'প্রতিটা দিন দুর্বিসহ আতঙ্কে কেটেছে'
১২ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৪৮ পিএম
!['প্রতিটা দিন দুর্বিসহ আতঙ্কে কেটেছে'](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/ahad-hossin-tutul-20201216144146.jpg)
৮ এপ্রিল অফিস থেকে যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন ক্ষুণাক্ষরেও ভাবিনি কত বড় বিপদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। বাসায় ফিরে রাত থেকেই হালকা জ্বর, সঙ্গে মাথা ব্যাথা। উপসর্গ অল্প হলেও, এটিকে একেবারে হালকাভাবে নেইনি আমি। সে রাতেই প্যারাসিটামল গ্রুপের ঔষুধ খাই, আর সন্দেহ থেকেই পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে আলাদা ঘরে থাকতে শুরু করি।
সকালে জ্বর বাড়ার পাশাপাশি যখন দেখি মাথার সাথে শুরু হয়েছে পুরো শরীর ব্যাথা, তখন ঘাবড়ে যাই। সকাল সাড়ে আটটায় ফোন দিই আইডিসিআর’বিতে। কিন্তু কাউকে পাইনি সেদিন। এরপর ১৬২৬৩ নাম্বারে ফোন দিই। সেখানেও কেউ ফোন ধরেননি।
সবশেষ মাথায় ছিলো ৩৩৩ নাম্বার। সেখানে ফোন দেয়ার পর একজন চিকিৎসক ফোন ধরেন। নিজের উপসর্গগুলো তুলে ধরে সমাধান চাইতেই তিনি জানান, কোনোভাবেই এটিকে যেনো অবহেলা না করি। টেলিমিডিসিন হিসাবে তিন ধরনের ঔষুধ দিলেন। জানালেন, একদিন শারীরিক অবস্থা দেখার পর যেনো অবশ্যই একবার করোনা ভাইরাসের টেস্ট করিয়ে নিই।
১১ এপ্রিল, ২০২০, জীবনের এক বিভীষিকাময় দিন। এদিন সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠেই চলে যাই শাহবাগে পিজি হাসপাতালের ফেবার ক্লিনিকে। সেসময় লকডাউনে পুরো শহরে কোনো যানবাহন পাচ্ছিলাম না। শরীর সায় না দিলেও, উপায়ান্তুর না দেখে মোটরসাইকেল ড্রাইভ করে সেখানে যাই।
প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে রাস্তার উপর সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকি আমিসহ অন্য অনেক সম্ভব্য রোগী। সকাল ৯টায় হাসপাতালের গেট খুলে দিলে প্রবেশ করি। চিকিৎসক সব শোনার পর চার ধরনের ঔষুধ দেন। পরামর্শ দিলেন রক্তের স্যাম্পল দেয়ার। তখনও নিশ্চিত ছিলাম, আমার কোভিড হবে না।
কিন্তু ওই দিনই সন্ধ্যা ৬:২৪ মিনিটে যখন ফোনে এসএমএস আসলো আমি কোভিড পজিটিভ-এক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। দ্রুত আমার স্ত্রী আর মেয়েকে দুরে সরে যেতে বললাম। বন্দি হলাম একা একটা রুমে। মাগরিবের নামাজ পড়ে, বিষয়টা অফিসে জানালাম। সবাই সাহস দিলো। একটাই কথা, মনোবল হারানো যাবেনা।
মূহুর্তেই খবরটা ছড়িয়ে গেলো। পরিচিত- অপরিচিত অনেক ফোন আসতে শুরু করলো। স্তব্ধতায় এতোটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে, কারো ফোন রিসিভ করতে পারছিলাম না। তথ্য জানাতে শুধু আমার প্রতিষ্ঠানের এমডি, সিইও, নিউজ হেড আর এ্যসাইনমেন্ট এডিটরের সঙ্গে কিছু কথা শেয়ার করলাম। কারন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অফিসে কারা আমার সাথে মিশেছে, তারা যেন আলাদা থাকে।
এরপরই শুরু হলো, আমার একলা একটা ঘরে ১৪ দিনের জীবন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর দোয়ার পাশাপাশি, নিয়ম মেনে ১৫ দিনের ওষুধ চলতে থাকলো। এ সময় শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ অনুযায়ী গরম পানি খাওয়া, গরম পানিতে লবন দিয়ে গারগল করা, গরম পানির স্টিম নাক দিয়ে নিয়ে মুখ দিয়ে ছাড়া আর আদা-লেবু-গোলমরিচ-লবঙ্গ দিয়ে গরম পানি চায়ের মত করে বারবার খাওয়া চলতে থাকলো।
