বিজেসির দ্বিতীয় সম্প্রচার সম্মেলন: সুরক্ষা স্বাধীনতা সম্ভাবনা
২০ নভেম্বর ২০২০, ১১:৫১ পিএম
রাজনীতির আধুনিক বয়ানে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সেই চতুর্থ স্তম্ভের অন্যতম মাধ্যম টেলিভিশন। কেমন আছে তার কর্মীরা, মধ্যমটিইবা কতটা ভালো আছে। সেইসব তত্ত্বতালাশ করতেই দ্বিতীয়বারের মতো ব্রডকাষ্ট জার্নালিস্ট সেন্টার আয়োজন করেছিলো সম্প্রচার সম্মেলনের। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল সুরক্ষা স্বাধীনতা সম্ভাবনা।
সম্প্রচার সাংবাদিকদের জন্য ৬ মার্চের সকালটা ছিল কিছুটা ভিন্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক মিলনায়তন ও তার আশপাশজুড়ে উৎসবের আমেজে। সারাবছর অপরের জন্য বলা সম্প্রচার কর্মীরা একটি দিন নিজের কথা বলার জন্য, সহকর্মীদের কথা শোনার জন্য সকাল থেকেই আসতে থাকেন টিএসিতে। যদিও তার আগের দিন থেকেই সম্মেলনের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের এই মিলন কেন্দ্রে। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় নিবন্ধন। এবারের নিবন্ধনের অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল সদস্যদের জন্য স্থায়ী পরিচয়পত্র বিতরণ। আগামী দিনে সংস্থার সকল অংশগ্রহণমূলক কাজে যা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। রেজিস্ট্রেশন করা সদস্যদের এবার একটি সুন্দর ব্যাগও দেয়া গেছে যার ভেতরে সম্মেলনের টি শার্ট, কফি মগ আর সম্মেলনের পরিচয় পত্রও ছিল।
রেজিষ্ট্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভেতরে প্রবেশের পর ক্যাফটোরিয়ায় ধুমায়িত কফিসহ প্রাতরাশ সারেন সদস্য ও অতিথিরা।
সকাল ১০টায় টিএসসি’র মাঠে খোলা আকাশের নীচে দেশাত্ববোধক গানের মাধ্যমে শুরু হয় দ্বিতীয় সম্প্রচার সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা। “তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে” – এর প্রার্থণার সাথে মিশেছিলো সংকোচের বিহ্বলতা মুছে ফেলার সংকল্প।
সাড়ে ১০টায় ‘নীতি সংলাপ: কর্মী সুরক্ষা’।শিরোনামে মুল উদ্বোধনী পর্ব শুরু হয় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে। গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী, বিজেসি’র সন্মানীত চেয়ারম্যান, সদস্য সচিব, ট্রাস্টি এবং সকল অতিথিবৃন্দ দাঁড়িয়ে সুর মেলান জাতীয় সংগীতে। আলোচনা পর্বের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার বাংলাদেশ বিজেসি’র সদস্য সচিব ও একাত্তর টেলিভিশনের বার্তা প্রধান শাকিল আহমেদ। আলোচনায় অংশ নিয়ে দেশের সম্প্রচার মাধ্যমের কর্মীদের নানামুখী সমস্যার চিত্র তুলে ধরেন বিজেসি’র চেয়ারম্যান ও মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা প্রধান রেজোয়ানুল হক। তখন মিলনায়তনে দেশের সব গণমাধ্যমের শত শত কর্মী। কিন্তু শিল্পটির চলমান অস্থিরতায় ঠিক কেমন আছেন সম্প্রচারকর্মীরা, কিভাবে কাটছে দিন অথবা সামনের দিনগুলো? এমন আরো বহু প্রশ্ন চোখ মুখ জুড়ে। ২০ বছরের টেলিভিশন ক্যারিয়ার কিন্তু কোন এক সকালে জানলেন প্রতিষ্ঠানে তার আর প্রয়োজন নেই। তরুন কর্মীটি যে কিনা জীবনের স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেছেন নতুন এক সংসার প্রতিষ্ঠান বলছে তাকেও প্রয়োজন নেই। তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন এই মানুষগুলো? আবার কারো চাকরি আছে তো বেতন নেই ২ থেকে ৫ মাস। কারো আবার চাকরি আছে বেতন আছে তো ইনক্রিমেন্ট নেই বছরের পর বছর। একে একে এমন অনেকগুলো গল্প উঠে আসে বিজেসি নেতৃবৃন্দের আলোচনায়। এপর্বের প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। কর্মীদের এমন সব বেদনার গল্প ছুঁয়ে যায় তাঁকেও। বলেন, সম্প্রচার মাধ্যমের কর্মীদের সুরক্ষায় দ্রুত গণমাধ্যম কর্মী আইন করা হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেখানে গুজব ছড়ায়, তৈরী করে অস্থিরতা সেখানে মুলধারার গনমাধ্যম সঠিক তথ্যের একমাত্র উৎস। তাই বাঁচিয়ে রাখতে হবে মুলধারার গনমাধ্যম। সংবাদকর্মীরা মেধাবী। তারা ভালো চাকরী ছেড়ে এই পেশায় এসেছেন। দেশ গঠনে তারাই নিয়ামক ভূমিকা রাখেন। সম্প্রচার মাধ্যমে চাকরীর সুরক্ষায় মালিকদের সদয় বিবেচনাও আসা করেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব ‘নীতি সংলাপ: শিল্প সুরক্ষা’। এই পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দেশের টেলিভিশন শিল্পের হাল হকিকত তুলে ধরে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার বাংলাদেশ -বিজেসি। টেলিভিশনকে একটি পৃথক শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ারও প্রস্তাব উঠে আসে। বিজ্ঞাপন নীতিমালা আর রাষ্ট্রের সঠিক পরিকল্পনাই যে টেলিভিশন কে বাঁচাতে পারে উঠে আসে সে বিষয়টিও। বিশেষ অতিথি যুক্তরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার জাভেদ প্যাটেল মনে করেন, গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য সবার আগে প্রয়োজন গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা। গণমাধ্যমের সুরক্ষায় সরকার সচেষ্ট থাকবে এমন আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারী ইহসানুল করীম।
টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স এটকো’র পক্ষ থেকে এই আলোচনায় যোগদেন সংগঠনটির সিনিয়র সহসভাপতি মোজাম্মেল বাবু। টেলিভিশন মালিকানার ২০ ভাগ পেশাজীবীদের দেয়ার সুপারিশ করেন তিনি। এছাড়া টেলিভিশন শিল্পের বর্তমান অস্থিরতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের জন্য লাভজনক ফর্মুলা খুঁজে বেড় করার পরামর্শও উঠে আসে। আলোচনা পর্বে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান বলেন, ২০ হাজার কোটি টাকার শিল্প গণমাধ্যম। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ উঠে আসে তার বক্তব্যে।
অর্থমন্ত্রী আলোচনার সমাপ্তিতে বলেন গণমাধ্যম দেশের অর্জন বিশ্বে তুলে ধরছে। মিডিয়া নিছক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নয়, এটা শিল্প। এই শিল্পকে রক্ষা করতে সরকারের অংশ হিসেবে বিজেসির যে কোন পদক্ষেপে পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন তিনি।
দিনভর অনুষ্ঠানে এ পর্যায়ে ছিল মধ্যাহ্ন বিরতি। এবারের আয়োজনে ছিল বিখ্যাত ‘মেজবান’। সম্মলেনের পর্দা উঠার পর থেকেই টিএসসির খোলা ময়দান আর করিডোর মুখরিত ছিল সম্প্রচার কর্মীদের কোলাহলে। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে তা চূড়ান্ত রূপ নেয়। একসাথে এত প্রিয় পরিচিত মুখ কাছে পেয়ে সদস্যরা মেতেছেন নানা আমোদ আর ম্মৃতিচারণে। সেই সাথে চলেছে সেই স্মৃতি ধারে রাখার অবিরাম চেষ্টা। আড্ডা আর গল্পর সাথে সমান তালে চলেছে হাতে থাকা মুঠোফোনের ক্যামেরা। মাঠের একপাশে রাখা বোকা জাদুর বাক্সের আদলে বাননো সেলফি স্ট্যান্ডে জায়গা পেতে রীতিমতো লাইন দিতে হয়েছে। সম্প্রচার কর্মীরা সহকর্মী ও অতিথিদের সাথে বিরতিহীন ছবি তুলেছেন মিলনায়তনের ভেতরে বাইরে।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর ছিল সাংগঠনিক পর্ব। শুধু সদস্যদের জন্য নির্ধারিত এই পর্বে সমদস্যরা তাদের পেশাগত সংকট সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরেন। পরে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিজেসির চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক জানান, এই সংগঠন সম্প্রচার শিল্পের সংকট কাটাতে কাজ করছে এবং কর্মীদের যেকোন সমস্যায় পাশে আছে। বিজেসির সদস্য সচিব শাকিল আহমেদ বলেন, সম্প্রচার মাধ্যমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে এর সংকটের দিকে সরকারকে আরো বেশী নজর দিতে হবে।
বিজেসি’র এই সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে পাচটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
টেলিভিশন চ্যানেলে অন্যায়ভাবে সাংবাদিক ছাটাই বন্ধ করতে হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী ছাটাই হলে নায্য পাওনা পরিশোধ করতে হবে। নিয়মিত বেতনভাতা দিতে হবে।
গণমাধ্যম কর্মী আইন দ্রুত পাশ করতে হবে।
কেবল নেটওয়ার্ক ডিজিটাল করতে সময় বেধে দিতে হবে। এতে টিভি চ্যানেলগুলোর আয় বাড়তে সহায়ক হবে, ফলে এ খাতে অস্থিরতা কমবে।
আয় বাড়াতে বিদেশী চ্যানেলে বিজ্ঞাপণ বন্ধ এবং অনলাইন সংবাদপত্র ও মোবাইল ফোন কোম্পানির ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে।
নতুন টিভি’র অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে।
এছাড়া সম্মেলনে, সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা ও পণ্যক্রয়ে সুবিধার বিভিন্ন উদ্যোগ জানানোর পাশাপাশি আগামীর কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।
এর বাইরে বিজেসি’র দ্বিতীয় সম্প্রচার সম্মেলন উপলক্ষ্যে ছিলো একটি অর্ধ দিবস আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কর্মশালা। “সাংবাদিকতায় নিরাপত্তা ও সুরক্ষা” শিরোনামে এই কর্মশালাটি পরিচালনা করেন সিএনএন ও আল জাজিরার প্রাক্তন প্রতিবেদক তামারা ব্লারো। ৩০ জন সম্প্রচার সাংবাদিক। বিজেসির পাশাপাশি কর্মশালাটির সহ আয়োজক ছিল এমআরডিআই।