আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ১৯৭১'র ১৬ই ডিসেম্বর...


আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ১৯৭১'র ১৬ই ডিসেম্বর...

গণমাধ্যম….এমন এক শক্তির নাম, যে শক্তি সম্পর্কে সবার জানা আছে। একমাত্র শক্তি যারা পারে সত্যকে মিথ্যা, আবার মিথ্যাকে অনায়াসে সত্যে রুপ দিতে। এটি এমনই এক শক্তি যা যেকোনো আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে এক নতুন বেগে অথবা এক তুরিতেই শেষ করে দেয় যেকোন আন্দোলন। তাই যেকোনো বিপ্লবে গণমাধ্যমের একটি বিশেষ ভুমিকা থেকেই যায়। কষ্টে পাওয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও গণমাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা ছিলো। আজ জানবো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভুমিকা কতটুকু ছিলো একাত্তরে।

আন্তর্জাতিক পত্রিকা

ডেইলি টেলিগ্রাফ

২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশীদের উপর কাপুরুষের মতো হামলা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই সময় তারা বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দী করে। তবে তিনি ওয়ালী খানের মাধ্যমে গোপনে খবর পেয়ে, যাওয়ার আগে একটি ঘোষণাপত্র লিখে রেখে যান যা সেই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জিয়াউর রহমান পাঠ করেন। এই ভাষণটি চট্টগ্রাম বেতার থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

কিন্তু এরপর পাকহানাদারবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায় বাঙালিদের উপর।  নজর রাখে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের উপর। তবুও পারেনি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে ২৫ মার্চে তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তথ্য গোপন করতে।

দুই ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ও ফটোসাংবাদিক মাইকেল লরেন্ট সব কিছুকে পেছনে ফেলে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে একটি প্রতিবেদন পাঠান; যার শিরোনাম ছিল ‘ট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’।

২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট চলাকালে পাকবাহিনী বিদেশি সাংবাদিকদের একত্র করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাখেন, যা বর্তমানে রূপসী বাংলা নামে পরিচিত। সবাইকে একত্র করে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার বাইরে, যেন তারা এই গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করতে না পারেন এবং বিশ্ব গণমাধ্যমে তা প্রচার করতে না পারেন।

কিন্তু সাইমন ড্রিং ও মাইকেল লরেন্ট হোটেলের কর্মীদের সহায়তায় লবি, রান্নাঘর ও ছাদে লুকিয়ে থেকে পাকবাহিনীর চোখে ধুলো দিতে সক্ষম হন। ২৭ তারিখে কারফিউ উঠে গেলে তারা হোটেল থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নৃশংস গণহত্যার তথ্য-চিত্র ধারণ করেন। ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে তারা একটি প্রতিবেদন পাঠান।

সানডে টাইমস

সাইমন ড্রিংয়ের প্রতিবেদনে পাকবাহিনী আরও বেশি সতর্ক হয়ে যায়। এবং কয়েকজন আন্তর্জাতিক সাংবাদিককে অনুমতি দেয় মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রচার করতে, তবে শর্ত হচ্ছে, তাদের তত্ত্বাবধানে লেখা হবে সকল প্রতিবেদন। এর ফলে বিশ্ব গণমাধ্যম মাসের পর মাস তাদের অরাজকতার ব্যাপার অজ্ঞই থেকে যাচ্ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের এই অনৈতিকতা ও নৃশংসতা সহ্য করতে না পেরে সাহস দেখান অ্যান্থনি মাসকারেনহাস।

বাংলাদেশের এই নির্মমতা দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি। তার বোন খুব অসুস্থ এবং তিনি তাকে দেখতে যেতে চান এমন মিথ্যা বলে তিনি সরাসরি লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার হেড অফিসে যান এবং তাদেরকে পাকবাহিনীর গণহত্যা নিয়ে তার লেখা একটি প্রতিবেদন প্রচারের অনুরোধ করেন।

মাসকারেনহাস জানতেন, এই প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে তার পইবার হুমকির মুকে পরে যাবে। তাই তিনি সানডে টাইমসের কাছে আরও একটি অনুরোধ করেন, এই প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে যেন তার পরিবারকে লন্ডনে নিয়ে আসা হয়। সানডে টাইমস তার শর্ত মেনে ১৩ জুন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে; যার শিরোনাম ছিল ‘জেনোসাইড’ অর্থাৎ গণহত্যা।