বিভীষিকার দিন ছিলো সেদিন, যখন পরদিনই থানা থেকে আমার এলাকা লকডাউন করতে এলো। এলাকার লোকজন আমার বাসার দিকে, কেমন একটা আড়চোখ নিয়ে তাকাতে থাকলো। যেনো আমি কোনো মারাত্মক অপরাধ করে ফেলেছি। কৃতজ্ঞতা সেসময় লকডাউন মনিটর করতে আসা এসআই মেহেদীর প্রতি। কারন, তিনি হ্যান্ডমাইকে এলাকায় ঘোষণা দেন যে, কোনো ধরনের হ্যারাসমেন্ট করা হলে ব্যবস্থা নিবেন।
তারপরও এলাকার মানুষজন নানাভাবে অসহযোগিতা করতে থাকে। কেউ বাজার কিংবা দরকারি ওষুধ এনে দিতে বাসার কাছে এলেও, এলাকার মানুষজন তাকে সেটা দিতে দিতো না। কেউ সহযোগিতা করার আগ্রহ দেখালেও, অন্যরা তাকে নিরুৎসাহিত করতো। আমি শুরুর দিকে আক্রান্ত হওয়ায়, ওই সময়টায় করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করতো। অসুস্থতার মধ্যেই একদিন অনেক বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যখন জানলাম, আমার পাশের বিল্ডিংয়ে একজন মারা গেছেন করোনা আক্রান্ত হয়ে। এলাকার মানুষ ধরেই নিয়েছিলো যে এটা নিশ্চয়ই আমি।
আমার অসুস্থতার দিনগুলোতে আতঙ্কে স্ত্রী সারারাত ঘুমাতে পারতো না। প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে আমাকে দুর থেকে ডেকে কথা বলতো, দেখতো আমি ভালো আছি কিনা। একদিন ফজরের নামাযের পর ঘুমটা বেশি চলে আসায়, স্ত্রীর ডাকে সাড়া দিতে পারিনি আমি। ভয় আর আতঙ্কে আমার স্ত্রী সন্তান দুজনেই কান্না শুরু করে দেয়।
আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আমার রুমে যেতে তাদের নিষেধ করেছিলাম। সে কারনে তারা রুমে যেতেও পারছিল না। আতঙ্কে হিতাহিত বুদ্ধি হারিয়ে ফেললেও, একটা সময় আমার মেয়ের উপস্থিত বুদ্ধিতে কাজ হয়। সে আমার ফোনে কল দেয়। এতে যখন আমি জেগে উঠি, তারা হাফ ছেড়ে বাঁচে দু'জনেই। এভাবে প্রতিটা দিনই কী দুর্বিসহ আতঙ্কে কেটেছে আমাদের সবার দিনগুলো।
১৪ দিনের এই সময়ে পরিবার, সহকর্মী, বাড়ির মালিক, সংগঠনের ভাই-বোনেরাসহ অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী খোঁজ নিয়েছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। ১৪ দিন শেষে, ২৫ এপ্রিল মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে মুক্তি দেন।
টেস্ট করালে প্রথমবারের মতো নেগেটিভ রেজাল্ট আসে। নিয়ম অনুযায়ী পরপর দু'বার টেস্ট করার পরামর্শ দেন আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা মোশতাক হোসেন।
আবারো ২৫ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় স্যাম্পল নিয়ে যায় আইইডিসিআর। যার ফলাফল পাই ১ মে। আলহামদুলিল্লাহ, পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ রহমতে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকার পর আমার কোভিড-১৯ স্যাম্পল টেস্টে পরপর দুই রিপোর্টই নেগেটিভ আসে। আল্লাহই সর্বোত্তম সেফা দানকারী। সঙ্গে ছিল সবার দোয়া।
যদিও আমি চিকিৎসক না, তারপরেও আক্রান্ত হওয়ার কারনে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেখান থেকেই বলছি, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি প্রতিদিনই কিছু জরুরি অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত সবারই। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে কোভিড-১৯ সহজে বড় কোন ক্ষতি করতে পারে না।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক, গ্লাভস, শাওয়ার ক্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করুন। আর প্রস্তুতি নিন প্রচুর পানি পান করার ( আক্রান্ত হলে কুসুম গরম পানি খাওয়া ভালো)। এছাড়া লেবু, তেঁতুল, পেয়ারা, মাল্টা, আনারস জাতীয় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল--আর বেশি বেশি শাকসবজি খান। এ সময় রেড মিট বাদ দিয়ে মাছ, ডিম, ডাল জাতীয় প্রোটিন খাওয়া ভালো। শরীর ঘামিয়ে ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলুন, যাতে ফুসফুস থাকে শক্তিশালী ও সচল। দিনে অন্তত তিনবার লম্বা নিঃশ্বাস মুখ দিয়ে নিয়ে ৫ সেকেন্ড ধরে রেখে, তারপর নাকের এক ফুটো দিয়ে ছাড়বেন। একইভাবে আবারো নিঃশ্বাস নিয়ে অপর এক ফুটো দিয়ে ছাড়বেন। হাঁটুভাঁজ করে মেঝেতে বসে, ৩ মিনিট থাকার চেষ্টা করুন। চিকিৎসকরা এটিকে ব্রিদিং এক্সারসাইজ বলেন। এতে দীর্ঘদিন অলস থাকা ফুসফুস সক্রিয় হবে।
আর হ্যাঁ, আপনার এলাকায় কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকে অবহেলা নয়। বরং পারলে দুরত্ব বজায় রেখে তাকে সহযোগিতা করুন। সেটা না পারলে, মানসিক সাপোর্ট দিন। এতে করোনা আক্রান্ত রোগী মনোবল ফিরে পাবে। যা তাকে দ্রুত সুস্থ হতে সহাযোগিতা করবে। আল্লাহ সবাইকে সুস্থ রাখুন।
লেখক: আহাদ হোসেন টুটুল, সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, দীপ্ত টিভি
সংবাদ ডায়েরি এর আরও লেখা
![ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দুই সাংবাদিক গ্রেপ্তার](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/250311187-416801276755007-381958739815597211-n-20211102145924.jpg)
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দুই সাংবাদিক গ্রেপ্তার
![বিদেশি চ্যানেল বন্ধ রেখে হলেও ক্লিনফিডের বিষয় সুরাহা হওয়া জরুরি](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/243579010-920532778818228-7188235326273913402-n-20211003194824.jpg)
বিদেশি চ্যানেল বন্ধ রেখে হলেও ক্লিনফিডের বিষয় সুরাহা হওয়া জরুরি
!['ক্লিক-রিচ বাণিজ্য' বনাম শিরোনাম বিভ্রাট](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/pranty-sarwar-20210916193219.jpg)
'ক্লিক-রিচ বাণিজ্য' বনাম শিরোনাম বিভ্রাট
![ভিউ প্রতিযোগিতার ঢেউয়ে কলুষিত হচ্ছে গণমাধ্যম](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/pranti-sarowar-20210902155548.jpg)
ভিউ প্রতিযোগিতার ঢেউয়ে কলুষিত হচ্ছে গণমাধ্যম
![দেশের মফঃস্বল সাংবাদিকতা](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/milton-20210731190956.jpg)
দেশের মফঃস্বল সাংবাদিকতা
![প্রত্যেক পেশাতেই ভালো মানুষ ও মন্দ মানুষ, দু'রকম মানুষই থাকেন](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/zabed-akhter-20210429154633.jpg)
প্রত্যেক পেশাতেই ভালো মানুষ ও মন্দ মানুষ, দু'রকম মানুষই থাকেন
![বসুন্ধরার এমডির বিরুদ্ধে মামলা, গুলশান থানায় নাটকীয় চার ঘন্টা!](https://www.bjcnews.com/media/imgAll/BG/2020November/omor-faruq-20210428164008.jpg)
বসুন্ধরার এমডির বিরুদ্ধে মামলা, গুলশান থানায় নাটকীয় চার ঘন্টা!
![](https://www.bjcnews.com/media/advertisement/ad300x250.png)