পত্রিকার পাতায় একাত্তরের ১৬'ই ডিসেম্বর...


পত্রিকার পাতায় একাত্তরের ১৬'ই ডিসেম্বর...

প্রতিদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগেই কয়েক'শ দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ পায়....সেই সকল পত্রিকা ছড়িয়ে যায় ৫৭,৩২০ বর্গমাইলের দেশ বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। তবে একবার কি ভেবে দেখেছেন, শুধু মাত্র শ্বাধীন দেশ দেখেই এরকমটা সম্ভব হয়েছে।
কারন এখন থেকে ৪৯ বছর আগে কিন্তু প্রতিদিন এমনটা হতো না, পাকিস্তানিদের নখদর্পনে ছিলো সেসময়কার গণমাধ্যম। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিলো আরো ভয়াবহ অবস্থা। দেশী গণমাধ্যম ছিলো পাপেট, আর বিদেশী গণমাধ্যমকে বাধা দেয়া হয়েছে সংবাদ সংগ্রহে।
তবে বাঙ্গালি তো দাবিয়া রাখা জাতি নয়, দাবিয়ে রাখা তো বাঙ্গালিকে যায় না। নয় মাসের যুদ্ধ শেষে একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর মানচিত্রের বুকে নতুন রাষ্ট্র জায়গা করে নেয়। নাম তার বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশের স্বাধীন গণমাধ্যম সংবাদ ছাপিয়েছে।
বিজয়ের আনন্দ খবর কেমন ছিলো পত্রিকাগুলোতে....
শুরুতেই বলে নেই, ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন দেশে অনেকগুলো দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। ঐ সময়ের প্রধান দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হয় ১৭ই ডিসেম্বর। শিরোনাম ছিলো-
'দখলদার পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণ, সোনার বাংলা মুক্ত'।প্রধান ঐ সংবাদে বলা হয়, 'এই আত্মসমর্পণের ভিতর দিয়াই সোনার বাংলা এবং তার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জীবন হইতে বিভীষিকাময় তিমিরের অবসান ঘটিয়াছে। রক্তস্নাত বাংলা দেশের পূর্ব দিগন্তে আজ স্বাধীনতার অম্লান সূর্য উদ্ভাসিত। আজিকার এই শুভলগ্নে আমরা স্মরণ করিতেছি সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে যাঁরা সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের দাবী আদায়ের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়া দিয়াছেন, সান্তনা দিতেছি সন্তানহারা মাকে, স্বামীহারা স্ত্রীকে, পিতৃ-মাতৃহারা এতিমের সন্তানদের। এই সংগে স্মরণ করিতেছি স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি আজকের এই মুহূর্তে পর্যন্তও পাক সেনাবাহিনীর কারাগারে অন্ধ-প্রকোষ্ঠে আটক। সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ তাই তাঁকে কাছে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান।
ঠীক তার একদিন পরেই, অর্থাৎ ১৮ই ডিসেম্বর ইত্তেফাকের প্রধান সংবাদে বিজয়ের আনন্দকে ম্লান করে দেয়। 
ইত্তেফাক-এর প্রধান সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড, ঢাকার শতাধিক সাংবাদিক সাহিত্যিক অধ্যাপক চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবী নিহত।’ ওই প্রতিবেদনে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামোল্লেখ করে বলা হয়, ‘দখলদার পাক বাহিনীর শেষ নৃশংস গণহত্যার নির্মম শিকার সোনার বাংলা দেশের বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ ছড়াইয়া ছিটাইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ঢাকার শহরতলী রায়ের বাজারের অদূরবর্তী খানা-খন্দ, ইটের গাদা ও গর্তে ইতিহাসের সেই জঘন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহের সবগুলিই পেছনে হাত বাঁধা এবং বুক ও মাথায় গুলি ও বেয়োনেটের আঘাতের চিহ্ন। অনেকগুলির চোখ উপড়ানো। অনেকগুলি মৃতদেহ শকুন, শৃগাল, কাক ও কুকুরের আহার্যে পরিণত হইয়াছে। অনেকগুলির শুধু কংকাল ছড়াইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। সমগ্র এলাকা পুঁতিগন্ধে বিষাক্ত।’ 
এছাড়াও সেই সময়ে ভারতের বিভন্ন অঞ্চল থেকে পত্রপত্রিকা প্রকাশিত করা হয়। যেমন, আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে বের হত জয়বাংলা, কমিউনিস্ট পাটির মুখপত্র হিসেবে বের হতো মুক্তিযুদ্ধ, কবি ও সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর বের করতেন অভিযান। যুদ্ধের সময় এসকল পত্রিকাগুলোর ভুমিকা ছিলো অসাধারন, ঠীক তেমনেই যুদ্ধের পরেও থামেনি তাদের কলম। 
