‘যুদ্ধটা যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক’


‘যুদ্ধটা যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক’

(করোনায় আক্রান্ত কয়েক শ’ গণমাধ্যম কর্মী। অনেকেই এখন সুস্থ। ফিরে এসেছেন যার যার কর্মস্থলে। কিন্তু কিভাবে জয়ী হলেন তারা? ক্যামন কেটেছে করোনায় আক্রান্ত দিন-রাত? সেসব গল্প ধারবাহিকভাবে প্রকাশ করবে বিজেসি নিউজ। তারই অংশ হিসেবে দ্বিতীয় পর্বে ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সিনিয়র নিউজ এডিটর গোলাম কিবরিয়ার ভাষ্য ! – সম্পাদকীয় বিভাগ)

ইদানিং আমি প্রচুর ফোনকল পাচ্ছি। সময়-অসময়ে নানা মানুষের ফোন। এদের সবাইকে যে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, এমনটা নয়। চেনা পরিচিতের বাইরেও অনেকে বহু ঝামেলা করে আমার ফোন নাম্বার জোগার করে কল দিচ্ছেন। কারণটা কী, কেন আমি হঠাৎ এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলাম? উত্তরটা হচ্ছে, সম্প্রতি কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি এবং এখন পুরোপুরি সুস্থ্য, অফিস করছি, অন্যান্য কাজকর্মও করছি, মানে এই অবরুদ্ধতার সময়ে যতোটা করা যায় আরকি।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে প্রতিদিনই আমার কাছে এতো এতো ফোনকল আসছে, সেটা কেন?

প্রথম কারণ, মানুষ জানতে চায় করোনা আক্রান্ত হলে করণীয় কী। এটাতো সত্যি যে পত্রপত্রিকা, রেডিও, টিভি, ইন্টারনেট, ফেসবুকে ভুরি ভুরি তথ্য রয়েছে। তারপরও মানুষ ‘অথেনটিক ইনফরমেশন’ চায়। অধিক তথ্যপ্রবাহ বা ‘ইনফোডেমিক’ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বহুবার এটা প্রমাণিত হয়েছে, তথ্যসমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে মানুষ আসলে কারো মুখ থেকে, যেটা তার ঠিক ঠিক জানা দরকার- সেই তথ্য পেতে চায়। আমার এই কয়দিনের অভিজ্ঞতায় এটাই মনে হয়েছে।

দ্বিতীয় এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে যেটি আমার মনে হয়েছে, সেটি হচ্ছে, আতঙ্ক। চারদিকে একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। কখন না জানি আবার করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ি, একবার আক্রান্ত হলে আমার কী হবে!
হাসপাতালে জায়গা পাবোতো? আইসিইউ বা অক্সিজেনের দরকার হলে কোথায় যাবো! আমিতো মরেই যাবো…..এই চিন্তাগুলি মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। সেই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে তারা কারো সাথে কথা বলতে চায় এমন কারো সাথে, যে এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে।

আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি, মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বড় ঝামেলা ছাড়াই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা করতে পেরেছি। এর পেছনে সিংহভাগ কৃতিত্ব দিতে হয় আমার স্ত্রী নাজনীন আখতারকে। তার প্রত্যক্ষ সহায়তা এবং নিবিড় তত্ত্বাবধান ছাড়া এই পথ পাড়ি দেয়াটা শুধু কষ্টকরই নয়, মনে হয় অসম্ভবই ছিলো।

রোগটি নিয়ে যে ফোনকলগুলো আমি নিয়মিত পাই, সেখানে কিছু কমন প্রশ্ন থাকে। এ থেকে আমার ধারণা, অনেক মানুষের মনেই আজ এ বিষয়গুলো নিয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বলে রাখি, আমি বিশেষজ্ঞ নই, একজন আক্রান্ত মানুষমাত্র। আমি খুব সরল ভাষায় নিজের অভিজ্ঞতাটুকুই বলতে পারি। এর বাইরে আমার কোন জ্ঞান নেই।

