খবরে ভয়াল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা


খবরে ভয়াল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

ছবি : সংগৃহীত

 

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, শনিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামীলীগ সমাবেশের ডাক দেয়। সমাবেশ চলাকালীন বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সমাবেশ স্থলকে কেন্দ্র করে প্রায় ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ করা হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে যায় সমগ্র বিশ্ব।

স্বাভাবিকভাবেই হামলার বিস্তারিত জানার জন্য ২২ আগস্টের পত্রিকার পাতার দিকে তাকিয়ে ছিল দেশবাসী। সেসময় দেশি বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।

২২ আগস্ট ২০০৪ তারিখে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো আট কলাম জুড়ে লাল কালিতে বোল্ড শিরোনাম করে। শিরোনামটি ছিল, “শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, গ্রেনেড হামলায় নিহত ১৬”। ‘সাব-হেডিংয়ে’ তারা লিখে, ‘বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে রক্তের স্রোত আমু, সুরঞ্জিত, সেলিমসহ আহত ৪০০’। সেদিন পত্রিকার প্রথম পাতার পুরোটা জুড়েই ছিল নারকীয় এই হামলার খবর। অন্যান্য খবরের মধ্যে ছিল, ‘শেখ হাসিনাকে হত্যার সব চেষ্টাই করেছিল হামলাকারীরা’, ‘আতঙ্কের নগরী ঢাকা’, ‘মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আইভি রহমান’, ‘আহতদের আর্তনাদে ভারি হাসপাতালের বাতাস’।

 

ছবি : সংগৃহীত

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার কালো অক্ষরে করা শিরোনামে লেখে ‘এসেসিনেশন এটেম্পট অন হাসিনা’। ‘সাব-হেডিংয়ে’ লেখা হয়। ‘গ্রেনেড অন এএল র‍্যালি সিক্সটিন কিলড’, ‘টপ এএল লিডারস এমং টু হান্ড্রেড হার্ট’।

জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনামে ছিল, ‘আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত ১৮ আহত ৫ শতাধিক’। ‘সাব-হেডিংয়ে’ লেখা হয়, অল্পের জন্য শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা অনেকের হাত-পা বিছিন্ন’।

দৈনিক ইনকিলাব লাল অক্ষরে ব্যানার শিরোনাম করে। লিখে, ‘আ'লীগ সমাবেশে গ্রেনেড হামলা’’ সাব হেড দেয়া হয়, ‘নিহত ১৮ আহত কয়েক শ।’ ভোরের কাগজের শিরোনাম ছিল, ‘হাসিনার জনসভায় বোমা, নিহত ১৮, নারকীয় হত্যাযজ্ঞে স্তম্ভিত দেশবাসী’।

 

ছবি : সংগৃহীত

সেদিনের সকল পত্রিকার প্রথম পাতা রক্তাক্ত ছবি নিয়ে সে ঘটনার সাক্ষ্য দিচ্ছে। কান্না আহাজারি সহ সব মিলিয়ে দেশে নেমে আসে প্রগাঢ় অন্ধকার। দেশি পত্র পত্রিকার পাশাপাশি বিদেশি পত্র-পত্রিকাতেও এই হামলার ঘটনা স্থান পায় বড় ঘটনা হিসেবে।

সে বছরের ২২ আগস্ট আল-জাজিরা এ ঘটনা বড় করেই প্রকাশ করে। তারা লেখে, ‘আনরেস্ট হিটস বাংলাদেশ’। ‘ঢাকায় বিরোধীদলীয় সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ১৮ জন নিহতের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন বিরোধীদলীয় প্রধান’ অনেকটা এরকমভাবেই ‘সাব-হেডিং’ সাজায় তারা। 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি আগস্টের ২২ তারিখে এ ঘটনায় ‘ব্লাস্টস হিট বাংলাদেশ পার্টি র‍্যালী’ শিরোনাম করে। ‘সাব-হেডে’ লেখে, ‘ঢাকায় বিরোধীদলের বিশাল সমাবেশে বেশ কয়েকটি গ্রেনেড হামলায় ১৮ জন নিহত এবং শতাধিক আহত’।

‘বাংলাদেশ বোম্ব কজেজ ক্যায়োস ইন ঢাকা’ শিরোনাম সংবাদ প্রকাশ করে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম এবিসি নিউজ।

প্রতিটি গণমাধ্যমেই হামলার রক্তমাখা ছবিসহ মানুষের আহাজারি, কান্নার সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

 

ছবি : সংগৃহীত

২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর অন্তত পাঁচদিন দেশের প্রতিটি পত্রিকায় হামলার ঘটনাটি প্রাধান্য পায়। হামলা পরবর্তী বিক্ষোভ, হরতালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানামুখী সংবাদ প্রকাশ হতে থাকে।

ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা সেসময় এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারসহ হামলার শিকার শেখ হাসিনাকে বিশেষ বার্তা প্রদান করে।

গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান ২৪ আগস্ট ২০০৪ তারিখে নিন্দা জানান।

তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল জানান, গ্রেনেড হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। গ্রেনেড হামলার কয়েকদিন পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে কথা বলেন কলিন পাওয়েল।

বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস গ্রেনেড হামলার ঘটনায় অবাক হয়েছেন বলে জানান। এছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা হামলার ঘটনায় সুষ্ঠু এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্তের করার আহবান জানান।

২১ শে আগস্টের ঘটনায় গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও। সেসময় জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার জানায়, এ ঘটনায় অন্তত পাঁচজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। ঘটনার পর বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকরা সমগ্র ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন।

সেসময় সাংবাদিক আতাউস সামাদ ‘এরপর আর বাকি থাকল কী?’ শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় বিশ্লেষণ লেখেন। সাংবাদিক আবেদ খান ভোরের কাগজে মন্তব্য প্রতিবেদন লেখেন- ‘এ তো সুস্থ আর সভ্য মানুষের দেশ নেই।’

হামলার দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতির মাধ্যমে হামলার নিন্দা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হামলায় নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে তখন চিঠি দেন খালেদা জিয়া।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জমান বাবর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকাকে বলেন, ‘গণতন্ত্র আজ হুমকির মুখে। এই মুহূর্তে দেশ ও জাতীর স্বার্থে এক কোটি টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে’।

নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে চলা বর্বরতম এ হামলার ঘটনায় শেষ পর্যন্ত ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। ঘটনার পর দিন মতিঝিল থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। পরে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী আরও দুটি মামলা করেছিলেন।

 

ছবি : সংগৃহীত

মাঝে ২০০৫ সালে জজ মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। আটকের ঘটনা নিয়ে নানা বিতর্ক হবার পর ২০০৮ সালের ১১ই জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয় এবং ২০০৯ সালে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় জজ মিয়াকে।

২০১১ সালের ৩ জুলাই বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন মামলাটির তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আখন্দ।

২০১২ সালের ২৮ মার্চ মামলার বিচার শুরু হয়। ৬ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এতে বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরিসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়।