'একটি ফোন আমার মানসিক শক্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল'


'একটি ফোন আমার মানসিক শক্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল'

রাত ৮ টা। আইসোলেশনে। হঠাৎ দরোজা ধাক্কা দিলো লাবিব। ওর বয়স ৮। পড়ে বিএএফ শাহীন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। আমার দিকে তাকিয়ে নিস্পাপ চোখে জিজ্ঞেস করলো, 'আব্বু আমারও করোনা হয়েছে?' আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তার রিপোর্ট বিকেলেই পেয়েছি। পজেটিভ। 

আমাদের ৪ সদস্যের পরিবারে আমার এই ছোট বাবুটাই সবচেয়ে বেশী করোনা সচেতন। তিন মাস ধরে ওর স্কুল বন্ধ। ২৪ ঘন্টাই বাসায় থাকে। নিজ থেকেই একটু পরপর হাত ধোয়া, নিয়মিত স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, ঘরে মাস্ক পড়ে থাকা এসব ও অভ্যাসে পরিণত করেছিল। আমি অফিস থেকে বাসায় ঢুকলেই বলতো, আব্বু তোমার সাথে খেলা করা যাবে না। তুমি করোনা নিয়ে এসেছো। আমি হাসতে হাসতে গোসল সেরে ফেলতাম। এবং একদিন তাই হলো। 

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর কাশি শুরু হলো। জ্বর অনুভব করলাম। অফিসে যোগাযোগ করলাম। সবাই ডা. তুষার সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। ডাক্তার সম্পর্কে আমার একটা নেগেটিভ ধারণা আগে থেকেই তৈরী হয়ে আছে। এর কারণ, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আমি এখনো পর্যন্ত কোন চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসার চাইতে বেশী আশা করি তার হৃদয়-উৎসারিত ভালো ব্যবহার। এই আশা শুধু আমার না, এটাই বাঙালি জাতির মনস্তত্ত্ব। সেই মনস্তত্ত্বে ব্যাঘাত ঘটলেই নেমে আসে হতাশা । ঘটে মৃত্যুও। 

তবে, ডাক্তার তুষারের সঙ্গে অনেকবার কথা বলার পর মনে হলো, আমাদের সমাজে মানবিক, সেবক, ধৈর্যশীল চিকিৎসকও আছেন। কোন কারণে হয়তো ফোনে পাইনি, ঠিকই পরে তিনি কলব্যাক করেছেন। আমি তো অবাক। আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম, রোগীর প্রয়োজনে কোন চিকিৎসক ফোন কল ব্যাক করেন। তিনি আমাকে চিনেন না, আমিও তাকে চিনি না অথচ বিজেসির বদৌলতে করোনাকালে তার এই সেবা অবিশ্বাস্য। তার কাছ থেকে সেবা নিয়েছে আমার স্ত্রীও। তারও রিপোর্ট পজিটিভ।

আমার যখন ১০৩ ডিগ্রি জ্বর, অনবরত কাশি- তখন একটি ফোন আমার মানসিক শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ, 'ভয় পাবেন না, বেশী খারাপ মনে হলে হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি হতে পারেন। সবকিছু রেডি।' উদ্দীপক এই ফোনটি করেছিলেন সংগঠনের সদস্যসচিব শাকিল আহমেদ। 

আরেক কর্মকর্তা, আরটিভির উপ বার্তা প্রধান মামুনুর রহমান খান প্রায় সময়ই ফোনে জানতে চেয়েছেন শারীরিক অবস্থার খবর। খোঁজ নিয়েছেন লুৎফর রহমান, শরীফ উদ্দিন লিমনসহ অফিসের সহকর্মী ও বিজেসির অন্যান্য সদস্যসহ অনেকেই। 

বিজেসি (ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার) নামক সংগঠনটাও আরেকটা বিস্ময়। কয়েকটি মিটিং ও সেমিনারে উপস্থিত থেকে দেখেছি, সংগঠনের নেতৃবৃন্দের চিন্তার ষোল আনাই সদস্যদের কল্যাণ। কত চিন্তা, কত প্ল্যান, কত ক্ষিপ্রগতি, রীতিমতো আমাদের জীবনীশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে। মনে হয়, সংগঠন তো এমনই হওয়া উচিত! এ দেশে কত হাজার হাজার সংগঠন মরে গেছে শুধু নেতৃবৃন্দের লোভ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য। ফলে সদস্যরা যেমন আছে তেমনই রয়ে গেছে। ভাগ্যের চাকা বদলে গেছে শুধু নেতাদের। মালিক হয়েছেন তারা প্লট, ফ্ল্যাট, বিত্ত-বৈভবের। নি:স্ব থেকে গেছেন শুধু সদস্যরা। বিজেসি এ থেকে মুক্ত থাকতে পারলে এই সংগঠনটিই হবে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সাংগঠনিক অগ্রযাত্রা ও ইতিহাসে নতুন সংযোজন ও মাইলফলক।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প 'একরাত্রি'র স্কুল মাস্টারের কথা মনে পড়ে। সুরবালাকে হারানোর পর সে বলেছিল, সুরবালা আমার কী না হইতে পারিত। অথচ সেই সুরবালা তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। স্কুল মাস্টারের সুরবালার মতোই এই পৃথিবীও আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। যখন মিথ্যা অজুহাতে স্বাধীন সার্বভৌম ইরাক দখল করলো পাশ্চাত্যবাহিনী, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেনকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হলো তখন বুঝে ফেলেছি, এই পৃথিবী মানবিক মানুষের হাতে নেই। হাতছাড়া হয়ে গেছে। অথচ 'এই পৃথিবী আমাদের কী না হইতে পারিত’।

‘একরাত্রি’র প্রলয়ে সুরবালা ও স্কুলমাস্টারকে প্রায় কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। 'কেবল আর একটা ঢেউ আসিলেই তারা এক হইয়া যায়।' কিন্তু আর একটি ঢেউ কখনো আসবে না।
অমানবিক পৃথিবীতেও চলছে করোনা ভাইরাসের মহাপ্রলয়। ‘একরাত্রি’র গল্পের মতোই শুধু একটি বড় ঢেউ দরকার মানবিক মানুষগুলোকে ঐক্য করবার জন্য। সে ঢেউ আসবে কিনা আমার জানা নেই। তবে পরিবর্তনের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। 

লেখক: আকতার হোসেন, বার্তা সম্পাদক, আরটিভি