১৯ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ প্রকাশ করে  ‘আনন্দে বেদনার সুর’শিরোনামে একটি খবর।  
‘বাঙলাদেশের রাহুমুক্তিতে প্রতিটি দেশবাসী আনন্দে উদ্বেল হইয়া উঠিলেও এই আনন্দের মধ্যেই বাজিতেছে বেদনার সুর। বাঙলাদেশের জনগণের প্রিয় নেতা গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান আজ আমাদের মধ্যে নাই। তিনি কসাই ইয়াহিয়ার নির্জন কারাগারে বন্দী। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কেহ জানে না। 
শেখ সাহেবের অনুপস্থিতি সকল আনন্দ উৎসবকে ম্লান করিয়া দিতেছে।’
অভিযান, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে প্রকাশ করে যশোর স্বাধীনের পর এক জনসভার সংবাদ।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। জনসভায় কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধ আদালত গঠন এবং এই আদালতে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার। সেসব কিছু সংবাদ আকারে প্রকাশ করে 
অভিযান।
মুক্তিযুদ্ধ, ১৯ ডিসেম্বর
ঐ একই জনসভায় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাংলাদেশের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, এই সংবাদ প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ তাদের ১৯ ডিসেম্বরের পত্রিকায়।
কলকাতার দৈনিক যুগান্তর
১৭ ডিসেম্বর সংখ্যার সংবাদ ‘রাহুমুক্ত বাংলাদেশ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে কলকাতার দোইনিকজ যুগান্তর। এতে বলা হয়,‘যে-মাটিতে পড়েছে শহীদের পূত শোণিতধারা, সে-মাটি নেবে না পিশাচের দূষিত রক্ত। তবে পাইকারী হারে ছাড়া পাবে না দেশদ্রোহী এবং সমাজদ্রোহী ঘাতকের দল। গণআদালতে তাদের বিচার অবশ্য কাম্য। যারা অপরাধী, তারা পেতে পারে না ক্ষমা—পেতে পারে না নিষ্কৃতি। যে-আগুন জ্বলছে আজ বাংলাদেশের বুকে, তা নিভানোর জন্যই দরকার উপযুক্ত বিচার। নইলে শান্ত হবে না বাঙালীর অশান্ত আত্মা। সত্য এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে না সমাজ।’ 
ত্রিপুরার আগরতলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ
মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ত্রিপুরা রাজ্য। সে সময় ত্রিপুরার আগরতলা থেকে প্রকাশিত হতো দৈনিক সংবাদ। তারা বাংলাদেশের বিজয়ের খবরের শিরোনাম করেছিল বেশ দীর্ঘ করে। ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর সংবাদে তারা লিখে‘অবশেষে শত্রুসেনা নতজানু, আজন্ম লালিত সেই পবিত্র মুখ উদ্ভাসিত, বাঙলাদেশ শত্রুমুক্ত, মিত্র বাহিনীর কাছে দখলদার পাক সেনা বাহিনীর নিঃশর্ত্ত আত্মসমর্পণ, ঢাকা মুক্ত, নতজানু শত্রু সেনাপতি, সোনার বাঙলার শ্যামল প্রান্তরে মানুষের বিজয় বৈজয়ন্তী, মাতৃদেহে লক্ষ লক্ষ সন্তানের রক্তে কর্দ্দমাক্ত করে, বাঙলার বাতাসকে কান্নায় ভরিয়ে দিয়ে যে সেনাবাহিনী সভ্যতার বিজয় রথকে পিছিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল তারা আজ ক্ষমাপ্রার্থী, আজন্মলালিত স্বপ্নের সেই পবিত্র মুখ আজ উদ্ভাসিত, আজ আবার সেই নিঃশব্দ পাখীর কণ্ঠে গান, সেই পুণ্যতোয়া জীবনের আপ্লুত কলতান, কোটি প্রাণ আজ বাঙলার মুখ দেখেছে, আজ স্বজন হারানো শ্মশানে শত্রুর বহ্নিমান চিতা, বাঙলা আজ মুক্ত, ঢাকা আজ উন্মুক্ত।’ 
‘রাজধানী আগরতলায় বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের জোয়ার’-শিরোনামে একই পত্রিকার ১৭ ডিসেম্বরের আরেকটি সংবাদ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়‘২৬শে মার্চের মধ্যাহ্নে যে রাজধানী আগরতলা প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল বাংলাদেশের বুকে জঙ্গী শাহীর উন্মত্ত বর্বরতার প্রতিবাদে, আজ পূর্ণ বিজয়ের আনন্দে সন্ধ্যার রাজধানী প্রাণোচ্ছ্বল। বাংলাদেশ মুক্ত, ঢাকা স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মুক্ত রাজধানী-আকাশবাণীর এই ঘোষাণাটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শহর আগরতলায় উচ্ছ্বসিত আনন্দের স্রোত বয়ে যায়। আনন্দের প্রাবল্যে জনসাধারণ রাস্তায় বাজি ফাটিয়ে, জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে আকাশ কাঁপিয়ে তোলেন। অনেককেই উচ্ছ্বাসের কান্নায় প্রিয়জনদের মিষ্টি মুখ করিয়ে আলিঙ্গন করতেও দেখা যায়।
 