ঘরে থেকেই যারা করোনা সংক্রমণের সাথে যুদ্ধ করছেন. তাদের জন্য আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা-

এক. বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বড় ঝামেলা ছাড়া এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়, শুধু মনে সাহস রাখা দরকার আর ইতিবাচক ভাবনাটা ধরে রাখা জরুরি। মনকে বোঝাতে হবে, এই কষ্ট সাময়িক। অল্প কিছু দিন, তারপরই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা, লেখালেখি, ছবি আকা, যার যেটা ভালো লাগে সেটাই করবেন।

দুই. বেশি বেশি প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। খেতে হবে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার। বেশি বেশি তরল খাবার খুবই উপকারি। আমি নিজে গরম পানির ভাপ, আদা-লেবু দিয়ে রং চা খেয়েছি প্রচুর পরিমাণে, এটা কতোটা কাজের সেটা জানা নেই, তবে আরাম পেয়েছি।

তিন. আইসোলেশন বা সঙ্গনিরোধের বিষয়টি কঠোরভাবে মানতে হবে। নিজে আক্রান্ত হলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা যেন নিরাপদে থাকে, সুরক্ষিত থাকে সে জন্যই নিজেকে পরিবার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি কক্ষে নিজেকে বন্দি করে ফেলেছিলাম। সেখানে খুব প্রয়োজনে শুধু আমার স্ত্রীর প্রবেশাধিকার ছিলো। সেও আসতো মাস্ক পড়ে সবরকম সুরক্ষা নিয়ে।

চার. কোভিড ১৯ আক্রান্ত একজন মানুষের জন্য একটা ঘরে একা আবদ্ধ থাকার সময়টা সবচেয়ে কঠিন অংশ বলে আমি মনে করি। পরিবারের সদস্যরা হাতের নাগালেই আছে, কিন্তু তাদের দেখতে পাচ্ছি না, কথা বলতে পারছি না, বাচ্চাটাকে কোলে নিতে পারছি না, এটা খুবই কষ্টের। আর একটা ঘরে দিনের পর দিন অসুস্থ অবস্থায় একা থাকা সহজ কথা নয়। আমার জন্য এই অংশটুকু ছিলো সবচেয়ে কঠিন।

পাঁচ. এখন আমরা যে পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি, তাতে প্রতিটি মানুষেরই মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। ভাবতে হবে, যে কোনো সময় আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হতে পারি। এটা ভেবে রাখলে অন্তত মানসিক প্রস্তুতিটুকু থাকে। আর প্রতিটি পরিবারের প্রস্তুতি নিতে হবে আগে থেকেই, কোনো একজন সদস্য আক্রান্ত হলে কিভাবে তাকে আইসোলেশনে রাখা হবে। ঢাকা শহরের বাস্তবতায় বলা যায়, আক্রান্ত সদস্যকে পৃথক কক্ষে আইসোলেশনে দেয়ার মতো পরিস্থিতি প্রতিটি পরিবারে, প্রতিটি বাসায় নেই। সে ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা কী হতে পারে, সেই প্রস্তুতিটা আগেভাগে নিয়ে রাখলে আকষ্মিকভাবে কেউ আক্রান্ত হলে দিশেহারা হয়ে পড়তে হবে না।

ছয়. প্রয়োজনীয় ফোন নম্বরগুলো হাতের কাছেই রাখা। যেন প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যায়। রোগি যদি বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নেয়, সে ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হলে অ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা হাসপাতালগুলোর ফোন নম্বর জানা থাকা জরুরি।

সব শেষে আবারো বলছি, কোভিড ১৯ চিকিৎসায় মনোবল, পরিবারের সহায়তা-সহমর্মীতা, আপনজনদের ভালোবাসা আর ইতিবাচক মনোভাব খুবই জরুরি।

আমার কাছে এই যুদ্ধটা ছিল যতোটা না শারীরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। তাই মন শক্ত রাখতে হবে। জয় আসবেই ইনশাআল্লাহ।

লেখক: সিনিয়র নিউজ এডিটর, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন