হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার ছাড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের ব্যবহারকারীরা


হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার ছাড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের ব্যবহারকারীরা

হোয়াটস অ্যাপের প্রাইভেসি পলিসি পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার ছাড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশীরা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান হোয়াটসঅ্যাপ বর্জনের ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় টার্কিস অ্যাপ ‘বিপ’, ডাউনলোডের দিক থেকে তুরস্ককেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। গুগল প্লে-স্টোরে ব্যবহারকারিদের র‍্যাংকিং অনুযায়ী অডিও, ভিডিও কলিং ও বার্তা আদান-প্রদান সেবাদানকারি এই অ্যাপ ডাউনলোডের ক্ষেত্রে ৯২ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে । দেশের বাজারে জনপ্রিয় অ্যাপ ফেসবুক লাইট ম্যাসেঞ্জার, ইমোকেও গত এক সপ্তাহে পেছনে ফেলেছে এই বিপ!

ব্যবহারকারিদের বার্তা আদান প্রদানে সুরক্ষা দিতে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপসনের জন্য সারা বিশ্বে জনপ্রিয় ফেসবুকেরই আরেক প্রতিষ্ঠান হোয়াটসঅ্যাপ। এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশান অর্থাৎ বার্তা প্রদানকারি ও প্রাপক ছাড়া আর কেউ তাদের ম্যাসেজ দেখতে ও পড়তে পারবেনা। এমনকি অডিও ও ভিডিও কলের ছবি ও কথোপকথন যিনি কল করছেন  আর যিনি কল ধরছেন তাদের ছাড়া আর কেউ শুনতে ও দেখতে পারবেনা। মোটকথা, হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের ধারণাটি এতোই নিরাপদ যে ব্যবহারকারিদের মধ্যকার যোগাযোগের তথ্য তৃতীয় কোনো পক্ষ জানবার সুযোগ নেই।  কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বর থেকে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইউজারদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে নতুন ইউজার পলিসি সম্পর্কে জানায় হোয়াটসঅ্যাপ। তাতে বলা হয় ব্যবহারকারি যদি এই পলিসিতে সম্মতি না দেন তাহলে আগামি ৮ ফেব্রুয়ারী থেকে আর এই অ্যাপটি ব্যবহার করতে পারবেননা। এর আগে হোয়াটসঅ্যাপ সর্বশেষ প্রাইভেসি পলিসি আপডেট করেছিলো ২০১৬ সালে। সে পলিসি অনুযায়ি ব্যবহারকারি তার তথ্য ফেসবুকের সাথে শেয়ার করবেন কিনা তা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতো। কিন্তু এবারের পলিসিতে ফেসবুকের সাথে তথ্য শেয়ার হবে এমন শর্ত রেখে তা মানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর এতেই অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এই ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ মাধ্যমের ২’শ কোটি গ্রাহকের মধ্যে। বিভিন্ন তথ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী ব্যবহারকারিদের তথ্য হালনাগাদের ঘোষণার সপ্তাহখানের মাথায় এর ডাউনলোড সংখ্যা ২০ লাখ কমে গেছে।  যদিও নিজেদের ওয়েবসাইটে ব্যবহারকারিদের প্রশ্ন-উত্তর পাতায় হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তথ্য হালনাগাকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।  হোয়াটসঅ্যাপ বলছে, তারা ব্যবহারকারিদের মধ্যকার কথোপকথন শুনতে বিংবা বার্তা পড়তে পারেনা। এমনকি ম্যাসেজ আদান-প্রদানের কোনো রেকর্ড রাখা হয়না। এই অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারিরা যে গ্রুপগুলো তৈরি করে থাকেন সেগুলোও গোপনীয় থাকে এবং এই হালনাগাদের পরেও তা বজায় থাকবে। আগের মতোই কাউকে পাঠানো বার্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে ফেলতে নির্দিষ্ট সময় সেট করে রাখতে পারবেন ইউজাররা। এছাড়া, ব্যবহারকারিদের লোকেশনও হোয়াটসঅ্যাপ দেখতে পারেনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে ব্যবহারকারিদের কি ধরনের তথ্য শেয়ার করতে হবে?

যেসব পরিবর্তন আসবে

হোয়াটসঅ্যাপ বলছে যেসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে তা ব্যক্তিগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে নয়, বরং ব্যবসা-বানিজ্য সংক্রান্ত ম্যাসেজ আদান প্রদানের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনগুলো প্রযোজ্য হবে।  উদাহরণস্বরূপ- ফেসবুক এর ব্যবহারকারিদের হোমপেইজে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপণ দেখিয়ে থাকে। কোনো ইউজারের যদি কম্পিউটার কিংবা মোবাইলফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ইন্সটল করা থাকে তবে তিনি এই অ্যাপের মাধ্যমে ঐ বিজ্ঞাপণ প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবেন। কেউ যদি, তার ফেসবুক হোমপ্যাজে একটি মোবাইলফোনের বিজ্ঞাপন দেখে বিজ্ঞাপনের সাথে জুড়ে থাকা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ঐ মোবাইলফোন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেন তবে হোয়াটসঅ্যাপ এই তথ্যটি ফেসবুকের সাথে শেয়ার করবে। পরবর্তীতে ফেসবুক ঐ ব্যবহারকারিকে তার হোমপেজে একই ধরণের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখাতে থাকবে। অর্থাৎ এরমধ্য দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক ব্যবহারকারির বর্তমান চাহিদা ও পণ্যের রুচি সম্পর্কে ফেসবুককে অবহিত করবে।  হোয়াটসঅ্যাপ জানাচ্ছে ব্যবহারকারির পাঁচটি ব্যক্তিগত তথ্য দেয়া বাধ্যতামূলক-

১। ব্যবহারকারির নাম ২। ফোন নাম্বার ৩। ফোন সেটের মডেল ৪। ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) এড্রেস (অর্থাৎ ব্যবহারকারি কোন ইন্টারনেট কানেকশনের মাধ্যমে যুক্ত হচ্ছেন) ৫। হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে যদি কোনো আর্থিক লেনদেন করা হয় তার বিবরণ।

হোয়াটসঅ্যাপের প্রাইভেসি পলিসি পরিবর্তনের ফলে বিশ্বজুড়ে একই ধরণের কয়েকটি অ্যাপের ডাউনলোড ব্যপকহারে বেড়ে গেছে। যাদের মধ্যে অন্যতম টেলিগ্রাম, সিগন্যাল ও বিপ অ্যাপ। তথ্য বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান সেন্সর টাওয়ারের হিসেবে, নতুন নিয়ম ঘোষণার আগে সিগন্যাল ডাউনলোড হয়েছিলো ২ লাখ ৪৬ হাজার বার। কিন্তু এই ঘোষণার পর অর্থাৎ গেলো এক সপ্তাহের ব্যবধানে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটিতে। সিগন্যাল সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হয়েছে ভারতে, সেখানে ব্যবহারকারির সংখ্যা মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এখন ২৭ লাখে পৌঁছেছে। আর সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হয়েছে টেলিগ্রাম। একসপ্তাহে এটি ডাউনলোড হয়েছে ৪৫ লাখ বার।

 হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুক বনাম ইলন মাস্ক

(টুইটারে সিগন্যাল ব্যবহারের পরমর্শ দেন ইলন মাস্ক)

হোয়াটসঅ্যাপের প্রাইভেসি পলিসি আপডেটের ঘটনায় ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা জাকারবার্গ এবং মহাকাশযান স্পেসএক্স ও টেসলা গাড়ি প্রস্তুতকারি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের মধ্যকার দ্বন্দ যেনো আগুনে ঘি পেয়েছে। সম্প্রতি এক টুইটে, মাস্ক তার ভক্ত ও অনুসারিদের ‘সিগন্যাল’ অ্যাপ ব্যবহারের পরমর্শ দিয়েছেন। এর আগে আরেক টুইটে একটি, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ক্যাপিটলে হামলার জন্য ফেসবুককে দায়ি করেন  

বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের জন্য হোয়াটসঅ্যাপের বার্তা

হোয়াটসঅ্যাপের বাংলাদেশি ব্যবহারকারিদের জন্য গেলো ১৪ জানুয়ারি একটি লিখিত বিবৃতি পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।  বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কমিউনিকেশন পার্টনার ‘বেঞ্চমার্ক পিআর’ গণমাধ্যমের কাছে ইমেইলের মাধ্যমে এই বার্তা পাঠায়। তাতে বলা হয়েছে,  “সম্প্রতি আমরা হোয়াটসঅ্যাপের গোপনীয়তার নীতিমালা হালনাগাদ করেছি। এ নিয়ে অনেকের মনেই অনেক ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, যার উত্তর আমরা পরিষ্কারভাবে দিতে চাই। প্রথমত, নীতিমালার এই হালনাগাদ বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের গোপনীয়তার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আগে যা ছিল, তা-ই থাকবে। হালনাগাদ যে জায়গায় হয়েছে সেটা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে, তাও আবার ঐচ্ছিক। ব্যবহারকারীরা ব্যবসায়িক কাজে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করলে আমরা কীভাবে উপাত্ত সংগ্রহ ও ব্যবহার করব, সে ব্যাপারে বরং আরও স্বচ্ছতা এসেছে”। এদিকে, ইউজারদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়ায় আগামি ১৫ মে পর্যন্ত নতুন প্রাইভেসি পলিসি বাস্তবায়ন স্থগিত করার সিন্ধান্ত জানিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ।

মাফি ইসলাম, ইউনিভার্সিটি অব গোথেনবার্গ, সুইডেন