নানা চাপে দিশেহারা গণমাধ্যম


নানা চাপে দিশেহারা গণমাধ্যম

আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস।

এমন এক সময় এই দিবস এলো যখন বাংলাদেশের গণমাধ্যম দাঁড়িয়েছে পাঠকের বিচারের কাঠগড়ায়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পেশী শক্তি , আইন এর চাপ তো আছেই সাথে আছে সব চাপে সতর্ক হয়ে আত্ম নিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপ।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম কিংবা এর গণমাধ্যম কর্মীরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তা নিয়ে এর আগেও বহু আলোচনা হয়েছে। এরপরও কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং পর পর তিন বছর ধরে বিশ্বসূচকে নামছে বাংলাদেশের অবস্থান। ২০১৯ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেখানে ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এর আগের বছরের(২০১৮) তুলনায় চার ধাপ নেমে ১৫০এ দাঁড়ায়। ২০২০ সালে সেই সংগঠনের প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায় মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২০১৯ এর তুলনায় আরও এক ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫১। এবছর অর্থাৎ ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ আরও একধাপ পিছিয়ে ১৫২ নম্বরে অবস্থান করছে। 
কেনো এই অবস্থা এই দেশের গণমাধ্যমের? এই প্রশ্নের উত্তর জানে মোটামুটি সবাই । কিন্তু সমাধান অজানা। কেন এত আত্মনিয়ন্ত্রণ ,কিসের ভয় ?
বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম চর্চায় প্রধান অন্তরায় ও সাংবাদিকদের আত্ননিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, ‘ আমি মনে করি মুক্ত গণমাধ্যম চর্চায় প্রধান অন্তরায় হলো গণমাধ্যমের মালিকপক্ষ। কারণ বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরাই মূলত গণমাধ্যমের মালিক। এই ব্যবসায়ী মালিকপক্ষ আবার বিভিন্ন ভাবে যুক্ত থাকছেন রাজনীতিতে ফলে তারা তদের ব্যবসায়ীক স্বার্থ পাশাপাশি রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন। করোনা মহামারীর সময় দেখা গেছে অনেক সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন অনেক সাংবাদিকের বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু করোনার সময় না অন্যান্য সময়েও সাংবাদিকরা চাকরি হারাচ্ছেন। মালিকপক্ষের এমন আচরণের কারণে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে অনেক সময় সেলফ সেন্সরশীপ চলে আসে। সাংবাদিকরা মনে করে তার চাকরিটা মিডিয়া হাউজে ঠিক রাখার জন্য মালিককে যতটা খুশি করে চলা যায়। এই বিষয়গুলি বড় অন্তরায়।’


এছাড়াও তিনি আরও বলেন, ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্বাধীন গণমাধ্যম চর্চায় প্রধান অন্তরায়। এই আইনকে সরাসরি প্রধান অন্তরায় আমি বলব না কারণ এই ধরণের একটি আইন দেশে দরকার আছে কিন্তু এই আইনের কিছু কিছু ধারা আছে যা মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেগুলিকে হয়তো পরিমার্জন ব সংশোধন করা যেতে পারে। যেমন এই আইনের ৩২ নম্বর ধারার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। এই ধরণের সেকশন গুলোকে পরিমার্জন বা সংশোধন করা প্রয়োজন। মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চায় প্রধান অন্তরায় অন্য জায়গায়। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কেমন, অর্থনৈতিক কাঠামো কেমন আবার সেই কাঠামো গুলো সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেয় কিনা সেটি বিবেচনা করতে হবে। এখানেই মূল অন্তরায়। গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমান্বয়ে অবনমন ঘটছে। এই বিষয়টা আমাদের কে বিবেচনা করতে হবে কেন এই অবনমন হচ্ছে। পাশাপাশি এটাও দেখতে হবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থাটা কি? গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গুলোতে সাংবাদিকদের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে কোন বিষয় গুলো সমস্যা সৃষ্টি করছে। কেন সাংবাদিকরা গণমাধ্যম পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাওয়ার চিন্তা করছে। কেন সাংবাদিকরা তাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে পেশাগত নিরাপত্তা পাচ্ছেনা। সে বিষয় গুলো খতিয়ে দেখা দরকার। স্বাধীন গণমাধ্যমের পথে বাংলাদেশে প্রধান অন্তরায় মালিকানা এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভেতরে দুর্বল অবকাঠামো।’


আজ ৩ এপিল মাছরাঙা টেলিভিশিনের বার্তা প্রধান ও বিজেসির চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক রাজা বাংলা ট্রিবিউনে ‘একজন গণমাধ্যম কর্মীর অস্বস্তি’ শিরোনামে একটি কলামে লিখেছেন  , ‘মুনিয়ার অপমৃত্যুর কভারেজ নিয়ে এক শ্রেণির পাঠক-দর্শকদের যে অসন্তোষ বা সমালোচনা রয়েছে সেজন্য সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে নিন্দা করা অন্যায্য। প্রায় ৩ যুগের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মতলববাজ কিছু লোক বাদে অধিকাংশ সাংবাদিক অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার, দুর্নীতি প্রকাশ করে সমাজকে শুদ্ধ করা বা রাখার মহান ব্রত নিয়েই এ পেশায় এসেছেন। সে কারণেই আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, চাকরির অনিশ্চয়তার মধ্যেও বেশিরভাগ সাংবাদিক এ পেশা ধরে রেখেছেন।
ফেসবুকের চর্চা যারা বেশি করেন, তারা যেহেতু এই প্ল্যাটফর্মে যখন যা খুশি লিখতে পারেন, তাই তাদের ধারণা গণমাধ্যমেও সাংবাদিকরা তা করতে পারেন। যখন তারা তা পান না তখনই সাংবাদিকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। কিন্তু তারা তো শুধু তথ্য সংগ্রহ এবং তা পরিবেশনের জন্য তৈরি করে দিতে পারেন, তা প্রচার বা প্রকাশ করার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন অনেক ক্ষেত্রেই তা নিয়ন্ত্রণ করে বিজ্ঞাপনদাতা এবং মালিকপক্ষের ব্যবসায়িক বা গোষ্ঠীস্বার্থ, বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর ঘটনাগুলোর বেলায়।
ঠিক এই কারণেই এই মুহূর্তে এক শ্রেণির মিডিয়ায় গুলশান ঘটনার ভিকটিম মুনিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের চরিত্রহনন চলছে। তা করতে গিয়ে তাদের এই সাধারণ বোধশক্তিও লোপ পেয়েছে যে, মুনিয়া যদি খারাপ চরিত্রের মেয়ে হয়েও থাকে তাতেও তাকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া বা হত্যা করা যায় না। যেসব সংবাদপত্রে বা অনলাইনে এই অপসাংবাদিকতা চলছে তাতে সাধারণ সাংবাদিকদের কোনও দায় নেই। প্রতিবেদনের নামে এসব আবর্জনা হয় বাইরে থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে অথবা অতি উৎসাহী সাংবাদিকদের কেউ কেউ তা রচনা করছেন। কোনও কোনও সম্পাদক হয়তো স্রেফ চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য তা অনুমোদন করছেন।
আমাদের সবারই উচিত ঘটনাটির উপযুক্ত বিচার হতে সহায়তা করা। কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা কেউ কেউ পানি ঘোলা করে তাতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছি। ঘটনা এবং এর চরিত্রগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে সাংবাদিক কমিউনিটি পর্যন্ত বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জোরে মাত্র দুই বছরের মধ্যে পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া একটি সংবাদপত্র শুধুমাত্র মালিকপক্ষের স্বার্থের বলি হয়ে অপসাংবাদিকতার ফাঁদে পড়ে পতন ডেকে আনছে। যেসব কর্মী সেখানে শুধু সাংবাদিকতাই করতে গিয়েছিলেন তাদের অসহায়ত্ব বুঝতে পারি। সাংবাদিকতা মহান পেশা হলেও দিনশেষে এটি চাকরিও, যা বেশিরভাগ সাংবাদিকের জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস। তাই মুনিয়ার অপমৃত্যু, মামলা নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়াগুলোর নীরবতায় সেখানকার সাংবাদিকদের ঢালাও সমালোচনাও মানতে পারছি না। অন্য কোনও গ্রুপের ক্ষেত্রে হলেও এ রকমই হতো।’ তার এই লেখায় মালিকপক্ষের কাছে সাংবাদিকদের যে অসহায়ত্ব এই চিত্রই উঠে এসেছে। সাংবাদিকতায় অনেক সাংবাদিকই অনেক ঘটনা অনুসন্ধান করে বিভিন্ন তথ্য তুলে আনেন কিন্তু সেগুলো শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হয় না মালিকপক্ষের চাপের কারণে।


গাজী টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন নানামুখী চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। প্রথম তার নিজের সাথে - যা করতে চায়, সেটা পারছে না। চ্যালেঞ্জ - কন্টেন্ট-এর। মানুষ যে কন্টেন্ট চায়, সেটা মূলধারার গণমাধ্যম দিতে পারে না। চ্যালেঞ্জ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে যেখানে বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে।  বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কোন প্রাতিষ্ঠানিকতা নাই। সামন্ত সংস্কৃতির ব্যবস্থাপনা যেখানে মালিকের স্বাধীনতাই বেশি। তাই সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। পেশাদার সাংবাদিক তাই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। যারা আছে তারা কোনঠাসা।
মূলধারার গণমাধ্যম বাঁচতে হলে মানুষের কন্টেন্ট দিতে হবে।  নিজেদের পেশাগত ঐক্য ফিরিয়ে এনে মানুষের তথ্য চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ লাইন চিন্তা করতে হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিক বলেন, ‘গণমাধ্যম সংক্রান্ত যেসব আইন আছে বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মুক্ত গণমাধ্যম চর্চায়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অনেক সাংবাদিককে এই আইনের বিভিন্ন ধারায় জেলে প্রেরণ করা হয়েছে। এসব তো প্রতিনিয়তই আমাদের চোখের সামনে আসে তাই কোনো প্রতিবেদন লেখার আগে অনেকবার ভাবতে হয় যে আমার প্রতিবেদনের কারণে কোনো ঝামেলায় না পড়তে হয়। এছাড়াও সাংবাদিকদের উপর অন্যান্য আরও চাপ থাকে। যারা বিজ্ঞাপন দেয় তাদের চাপ। আমাদের গণমাধ্যম চলে তাদের দেওয়া বিজ্ঞাপনের উপর ভিত্তি করেই। এজন্য ইচ্ছা থাকলেও আমরা তাদের বিরুদ্ধে নিউজ করতে পারি না। এছাড়াও মালিকপক্ষের চাপ তো আছেই। অনেক হাউজে দেখা যায় বিনা কারণে চাকরি হারাচ্ছেন সাংবাদিকরা। এইজন্য আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। আমাদেরকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে হয়। কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহল থেকেও চাপ আসে।’

সাংবাদিকতা মহান পেশা হলেও এটি চাকরিও। অনেক সাংবাদিক জীবিকা নির্বাহ করেন সাংবাদিকতার মাধ্যমে। চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে জীবন বাঁচানোর স্বার্থে সাংবাদিককে প্রতিনিয়ত আপোষ করতে হয় এসবের সাথে। সাংবাদিকের জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা রাষ্ট্র দিতে পারেনা সাধারণ মানুষ দিতে পারে না। কিন্তু সবাই সাংবাদিকের কাছ থেকে বস্তুনিষ্ট সাংবাদিকতা চায়। সাংবাদিকদের দোষারোপ করার আগে সবার এটা চিন্তা করা উচিত যে সাংবাদিকদেরও পরিবার আছে সাংবাদিকদের জীবন আছে।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে দায়িত্ব পালনে নিহত সকল সাংবাদিকের বার্ষিক তালিকা সংকলন করে আসছে। ২০১৭ সালে এটি এক প্রতিবেদনে জানায় যে ২০১৬ সালে ৪৮ এবং ২০১৫ সালে ৭৩ জন সাংবাদিককে তাদের পেশাগত কাজের কারণে হত্যা করা হয়েছিল, এবং নিহতদের মধ্যে ১৮ জনকে খুন করা হয়েছিল। গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে মোট ৩২ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে নিহত হন। সিপিজের হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত মোট নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৪০২ জন। সংস্থাটি বন্দী সাংবাদিকদের বার্ষিক আদমশুমারিও প্রকাশ করে। সেই বার্ষিক শুমারি অনুযায়ী গত বছর পৃথিবীজুড়ে মোট ২৭৪ জন সাংবাদিককে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এছাড়াও সংস্থাটি নিখোঁজ সাংবাদিকদের তালিকাও তৈরি করে প্রতি বছর। নিখোঁজ তালিকা অনুযায়ী ২০২১ সালে এখন পর্যন্ত মোট ৬৬ জন সাংবাদিক নিখোঁজ হয়েছেন।
প্রকাশিত এসব প্রতিবেদনই বলে দেয় সাংবাদিকের জীবনের নিরাপত্তা কি অবস্থায় আছে মুক্ত গণমাধ্যম চর্চার কি কি সমস্যার সম্মুখীন হয় সাংবাদিকরা।