‘মনে হচ্ছিলো, বোধহয় হেরে যাচ্ছি!’


‘মনে হচ্ছিলো, বোধহয় হেরে যাচ্ছি!’

(করোনায় আক্রান্ত কয়েক শ’ গণমাধ্যম কর্মী। অনেকেই এখন সুস্থ। ফিরে এসেছেন যার যার কর্মস্থলে। কিন্তু কিভাবে জয়ী হলেন তারা? ক্যামন কেটেছে করোনায় আক্রান্ত দিন-রাত? সেসব গল্প ধারবাহিকভাবে প্রকাশ করবে বিজেসি নিউজ। তারই অংশ হিসেবে প্রথম পর্বে একাত্তর টিভির সিনিয়র ক্যামেরাপার্সন সাঈদ হায়দারের ভাষ্য ! – সম্পাদকীয় বিভাগ)

শুরুতেই বলে রাখি যেহেতু করোনাকালীন সময়েও ক্যামেরাম্যান হিসেবে আমাকে ডিউটি করতেই হবে আর করোনায় যে আক্রান্ত হতেই পারি এমন চিন্তা মনের মধ্যে সব সময় কাজ করতো। অবশেষে ৮ মে শুক্রবার রাতে শরীর ব্যাথা শুরু হলো। সকালে উঠে কিছুটা জ্বর অনুভব করতে থাকি, মাত্রা ছিল ১০০ থেকে ১০২। করোনা সন্দেহে পরিবারের বাকী ৩ সদস্য থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বাসায়ই অবস্থান করতে থাকলাম এবং বিষয়টি অফিসকে অবহিত করলাম। ৯ মে শরীর ব্যথা ও জ্বর কিছুটা স্বাভাবিক ছিল।

১০ মে জানতে পারলাম বিজেসি’র উদ্যোগে করোনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। খবরটা শুনে বেশ ভালোই লাগলো। বিজেসির পক্ষে করোনা রোগীদের যিনি পরামর্শ দিবেন তিনি হলেন ডাক্তার তুষার মাহমুদ। ওনার সাথে এর মধ্যে কথাও হয়ে গেল। পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ফর্মটি পূরণ করে ফেল্লাম কিন্তু ফিরতি কোন ফোন পেলাম না।  ১১-১২ মে শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ হতে থাকে। জ্বরের মাত্রা কমে আসলেও শরীর ব্যাথা কোনোভাবেই সহ্য হচ্ছিলো না। করোনা পরীক্ষার জন্য বিজেসির হোয়াটস্ অ্যাপ গ্রুপে যোগাযোগ করে তাদের সহযোগিতায় ১৩ মে নমুনা দিয়ে আসলাম। এবার অপেক্ষা ফলাফলের। পরের দিন ১৪ মে বেলা ১১টায় আমি নিজেই ডাক্তার তুষারকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম আমার রেজাল্ট পজেটিভ।

খবর শুনে প্রথমে আমি কিংবা পরিবারের কেউই বিচলিত হইনি ঠিকই কিন্তু ভয় ছিল আমার দ্বারা পরিবারের অন্য কেউ সংক্রমিত হয় কী না।

টেস্টের ফল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যবহারের সব কিছু নিয়ে একটি রুমে আবদ্ধ হই। তারপর ডাক্তার তুষারের পরামর্শে ঔষধ সেবন করতে থাকি। খাবারের ব্যাপারটা ছিল এ রকম- আমার জন্য নির্ধারিত প্লেটে খাবার রুমের দরজার বাইরে রেখে যেতো আমার মেয়ে অথবা স্ত্রী । আমার জামা-কাপড়, প্লেট, গ্লাস, বাটি আমি নিজেই পরিস্কার করতাম। আমার ব্যবহারের কোন কিছু পরিবারের অন্য কাউকে ধরতে দিতাম না। বড় ব্যাপার ছিল আমার মেয়ে বা স্ত্রী ওরা কেউ ভয় পেত না, নিয়ম মেনেই আমার যত্ন-আত্তি করতো।

১৬ মে থেকে ২০ মে পর্যন্ত আমার অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছিল। অফিস কলিগ ও বন্ধু-বান্ধবরা বলতে লাগলো বা আমি নিজেও মিডিয়ার খবরে জানতে পারছি কুসুম গরম পানি দিয়ে গারগল, নাকে মুখে গরম পানির ভাপ নেয়া, লেবু আদা দিয়ে চা খেলে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায় এবং তাই করতে থাকলাম। একটি কথা বলতেই হয়, সকলেই বলে মনে সাহস রাখতে হবে। সাহস, শক্তি ও বল আমার কোনটাই কমতি ছিল না। কিন্তু আমার শরীর যখন আর আমাকে চলার মতো শক্তি দিচ্ছে না, তখন আমি নিরুপায়। বার বার মনে হচ্ছিল না আর মনে হয় পারবোনা। মনে হচ্ছিল হয়তো হেরে যাচ্ছি..

এরই মধ্যে মুখ এত তিতা  হয়ে গেল যে, সাদা পানিও পান করতে পারছিলাম না। খাবার মুখের সামনে নিলেই বমি আসে, খাবার থেকে উদ্ভট সব গন্ধ পাই। প্রচন্ড রকম শরীর, মাথা ও চোখ ব্যাথা। বমি শুরু হলে মনে হতো পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেড়িয়ে আসছে। এমন করে ৫টি দিন অতিবাহিত হলো। 

২১ মে থেকে আস্তে আস্তে ভালোর দিকে ফিরে আসি। ৩০ মে পুনরায় নমুনা দিয়ে আসি। ১ জুন করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। তবে শরীর অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।

সকলের উদ্দেশ্যে বলবো করোনাকে ভয় না করে নিয়ম মেনে করোনা পজেটিভ রোগীকে বাসায় রেখে ঠিকমতো যত্ন করলে রোগী সুস্থ হবেই। বিশেষ করে নিয়মিত গরম পানিতে লেবু, কমলা বা মালটাসহ অন্যান্য ফলফলাদি খেতেই হবে।

সবশেষে আমার অফিসের সহকর্মী-কর্মকর্তা, বিজেসি ও টিসিএ’র সকল নেতাকর্মী, ডা. তুষার মাহমুদ এবং আমার অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব আর পরিবারের সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় করোনা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। এজন্য সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

আসুন সবাই সতর্ক থাকি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি ও সুস্থ থাকি।

লেখক: সিনিয়র ক্যামেরাপার্সন, একাত্তর টিভি