এই মানবতাবাদী সাংবাদিককে পাকিস্তানীরা আখ্যায়িত করে 'রাজাকার' হিসেবে। কিন্তু তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই, কারণ তিনি সত্য প্রচার করেছেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।

দ্য গার্ডিয়ান

নিউ ইয়র্কে ম্যাডিসন স্কয়ারে গায়ক জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান এবং কবি পণ্ডিত রবিশঙ্কর একটি কনসার্টের আয়োজন করেন- ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে।

এছাড়াও কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি প্রভৃতি দেশের সাংবাদিকরা বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাদের মধ্যে মার্টিন অ্যাডনি, যার তিনটি প্রতিবেদন ২৬ মার্চে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ছাপা হয়।

এছাড়াও ফরাসি সাংবাদিক বার্নার্ড হেনরি লেভি, দ্য নিউ  ইয়র্ক টাইমসের সিডনি শ্যানবাগ, ইতালির সাংবাদিক ওরিয়ানাফেলাচি প্রমুখ সাংবাদিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিবাচক প্রচারণায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

'বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস …

বিবিসির খবরে তখন বলা হয়েছে, ".....কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।..."

ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়েছিলো:

"....ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন..."।

দিল্লির দি স্টেটসম্যানের খবর ছিলো:

"বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।"

দি গার্ডিয়ান:

গার্ডিয়ানের ২৭শে মার্চ সংখ্যায় এক খবরে বলা হয়, "...২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দি ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।"

এর বাইরে ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর।

আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস হেরাল্ডের ২৭শে মার্চের সংখ্যার একটি খবরের শিরোনাম ছিলো, "বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।"

বার্তা সংস্থা এপির একটি খবরে বলা হয়,

"ইয়াহিয়া খান পুনরায় মার্শাল ল দেয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।"

আয়ারল্যান্ডের দি আইরিশ টাইমসের শিরোনাম ছিলো –

পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা আর সাথে ছিলো শেখ মুজিবের ছবি।

দিল্লি থেকে রয়টার্সের খবরে বলা হুয়,

১০ হাজার মানুষের নিহত হবার ও স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিবকে সম্ভবত আটক করা হয়েছে, এমন কথা বলা হয়।

ব্যাংকক পোস্টের খবরে বলা হয়,

"শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।"

'বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস (আ.ফ.ম সাঈদ)' বই থেকে তথ্য নেয়া।

 

মার্কিন দৈনিক ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’

১৬ ডিসেম্বরের ডেট লাইনে প্রকাশিত লি লেসকেজের লেখা এরকম একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ শেষ : উল্লাস আর পুষ্প সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে ভারতীয় বাহিনীর ঢাকায় প্রবেশ।’

‘লন্ডন টাইমস’ ১৬ ডিসেম্বর ডেটলাইনে লেখে…

‘পাকিস্তানি জেনারেল উদগত কান্না চাপছিলেন’ শিরনানমে সাংবাদিক পিটার ও লাওলিন লিখেন ‘পশ্চাত থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল। অস্তগামী সূর্যের আলোয় ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পাতা টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়েছিল এক দঙ্গল মানুষ। লেফটেন্যেন্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছিলেন। শত শত বাঙালি জয় বাংলা ধ্বনিতে ফেটে পড়ে।  

একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর নিউইর্য়ক টাইমসের প্রথম পাতায় মোট ১৪টি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। ঢাকায় আত্মসমর্পণের উপর রিপোর্ট ছিল দুটি। একটি জেমস পি স্টিরার এবং অপরটি সিডনি এইচ স্যানবার্গের।

লন্ডনের ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকাতেই প্রায় একই রকম একটি প্রতিবেদন ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ডেট লাইনে ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি করেন সাংবাদিক ডেনিস নিল্ড। তিনি লিখেন ‘গতকালের (১৬ ডিসেম্বর) দিনটি ঢাকার অধিবাসীদের জন্য মুক্তির দিনে পরিণত হয়। তারা কাঁদে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে।

বিঃদ্রঃ সকল তথ্য-উপাত্ত ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত।