যদিকে, উপরে আলোচিত অন্য কৌশলগুলোর ক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া হয় যে, পাঠক অনেক ধৈর্য্য নিয়ে পড়বে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও অনেক সময় চলে যায় প্রতিবেদনের একেবারে শেষদিকে। 

এসব কৌশলের সুবিধা হলো: পাঠকের সম্পৃক্ততা অনেক বাড়ে। তবে আশঙ্কাও থাকে, দরকারি তথ্য শুরুতেই খুঁজে না পেয়ে পাঠক হয়তো হতাশ বা বিরক্ত হবে। এত কিছুর মধ্যে সমন্বয় করাটাই সম্পাদনার শিল্প। 

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

শুরু নিয়ে এই ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে আপনি নিজের কাছেও প্রতিবেদনটি স্পষ্ট করে তুলতে পারবেন। বুঝতে পারবেন – এখানে প্রধান বিষয় কী কোনো ব্যক্তি নাকি কোনো জায়গা? কোনো নির্দিষ্ট তথ্য কী আপনার মাথায় গেঁথে গেছে? সেটিই কি তাহলে প্রতিবেদনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়?

প্রতিবেদন লেখার জন্য কোন কৌশলটি বেছে নিচ্ছেন, এবং সেটি কার্যকর হবে কিনা, তাও যাচাই করতে পারবেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে। যদি কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে শুরু করেন, তাহলে আপনাকে ভাবতে হবে: আপনার প্রতিবেদনে কী বলছে মানুষটি কেন গুরুত্বপূর্ণ? পাঠক কি শেষপর্যন্ত জানতে পারবে, তাদের ভাগ্যে কী ঘটল বা ঘটতে যাচ্ছে?

আপনার যদি দীর্ঘ প্রতিবেদন বা ফিচার শুরুর বিষয়ে আরো কোনো কৌশলের কথা জানা থাকে, আমাকে জানাতে পারেন এই লেখার নিচে কমেন্ট করে, অথবা টুইটারে।


লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পল ব্রাডশ-র অনলাইন জার্নালিজম ব্লগে। 

পল ব্র্যাডশ, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেটাসাংবাদিকতা এবং মাল্টিপ্লাটফরম ও মোবাইল সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতোকোত্তর কোর্স পরিচালনা করেন। তিনি অনলাইন সাংবাদিকতা নিয়ে বেশ কিছু বইও লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে  “অনলাইন জার্নালিজম হ্যান্ডবুক,” “ফাইন্ডিং স্টোরিজ ইন স্প্রেডশিটস,” “ডেটা জার্নালিজম হাইস্ট,” এবং “স্ক্র্যাপিং ফর জার্নালিস্টস।”

(লেখাটি বিজেসি পাঠকদের জন্য গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো।)