৭৫'র গণমাধ্যমে ভয়াল ১৫ আগস্ট


৭৫'র গণমাধ্যমে ভয়াল ১৫ আগস্ট

 

১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন। সেখানে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি, আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’ সেই ভাষণের পর কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে ভাষণ দিলে, এখন থেকে সাবধানে থেক। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।’

ঠিক দুই বছরের মাথায়, ফিদেল কাস্ত্রোর সেদিনের কথাটিই সত্য হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোর, পুরো বাংলাদেশ যখন ঘুমে, ঠিক তখনই ঘটে গেলো ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ঘটনা। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাসায় সপরিবারে হত্যা করা হলো। এরকম ঘটনার পর দেশের কোন প্রচার মাধ্যম এমনকি চলচ্চিত্রেও তাঁর নাম বা ছবি প্রকাশ হতে দেখা যায়নি।

কেমন ছিলো সেদিনের গণমাধ্যমগুলো…

শেখ মুজিব, তার পরিবার ও কর্মচারীদের হত্যার পর পর ভোর বেলায় শাহবাগের বাংলাদেশ বেতারের ব্রডকাস্ট শাখা থেকে হত্যাকাণ্ড, সেই সঙ্গে সামরিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ঘোষণা প্রচার করা হয়েছিল। সেদিন সেনাবাহিনীর নির্দেশ মতো রেডিওর সব ইকুইপমেন্টগুলো খুলে দেয়া হয় এবং মিরপুরের ট্রান্সমিশন স্টুডিও থেকে ঘোষণাটি প্রচার করা হয়।

মেজর শরীফুল হক ডালিম একটা লগ বুকের কাগজে বিবৃতি লিখেন এবং সেটাই প্রচার করেন। যেখানে বলা হয়, "শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে এবং খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। দেশবাসী সবাই শান্ত থাকুন। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।" পরে কয়েকবার এই ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তী রেকর্ডিংয়ে শেখ মুজিবকে "হত্যা করা হয়েছে" বলার পরিবর্তে "উৎখাত করা হয়েছে" বলে ঘোষণা দেয়া হয়।

সেই সময় মেজর শাহরিয়ার রশিদ কড়া নির্দেশনা দেন যেন শেখ মুজিবুর রহমান বা তার দলের নাম, রবীন্দ্র সংগীত, জয় বাংলা স্লোগান কিছুই প্রচার করা না হয়। পরে খন্দকার মুশতাক তার মৌখিক নির্দেশে বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে রেডিও বাংলাদেশ রাখেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দেয়ার কথা ছিলো বঙ্গবন্ধুর। সেই বিষয়টি ১৫ আগস্টের পত্রিকায় বেশ গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করা হয়েছিল। অথচ ২৪ ঘন্টা না পেরোতেই পালটে যায় যায় দৃশ্যপট। ১৬ আগস্টও পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু তথা সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত ছিলো।

সেদিনের দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রধান সংবাদ ছিল ‘খোন্দকার মোশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি। পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তেও শেখ মুজিবের পতন ঘটিয়ে মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলা হয়েছিলো। হত্যাকাণ্ডের কোনো বিস্তারিত বর্ণনা ছিলো না, হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্থান পেয়েছিল এভাবে, ‘শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য প্রকাশ’।

দ্যা বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় প্রথম পাতার সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে ‘ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজনীয়’ বলা হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়ও প্রথম পাতার সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ বলা হয়েছিলো।

এমনকি স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নিহত সদস্যদের টুঙ্গিপাড়ায় দাফনের সংবাদগুলোও সংবাদপত্রে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে প্রচার করা করা হয়েছিলো।

তবে ঠিক উলটো ছিলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। পচাঁত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবরে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে বিশ্বসম্প্রদায় ও গণমাধ্যমগুলো। গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিলো শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবরটি।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তাদের প্রতিবেদনে বলে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।’

পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তাঁর কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’

ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করছেন। মূলত এক দিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’

ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন-বিবিসি প্রকাশ করে, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে।’

লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’

দ্য গার্ডিয়ানে লেখা হয়— ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’।

নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।

এদিকে, বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’

ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’

ব্রিটিশ এমপি জেমসলামন্ড বলেছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’

ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ভাষ্য ছিলো- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’

জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথা কাউন্ডা বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’

বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন- ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ইতিহাস পুনরাবৃত্তি শুরু হয়। সেসময় তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন আবু সাঈদ। সে সময় তিনি 'রেডিও বাংলাদেশ'-এর নাম, মৌখিক নির্দেশে পুনরায় 'বাংলাদেশ বেতার' রাখেন। চলচিত্র, গণমাধ্যম ও পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস জায়গা করে নেয়া শুরু করে। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছিলো তার সঠিক ইতিহাসও প্রচার হতে থাকে গণমাধ্যমগুলোতে।