সাপ্তাহিক আমোদ
কুমিল্লা মুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর। কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমোদ থেকেও পাওয়া যায় ঢাকার বাইরের শত্রুমুক্তির খবর এবং মানুষের আনন্দের চিত্র। 
১৬ ডিসেম্বর তারা শিরোনাম করে-‘বাংলার বিভিন্ন এলাকার সহিত কুমিল্লাও শত্রুমুক্ত’। বিস্তারিত সংবাদে লিখে‘গত ৮ই ডিসেম্বর বুধবার প্রত্যুষে শহরবাসী কুমিল্লা শহরকেও যেন হালকা, স্বচ্ছ ও পবিত্র বলিয়া দেখিতে পায়। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই জানিতে পারে কুমিল্লা শহর শত্রুমুক্ত এবং মুক্তি ও মিত্র বাহিনী কুমিল্লা শহরে পৌঁছিতেছে। এই আনন্দে 
আনন্দ উল্লাসে একে অন্যের সহিত আলিঙ্গন ও জয়বাংলা ধ্বনি দিতে থাকে।
জনগণ 
এছাড়াও ১৬ই ডিসেম্বর ‘বিমানবন্দরে জয়োল্লাস’শিরোনামে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত করে সাপ্তাহিক আমোদ।
 
দ্য জার্নাল হেরাল্ড
বিজয়ের একদিন পরে মার্কিন সাংবাদিক কিস বিচ লিখলেন, ‘আজন্ম বঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তান আর নেই। শত্রুভাবাপন্ন ভারতীয় ভূখণ্ডের দুই পারে, হাজার মাইল ব্যবধানে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে ফারাক রাত আর দিনের মতো। অবাক করা বিষয়, এরপরও তা এত দিন টিকে ছিল।’
পুলিৎজার জয়ী এই সাংবাদিকের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের বিশ্লেষণটি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের দ্য জার্নাল হেরাল্ড-এ প্রকাশিত হয়।
কেনোসা নিউজ
‘এখন সেখানে সত্যিই এক বাংলাদেশ’- এই শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের কেনোসা নিউজ পত্রিকা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর।
যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যের দ্য টাইমস আরগাস, ওরেগন থেকে প্রকাশিত করভালিস গেজেট টাইমস, কেনটাকির দ্য লেক্সিংটন লিডার, নিউইয়র্কের দ্য ইথাকা জার্নাল, ক্যালিফোর্নিয়ার দ্য প্রেস ডেমোক্র্যাট, ওহাইওর দ্য জার্নাল হেরাল্ড ও পিকা ডেইলি কল এবং নর্থ ক্যারোলাইনার দ্য মর্নিং নিউজ বাংলাদেশের বিজয় নিয়ে প্রধান শিরোনাম করে। এর মধ্যে তিনটি পত্রিকা প্রায় পুরো পাতাজুড়ে বাংলাদেশের বিজয়ের খবর প্রকাশ করে।
 
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসাবে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়। তবে সেই বিজয়ের আনন্দ ছিল আনন্দ ও বেদনার। একই সঙ্গে যেখানে বিজয়ের উতসব চলছে, সে সময়েপাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা, বুদ্ধিজিবীদের হত্যা আর গায়েবের সংসয়ে দেশ ছিলো বেদনার। এই সব বিষয় নিয়ে নান ধরনের সংবাদ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধমে বেশ কয়েকদিন প্রকাশ পেয়েছিলো।
লেখক অথবা গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে নয়, একজন গর্বিত বাংলাদেশী হিসাবে সেসকল গণমাধ্যমকর্মীদের জানাই স্যালুট ও ভালোবাসা।
 
বিঃদ্রঃ সকল তথ্য-উপাত্ত ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত।